সমাজে উচ্চ ও নিম্নবিত্তের ভারসাম্য রক্ষা করে মধ্যবিত্তরা…
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:৩২:৩৩,অপরাহ্ন ০৬ জুলাই ২০১৯ | সংবাদটি ৭৭১ বার পঠিত
আবারো বাড়ছে গ্যাসের দাম। সাথে বাড়তে শুরু করেছে নিত্যপণ্যের দামও। এরই ধারাবাহিকতায় বাড়বে জীবনযাপনের সামগ্রিক ব্যয়। মধ্যবিত্তের জন্য এ যেন নিয়তির লিখন। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পাস হয়েছে, যা ইতোমধ্যে কার্যকরও হয়েছে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, বাজেট পাসের পর সব নিত্যপণ্যের দাম, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পরিবহন, বাসাভাড়া, কৃষিপণ্যসহ অন্য সব সেবার খরচ বাড়বে। আর এর ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে নাভিশ্বাস উঠবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির।
বেসরকারি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মনে করে, প্রস্তাবিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে এবং সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে দেশের ধনীরা। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় ৬ শতাংশ বেড়েছে, যা ২০১৭ সালে বেড়েছিল ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ হারে। দেখা গেছে, জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর ধারাবাহিক প্রভাবের ফলে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়ে মধ্যবিত্তরা।
এ কথা সত্য, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বেড়েছে গড় আয়ু। তবে উন্নতির চাকচিক্য সমাজের উঁচু আর নিচু স্তরে যতটা লক্ষ করা যায় তার সিকিভাগও যেন মধ্যবিত্তের ভাগ্যে জোটে না। এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যবিত্তের বিকাশে জরুরি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোয় সরকারের মনোযোগ কম।
মধ্যবিত্তের বিকাশে যে বিষয়গুলোতে জোড়া দেওয়া প্রয়োজন সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, সংস্কৃতিচর্চা। মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রধান শক্তি শিক্ষা-সংস্কৃতি-ধর্মীয় মূল্যবোধ। মধ্যবিত্ত সমাজের প্রত্যাশা সীমিত জীবনযাত্রার ব্যয়, সন্তানের জন্য শিক্ষার সুব্যবস্থা এবং শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, দেশে ভোগবাদীদের অবারিত সুযোগ-সুবিধায় অনেকটা কোণঠাসা হয়ে না ঘরকা, না ঘটকা অবস্থায় ঝিম মেরে আছে মধ্যবিত্ত সমাজ।
সমাজে উচ্চবিত্তদের অভাব নেই। বরং তারা বিত্তবৈভবের প্রভাবে বাজারমূল্যকেও প্রভাবিত করে, যার জের টানতে হয় মধ্যবিত্তকে। আর নিম্নবিত্তদের চাহিদা কম, খরচ কম, আয় বেশি- আয়ের ক্ষেত্রও বেশি।
অন্যদিকে মধ্যবিত্তরা সামাজিকতা, দেশপ্রেম, মানবীয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এমন কিছু আদর্শ অনুসরণে জীবনযাপন করে অভ্যস্ত। তাই তারা যা খুশি তা করতে পারে না। তাদের স্বপ্ন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা উচ্চবিত্তের মতো হলেও তা পূরণের সাধ্য নেই মোটেও। আবার তারা নিম্নবিত্তের মতো জীবনযাপন করতেও অপারগ। তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাওয়া যায় না। চতুর্মুখী চাপে জীবনযাত্রার ঊর্ধ্বমূল্যের সঙ্গে তারা পার পেয়ে উঠছে না। সন্তানের শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। আবার শিক্ষা শেষে ঘুষ ছাড়া চাকরিও মিলছে না। চিকিৎসা ব্যয় তুঙ্গে ওঠার কারণে রোগে-শোকে নাকাল। এমতাবস্থায় কোথায় যাবে মধ্যবিত্তরা।
প্রতিবছরই রাষ্ট্র পরিচালনা ও জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে বাজেট ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে উন্নত দেশের স্বপ্ন সোপানে। আর এই স্বপ্নপূরণের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিবছরই বড় হচ্ছে বাজেটের আকার। বাস্তবায়ন হচ্ছে, আর বাস্তবায়ন হচ্ছে বলেই ঘুরছে দেশের অর্থনীতির চাকা। কিন্তু বাজেটের তালে যে চাকাটি মন্থর গতিতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে তার নাম মধ্যবিত্ত। প্রতিবছর বাজেটের পর জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর যে প্রভাব পড়ে তার প্রধানতম শিকার মধ্যবিত্ত সমাজ। এবারের বাজেটেও মধ্যবিত্ত সমাজের জন্য তেমন কোনো সুখবর নেই বলে বিভিন্ন মহল থেকে আলোচনা-সমালোচনা করা হচ্ছে।
বাস্তবতা অনেকটা এ রকমই। প্রতিবছরই বাজেটের পর অনেক পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। আর এই চাপে পড়ে পিষ্ট হতে হয় বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সমাজকে। কারণ দ্রব্যমূল্যের পাশাপাশি বেড়ে যায় পরিবহন খরচ, মোবাইল বিল, শিক্ষা ও চিকিৎসা খরচ, তার ওপর বাড়িওয়ালারা বাড়িয়ে দেন বাড়িভাড়া। বরাবরই এমন চতুর্মুখী চাপে পড়তে হয় তাদের। ক্রমাগত এই চাপের ফলে ভেঙে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত সমাজের আদর্শের শেকড়। আদর্শবিচ্যুত হতে বাধ্য হচ্ছে মধ্যবিত্তরা। অথচ একটি দেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও সভ্যতার ধারক-বাহক হিসেবে মধ্যবিত্ত সমাজের ভূমিকাই প্রধান। মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছাড়া একটি সুস্থ সমাজ কল্পনা করা যায় না। তাই এই সমাজকে অবহেলা করে টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, একটি পরিশীলিত সমাজব্যবস্থার জন্য মধ্যবিত্তের সুখী অবস্থান জরুরি। কারণ তারা একটি নির্দিষ্ট মানের জীবনযাত্রা পরিপালন করে। মধ্যবিত্তের দেশপ্রেম, চেতনা ও মূল্যবোধ সমাজকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কিন্তু মধ্যবিত্তের সেই জৌলুসকে ম্রিয়মাণ করে দেয় রাষ্ট্রের অবহেলা। কারণ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশে যথাযথ বিনিয়োগ বা প্রণোদনা নেই। তাদের সীমিত সঞ্চয় বিকাশে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। উপরন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মানসিকভাবেও তাদের পদে পদে ধাক্কা খেতে হয়। অথচ দেশে মধ্যবিত্তরাই এখন উন্নয়নের বড় অংশীদার। কারণ তারাই পণ্য বাজারজাতের বড় ভাগীদার। মধ্যবিত্তের প্রসারণের ফলেই নগরায়ণ বাড়ছে, বাড়ছে মাধুর্যতা।
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল ইস্টার্লি মনে করেন, ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণির মতের মিল থাকলে দেশের উপার্জনের মাত্রা ও প্রবৃদ্ধি বেশি হয়। সমানতালে গণতন্ত্র প্রসার লাভ করে। ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা হ্রাস পায়। হিউম্যান ক্যাপিটাল বা মানব পুঁজি সৃষ্টি হয়। অবকাঠামোর সমাহার হতে থাকে। অর্থনৈতিক নীতি উত্তম হয়। আধুনিক কাঠামো তৈরি ও নগরায়ণ প্রসার লাভ করে।’ তিনি সত্যিই বলেছেন, মধ্যবিত্ত সমাজের সরব উপস্থিতি এবং প্রবৃদ্ধি একই সঙ্গে চলে। কারণ উভয়ে অর্থনৈতিক নীতির ফল।
বিশ্লেষকদের মতে, বিগত তিন দশকে চীনে সম্পদের প্রাচুর্য বিশাল আকারে বৃদ্ধি হওয়া মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই আমরা যে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি— মধ্যবিত্তের উপস্থিতি ছাড়া সে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করাই অলীক বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। কারণ মধ্যবিত্তরা উচ্চ ও নিম্নবিত্তের ভারসাম্য রক্ষা করে।