ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে মাতৃভাষার গুরুত্বঃ প্রেক্ষিত আই বি কারিকুলাম
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:৫৩:১৮,অপরাহ্ন ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | সংবাদটি ২৩৭৭ বার পঠিত
এ এন এম মুশফিক সিদ্দিকী/ রেজুয়ান চৌধুরী:
ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে মাতৃভাষার চর্চাঃ মাতৃভাষা হচ্ছে এমন ভাষা যা একজন মানুষ খুব সহজাতভাবেই তার শৈশবকাল থেকেই আয়ত্ত করে বা কথা বলে থাকে। যাকে আমরা মায়ের শেখানো বুলি বা মাতৃভাষা বলে থাকি। আমরা বৈশ্বিকভাবে দেখলে দেখি দুনিয়াজুড়েই ইংরেজি ভাষা বাণিজ্যিক ও উপনিবেশিক ভাষা হিসেবে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।। শিক্ষাক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। একারনেই এই উপমহাদেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশেও প্রায় ১০০ টির ও অধিক ইংরেজি মাধ্যম স্কুল তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে মাতৃভাষা চর্চা নিয়ে অনেকের মধ্যেই ভুল ধারনা প্রচলিত আছে। অনেকেই মনে করেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাংলা ভাষা গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হয় না।প্রকৃত কথা হচ্ছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বিশেষ করে আন্তর্জাতিক (আই বি) স্কুলে পড়ালেখার মাধ্যম ইংরেজি, কিন্তু মাতৃভাষা বা বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে নয়। বরং বলা যায় ইংরেজি মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে বিশেষগুরুত্ব দেওয়া হয়, কারন মাতৃভাষায় দক্ষতা না থাকলে শিক্ষার্থীর চিন্তা দক্ষতা বা যোগাযোগ দক্ষতার বিকাশ হয় না। সাংস্কৃতিক বিকাশও বাধাগ্রস্থ হয়। এজন্যই মাতৃভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয় , যাতে শিক্ষার্থীরা নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধারন ও লালন করতে পারে। ভাষা শুধু যোগাযোগ বা জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমই না এটি ব্যক্তিগত বা দলগত মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও মৌলিক সক্ষমতা প্রকাশের চিহ্ন বহন করে।
মাতৃভাষা রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে আই বি (প্রাইমারি ইয়ারস প্রোগ্রাম) কারিকুলাম (International Baccalaureate curriculum) গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। আই বি কারিকুলামে নিজস্ব মাতৃভাষা নীতি আছে। প্রতিটি দেশে আই বি কারিকুলাম স্কুলে মাতৃভাষাকে প্রথম প্রাধান্য দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে, নিজস্ব সংস্কৃতিকে জানার আগ্রহ বাড়াতে ও নিজের ভাষার প্রতি মমত্ববোধ তৈরিতে আই বি কারিকুলামে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই শুধুমাত্র আই বি কারিকুলামে মাতৃভাষা সংরক্ষন, উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয় এটি স্কুলের ভাষা দর্শনেরও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা যেহেতু শিক্ষকতার সাথে আব্দুল কাদির মোল্লা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে যুক্ত আছি, আমরা আমাদের স্কুলের ভাষা অনুষদ মিলে ভাষা নীতি তৈরি করেছি।
নিম্নে মাতৃভাষা সম্পর্কে নেলসন ম্যান্ডেলার একটি উক্তি যা আমাদের হৃদয় ছুয়ে যায়।
“যদি তুমি কারো সাথে তোমার ভাষায় কথা বল,তার কাছে যেতে পারবে,যদি তার ভাষায় কথা বল,তার হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারবে”। -নেলসন ম্যান্ডেলা
আই বি কারিকুলামের শিক্ষার্থীরা কেন মাতৃভাষা অনুসন্ধান করে?
> শিক্ষার্থীরা ইংরেজি একভাষিক প্রবনতা থেকে বের হয়ে আসতে চায়
> তাঁরা ভাষা বৈচিত্র্য পছন্দ করে
> তাঁরা যেকোনো নির্দেশনা সহজে বুঝতে পারে
> তাদের তৃতীয় কোন ভাষা শেখার আগ্রহ তৈরি হয় ও আয়ত্ত করা সহজ হয়। যেমনঃ আরবি, ফরাসি, স্প্যানিস ইত্যাদি
আই বি কারিকুলামের শিক্ষার্থীরা কিভাবে মাতৃভাষা অনুসন্ধান করে?
● আব্দুল কাদির মোল্লা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল কনটেন্টের (ভিডিও লিংক ও স্টোরি ওয়েভার) মাধ্যমে গল্প দেখে ও অনুধাবন করে। তারপর তাঁরা গল্প থেকে শব্দ গঠন ও বাক্য গঠন সম্পর্কে ধারনা অর্জন করে। প্রাথমিক শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা শব্দের মধ্যে থেকে স্বরচিহ্ন,যুক্তবর্ণ খুঁজে বের করে, বিরামচিহ্ন ও তিন বর্ণের শব্দ ও দুই বর্ণের শব্দ চিনতে শিখে। বাক্য তৈরি করে ও লিখতে পারে।
● গল্প বা অনুচ্ছেদ থেকে তাঁরা বিভিন্ন চরিত্র খুঁজে বের করে, গল্প বা গল্পের চরিত্র সম্পর্কে প্রতিফলন দিতে পারে, শব্দ খুঁজে বের করে ও লিখতে পারে, গল্প সংক্ষেপ বলতে পারে ও অভিনয় করে দেখাতে পারে।
● গল্প, অনুচ্ছেদ, পত্রিকা, ম্যাগাজিন পড়ার মাধ্যমে নিজের পড়ার দক্ষতা নিজে যাচাই করতে পারে এবং শিক্ষার্থীরা ভাষা শেখার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়।
● আই বি শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভাষা শেখার ক্ষেত্রে নিজেরাই লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারে। তারা ভাষা শেখার ক্ষেত্রে- শ্রবণ করা ও বলা, পড়া, লেখা, উপস্থাপনা এই চারটি ধাপে শিখন কার্যক্রমে অংশগ্রহন করে ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে থাকে।
● তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ের উপর কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ করে তাদের শ্রেণিতে এবং তাঁরা ভাষার উপর বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে ও ভাষা নিয়ে অনুসন্ধান করে।
● আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিতে ভুলে না যায় সেজন্য স্কুল থেকে তাদের মাতৃভাষা চর্চায় তাদের দেশীয় শিক্ষক নিয়োজিত করা হয়। যাতে অন্য দেশে এসেও মাতৃভাষা চর্চা অব্যাহত থাকে।
● মাতৃভাষা কিভাবে আই বি ইউনিট এর সাথে সমন্বয় করে?
আই বি কারিকুলামে ছয়টি ইউনিট আছে। প্রতিটি ইউনিট এর সাথে মাতৃভাষাকে সমন্বয় করা হয়। এই সমন্বয় বলতে শুধু ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদমূলক পাঠ বোঝায় না। এটি ভাষাগতভাবে ইউনিট এর সাথে সমন্বয় বোঝায়। যেমনঃ চিহ্ন, প্রতীক, পরিবহন ব্যবস্থা, উৎসব উৎযাপন, প্রাকৃতিক পরিবেশ, বিভিন্ন ভূমিরূপ ও তার গঠন, স্বাস্থ্যকর খাবার ও জীবনযাপন এবং এস ডি জি এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ইত্যাদি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ইউনিট এ মাতৃভাষার সাথে সমন্বয় করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়:
বর্ণ ও স্বরচিহ্ন,শব্দ, চিহ্ন প্রতীক নিয়ে মাতৃভাষার সাথে সমন্বয়ঃ
প্রাক- প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা চিহ্ন ও প্রতীক বাংলায় শেখে পাশাপাশি সংখ্যা গণনা বাংলায় শেখে। রাস্তার পাশে থাকা বিভিন্ন চিহ্ন তাঁরা পড়া ও আঁকা শেখে। যেমনঃ সামনে স্কুল, জেব্রা ক্রসিং, বিপদজনক, সামনে মোড়, ধীরে চলুন, গতিসীমা ইত্যাদি।
পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে মাতৃভাষার সাথে সমন্বয়:
প্রাথমিকে শিক্ষার্থীরা পরিবহন ব্যবস্থার ইতিহাস, বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা, বিলুপ্ত পরিবহন সম্পর্কে জানতে পারে।তারা ভিডিও লিংক অনুসরণ করে বিভিন্ন পরিবহন সম্পর্কে অনুসন্ধান করে থাকে। জল, স্থল, ও আকাশ পথের পরিবহনের নানা ধরণ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। তারা বাংলা অনুচ্ছেদ পড়ে এবং সংক্ষেপে প্রতিফলন দিতে পারে। পরিবহন সম্পর্কিত শব্দ ও বাক্য তৈরি করতে ও ছবি এঁকে প্রকাশ করতে পারে।
উৎসব ও উৎযাপন নিয়ে মাতৃভাষার সাথে সমন্বয়ঃ
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা এখানে বৈশ্বিক উৎসবের পাশাপাশি দেশীয়, গ্রামীণ উৎসব ও উৎযাপন সম্পর্কে জানতে পারে। যেমনঃ পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসব, বসন্তবরণ, গ্রামীণ মেলা , পিঠা উৎসব ইত্যাদি। এছাড়া ধর্মীয় উৎসব যেমন ইদ, পূজা, বড়দিন ,বৌদ্ধ পূর্ণিমা ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে ও প্রতিফলন দিতে পারে। এগুলি নিয়ে শ্রেণিতে ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে থাকে। তাঁরা দলগত কাজ করতে পছন্দ করে, তবে কিছু স্বতন্ত্র কাজও করে থাকে।
এছাড়া জাতীয় শিশু দিবস, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস উৎযাপন করে থাকে। বিভিন্ন উৎসবের খাবার, পোশাক, রং সম্পর্কে ধারণা লাভ করে ও প্রতিফলন দিয়ে থাকে। তারা ভিডিও লিংক অনুসরণ করে বিভিন্ন উৎসব সম্পর্কে অনুসন্ধান করে থাকে।
বিভিন্ন স্থানীয় উৎসবগুলিকে তাঁরা অন্য দেশের আই বি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাথে শেয়ার করে ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। এভাবে সাংস্কৃতিক সংযোগ স্থাপন করে থাকে।
এছাড়া স্কুলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে খুব গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়, পালন করা হয়। ইউনিট এর সাথে খুব গভীরভাবে সমন্বয় করা হয়।
পরিশেষে, এই বিজয়ের মাসে আমাদের উদাত্ত আহবান থাকবে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ভাষা শিক্ষকরা যেন আরও সৃজনশীলভাবে শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা চর্চায় আগ্রহী করে তোলে। স্কুলের পরিচালক ও একাডেমিক কার্যক্রম সংশ্লিষ্টদের প্রতি আমাদের সবিনয় আহবান থাকবে তাঁরা যেন ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক বইগুলি তাদের স্কুল লাইব্রেরিতে সংযুক্ত করে। তাহলে ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলিও মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি চর্চায় অনেক অবদান রাখবে বলে আশা করি।
।।
লেখক পরিচিতিঃ
এ এন এম মুশফিক সিদ্দিকী (শিক্ষক, বাংলা ভাষা বিভাগ, আই, বি কারিকুলাম)
রেজুয়ান চৌধুরী (প্রাইমারি গ্রেড লেভেল শিক্ষক, আই, বি কারিকুলাম)
আব্দুল কাদির মোল্লা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, নরসিংদী, ঢাকা।