সৃজনে ভাস্বর আনোয়ার শাহজাহান – কালাম আজাদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২:৪৩:১১,অপরাহ্ন ১৮ নভেম্বর ২০২২ | সংবাদটি ১৯৪৮ বার পঠিত
কালাম আজাদ:
সিলেটের সমৃদ্ধ এক জনপদ গোলাপগঞ্জ। প্রাগৈতিহাসিক যুগের শুরু থেকে এই এলাকার রয়েছে অসামান্য অবদান। এমনকি ব্রিটিশ শাসনামলের আগে ও পরেও এই এলাকার ব্যক্তিত্বরা স্বনামে উদ্ভাসিত ছিলেন; আর মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে তাঁদের রয়েছে গৌরবময় স্বর্ণোজ্জ্বল ভূমিকা। শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্মের প্রচার-প্রসার, রাজনীতি, সামাজিক Ñ সবদিক থেকেই উন্নত এই এলাকায় জন্ম হয়েছে অসংখ্য গুণী মানুষের। উঁচু-নিচু টিলা, পাহাড়বেষ্টিত সবুজ সমারোহ, প্রাকৃতিক নান্দনিকতা সুভাসিত পথের মনকাড়া সুষমা এই এলাকার আবেদনকে সমগ্র বাংলাদেশে অনন্য স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে।
গোলাপগঞ্জের কৃতীসন্তানরা শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, সব অবস্থানে থেকেই তাঁরা শেকড়ের টানে বারবার আত্মপরিচয়-আত্মোপলব্ধির খোঁজ করেছেন। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি তাঁরা প্রবাসেও রাখছেন অমলিন পদচারণ। তাঁদের এসব শেকড়বদ্ধ পদচারণ প্রবাসেও মানুষের মনে আশা জাগায়। স্বপ্ন দেখায় নতুন করে বাঁচতে। প্রবাসে থেকেও নিজ দেশের জন্য কিছু করা যায় এমনই দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন তাঁরা। এর জন্য তাঁদের সামাজিক পদমর্যাদা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তাঁরা দেশমাতৃকার বন্ধনকে বুকের ভেতর থেকে ফেলে রাখেননি। প্রবাসের কর্মব্যস্ত যুদ্ধেও যাঁরা দেশকে ভুলে যাননি, দেশের জন্য সর্বদা চিন্তা করেন, তাঁদেরই অন্যতম হলেন সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আনোয়ার শাহজাহান।
ইতোমধ্যে তাঁর প্রকাশিত ৯টি গ্রন্থই দেশের প্রণোদনাকে প্রতিভাত করে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ; এই ত্রিমাত্রিক সংযুক্তির যে মিশ্রণ তাঁর গবেষণা সাহিত্যে বিদ্যমান তথা বিষয়বস্তু, তা আমাকে খুব বেশি আপ্লুত করেছে। তাই জীবনের সত্তর দশক পেরিয়েও সেই দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করি। আনোয়ার শাহজাহান এ ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ব্যক্তিত্ব বলে পরিগণিত।
আনোয়ার শাহজাহানের জীবন বহুমাত্রিকতায় পরিপূর্ণ। একাধারে তিনি একজন লেখক, গবেষক, সংগঠক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক। তবে একজন নিষ্ঠাবান মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হিসেবে তিনি ইতোমধ্যে বোদ্ধামহলে উল্লেখযোগ্য অবস্থান সৃষ্টি করেছেন। এটি তাঁর জীবনের এক বড় অর্জন এবং পরম পাওয়া। কেননা হৃদয়ের ভেতর অযুত সম্ভাবনা ও স্বপ্ন রোপিত না থাকলে বহুমুখী ব্যস্ততায় এমন অবস্থান সৃষ্টি করা আদৌ সম্ভব নয়।
আনোয়ার শাহজাহান ঐতিহ্য-সচেতন এবং অনুসন্ধানী একজন সাংবাদিক। কেননা সাংবাদিকতায় তাঁর বহুগামী বিচরণ এবং সৃজনশীলতার অনন্য প্রকাশ মূর্তিমান সত্যকেই উন্মোচিত করছে। এ ছাড়া তাঁর বিস্তৃত কর্মজীবনে অনন্য নির্মাণ ও রচনাশৈলী সেই নিষ্ঠতারই পরিচয় বহন করে। ঐতিহ্য; সচেতনতা ও অনুসন্ধানী মনোভাব যে দেশের স্বকীয়তা-সভ্যতা-সমৃদ্ধ অতীতকেই বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা করে তোলে, তার বাস্তব দৃষ্টান্ত মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আনোয়ার শাহজাহান। বিশেষ করে, তিনি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় যে অপার দক্ষতা, সক্ষমতা, মেধা, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন, তা তাঁর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে ইতিহাস-ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে আবদ্ধ করেছে।
আনোয়ার শাহজাহানের সাংবাদিকতা ও গবেষণার প্রান্তিকতা একই মোহনায় ঘনিষ্ঠ সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে, যা তাঁর সৃষ্টিকর্ম থেকে গভীরভাবে দৃশ্যমান। মূলত ঐতিহ্য-সন্ধানী সাংবাদিকতা গবেষণার ক্ষেত্রে এক নতুন দিকের সৃষ্টি করে, এর বাস্তব উদাহরণ তাঁর অনবদ্য সাহিত্যকর্ম। তাঁর সৃষ্টিকর্মের দিকে প্রাথমিক দৃষ্টিপাত করলেই প্রতিভাত হয়, ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে তাঁর মেলবন্ধন কতটা গভীর! এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৯। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সিলেটের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা (দুই খণ্ড), সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ, গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, Monuments and Memorials of Bangladesh Liberation War: Sylhet Division এবং Gallantry award recipient freedom fighters of Sylhet
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গবেষক আনোয়ার শাহজাহানের অনন্য গবেষণাকর্ম গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি সংগ্রামে, প্রতিটি প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলের ব্যক্তিবর্গের রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা, যা অদ্যাবধি দৃশ্যমান। তা ছাড়া এই অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য একটি সমৃদ্ধ ও ঋদ্ধ চেতনার ধারক ও বাহক। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্ম-দর্শন, ভাষা আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধ সর্বোপরি দেশ নির্মাণে এই অঞ্চলের ব্যক্তিবর্গের রয়েছে অনন্য অবদান।
ইতিহাস-ঐতিহ্যের বর্ণনায় তিনি এমন পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন যে তাতে গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে নিজেকে স্বকীয়তায় উজ্জ্বল করে তুলেছেন। নিঃসন্দেহে গবেষণাটি যেকোনো এলাকার আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্য নির্মাণে প্রেরণা ও মাইলফলক হিসেবে ভ‚মিকা রাখবে। অসাধ্য পরিশ্রমলব্ধ গবেষণাটি ভবিষ্যৎ গবেষকদের জন্য রেফারেন্স হিসেবে কাজ করবে। আমি তাঁর এ গবেষণামূলক গ্রন্থ দেখে অনেক প্রীত ও অভিভূত হয়েছি।
জীবনকে কাটিয়ে দিয়েছি শিক্ষকতায়। ভাগ্যগুণে মানুষ আমাকে ‘কবি’ বলেই সম্বোধন করে। এ জন্য কবিদের প্রতি আমার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের সমাদর বিদ্যমান। তাঁদের চিন্তার মধ্যে যে মানবিক প্রেম-উদারতা, জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান, তা আমাকে নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত করে। ফারসি প্রবাদের সেই জীবনকে বোঝার আগেই অর্ধেক জীবন চলে যায়, অথচ কবি তাঁর কবি-তারুণ্যের প্রারম্ভেই সেই জীবনকে উপলব্ধি করেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতায় তা প্রকট হয়ে ধরা দেয়। এ জন্য কবিদের সাথে হার্দিক সম্পর্ক।
আনোয়ার শাহজাহান সম্পর্কে অবগত হতে গিয়ে জানতে পারি তিনিও একজন কবি। সেই নব্বইয়ের দশকের। রীতিমতো নেতৃস্থানীয়। আমার চিন্তারাজ্যে ঝড় শুরু হয়ে যায়। আনোয়ার শাহজাহানকে সেই ধ্রুব চিন্তায় বিবেচিত করার দৃঢ় অভিপ্রায় নিজের মধ্যে লক্ষ করি। জানতে পারি, তাঁর সম্পাদনায় ১৯৯৩ সালে মধ্যাহ্নের কোলাহল কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যা তাঁর জীবনের জন্য মাইলফলক ছিল। সিলেটের তৎকালীন নবীন-প্রবীণ ৫৮ জন কবির কবিতা নিয়ে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমে কবি হিসেবেও পরিপূর্ণভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে আনোয়ার শাহজাহানের।
কাব্যগ্রন্থটির মাধ্যমে কবি-সাহিত্যিকদের সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। তিনি এ কাব্যগ্রন্থে তৎকালীন সিলেটের শীর্ষপর্যায়ের কবিদের কবিতাকে সংযোজন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখন এ দুনিয়ায় নেই। কবি দিলওয়ার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। জীবিতদের মধ্যে সবাই সাহিত্য তথা স্বস্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত।
এ ছাড়া ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিলেতের দিনগুলি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ নামক গ্রন্থ। এ গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি বিপুল পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেন। অন্যদিকে বিভিন্ন সময়ে তাঁর সম্পাদনায় অনেক সাময়িকী ও সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যা থেকে তাঁর সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ও ভালোবাসা প্রকাশ পায়। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৪ সালে জাতীয় লেখক পরিষদ, ঢাকা থেকে লেখক সম্মাননা পদকে ভূষিত হন। একজন সমাজসেবক হিসেবে আনোয়ার শাহজাহানের রয়েছে অসামান্য খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তিনি সমাজের কল্যাণে কাজ করেন। ২০১৩ সালে সমাজকল্যাণমূলক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এসই ফাউন্ডেশন (ইউকে) কর্তৃক কমিউনিটি জিনিয়াস অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
যুক্তরাজ্য ভ্রমণের সুযোগ হয়নি আমার, তবে পত্রিকা-বইপুস্তক ও বন্ধুবান্ধবের জবানিতে দেশটির মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে সম্যক অবগত হয়েছি। আমার আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে বুঝেছি মানুষ সেখানে কতটা যান্ত্রিক তথা রোবটের মতো জীবন যাপন করছে। কারও আবেগ-অনুভ‚তি বোঝার মতো পরিবেশ সে দেশে নেই। উপরন্তু এক অদৃশ্য প্রেষণা সবাইকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়। খ্যাতি, যশ, টাকা-পয়সা, ক্ষমতা সর্বোপরি একটি সামাজিক স্ট্যাটাস অর্জনের পেছনে মানুষের কঠোর পরিশ্রম রীতিমতো অবাক করে দিয়েছে আমাকে।
আনোয়ার শাহজাহানের সামগ্রিক জীবনপাঠে এটিই মনে হয়েছে, তিনি এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। একজন ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তি হিসেবে অন্য সবার মতো গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেন না কিংবা সম্পদের মোহে হন্যে হয়ে বেড়ান না। বরং তাঁর জীবনকে সার্থক করে তোলার জন্য সাহিত্য-সংস্কৃতি, গবেষণা, সমাজসেবার মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন, যা তাঁর ব্যক্তিগত মহত্তে¡র পরিচায়ক।
আনোয়ার শাহজাহান একজন লেখক, গবেষক, সংগঠক, ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক হিসেবে সফল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। কেননা সবদিক সামলিয়ে তিনি নিজেকে একজন বহুমাত্রিক ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। আমি তাঁর জীবনের সার্বিক কল্যাণ কামনা করি।
লেখক পরিচিতি : বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও কবি।