বৃটিশ সৌজন্য আর সিলেটি বদান্যতা
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:২৫:৪৫,অপরাহ্ন ১৬ নভেম্বর ২০২২ | সংবাদটি ১৩৯৭ বার পঠিত
ইব্রাহীম চৌধুরী, উত্তর আমেরিকা: নভেম্বর মাসেও লন্ডনে শীতের তীব্রতা নেই। আছে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। বাংলাদেশের ঝমঝম বৃষ্টির আলাদা সৌন্দর্য আছে। কাক ভেজা বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টি। জৈষ্ট মাসে কাঁঠাল পাকা রোদের পর। অঝোর ধারায় নেমে আসা বৃষ্টির দেশের মানুষ আমরা।
লন্ডনের বৃষ্টি কেন যেন বেশ বিরক্তিকর ঠেকে। তাদের ‘ক্যাটস এন্ড ডগস’ বৃষ্টিপাতে কোথাও ভেজা কুকুর বিড়ালের দেখা নেই। বিখ্যাত ইংরেজ লেখক জনাথন সুইফট তাঁর লেখায় ‘ক্যাটস এন্ড ডগস’ ব্যবহার করেছিলেন। মুষলধারে বৃষ্টিপাত বুঝাতে ইংরেজি ভাষায় বাগধারাটি আজও উচ্চারিত হয় কিনা, তাও জানিনা। হাই স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক, পণ্ডিত স্যার বাগধারাটি শিখিয়েছিলেন যত্ন করে। বৃষ্টি ভেজা লন্ডনের সন্ধ্যায় স্যারকে স্মরণ করি।
লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবে পৌঁছার গলিপথ। বৃটিশ তরুণীটিকে ছাতা টানতে টানতে ফিসফিস বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখি। কান পেতেও লাভ হয় না। কথাটা ধরতে পারি না। পেট ও গলার ভেতর থেকে আসা ‘মিউ মিউ’ শব্দ। লাল ছাতা ধরে মেয়েটির হেঁটে যাওয়া দেখছিলাম। নিউইয়র্কে অজোর বৃষ্টিতে এমন বিরক্তি প্রকাশ করলে কেমন হতো? তরুণীটি নির্ঘাত আগে পিছে, দুইবার ‘ফা…’ বলে একটা ধ্বনি উঠাতো। আরেক তরুণ হাতের মধ্যমা আঙ্গুল ঠায় সোজা করে দেখাতো।
‘যস্মিন দেশে যদাচার’।
লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব মিলনায়ত। বসে আছেন দেশের বাইরে বাংলা সংবাদমাধ্যমের প্রসারে কাজ করা সব মহীরুহরা। মহিব চৌধুরী, সৈয়দ নাহাস পাশা, নজরুল ইসলাম বাসন, এমাদ চৌধুরী, তাইসির মাহমুদ, ফারুক আহমেদ, আনোয়ার শাহজাহান সহ বন্ধু স্বজনরা। লন্ডনের বিখ্যাত জনমত পত্রিকা এখন সৈয়দ নাহাস পাশার নেতৃত্বে চলছে। বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসে এ পত্রিকাটি একটি উজ্জ্বল নাম। ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। আমাদের মহান স্বাধীনতার লড়াই ও ভাংলাভাষীদের নানা চড়াই উতরাইয়ের সাক্ষী হয়ে আছে পত্রিকাটি। বাংলা সাংবাদিকতার বিখ্যাত লোকজন এ পত্রিকায় লিখেছেন। তিন দশক আগে এ পত্রিকা অফিসে এ বি এম মুসা, আমিনুক হক বাদশাহ, আব্দুল গফফার চৌধুরীর কথা শুনেছি। তর্ক করেছি। ঋদ্ধ হয়েছি। সে বৈঠকি আড্ডার কথা বন্ধু আব্দুস শহীদ মনে করিয়ে দিলেন। ইতিহাসের দায় থেকেই লন্ডনে জনমত কার্যালয় বাংলা সংবাদপত্র সহ সাহিত্য সংস্কৃতির লোকজনের এক অনিবার্য গন্তব্য হয়ে উঠেছে।
সংবাদপত্রের লোকজন এমনিতেই সম্পর্কের নানা বেড়াজালে বাঁধা থাকেন। লন্ডনে সংবাদপত্রের সাথে জড়িত অধিকাংশই সিলেট অঞ্চল থেকে আসা। তাঁদের হাতে শুধু লন্ডনে নয়, বাংলাদেশর বাইরে বাংলা সংবাদপত্রের উন্মেষ ও উত্থান ঘটেছে। কথাগুলো মিনমিন করে বলার চেষ্টা করলাম।
মহিব চৌধুরী নিজকে চল্লিশ বছরের যুবক দাবী করেন না। যদিও অবয়ব বিভ্রান্তে ফেলে। কথায় জৌলুস তুলেন। তাঁর সাথে আমার আগের তেমন জানাশোনা নেই। বিখ্যাত লোকজনকে জানি বললেইতো আর চেনা জানা হয় না। তাঁদের সাথে উঠবস করতে হয়। দৌড়ানোর জীবনে গুরুত্বপূর্ন লোকজনের সাথে যেমন বসাও হয় না, গুরুত্বের ধাপে তেমন উঠাও হয়না !
সতীর্থ আড্ডা দীর্ঘ হয়। মহিব চৌধুরী উঠে দাঁড়ান। ঘরে ফেরার তাড়া তাঁর। পাশের একটি কক্ষে ডাকলেন আমাকে। লন্ডনে বসে রাষ্ট্রীয় কোন গুরুত্বপূর্ন ঘটনার খবর পাচ্ছি। এমন মনে করে চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল। হাতে কাগজের মতোকিছু গুজে দিয়ে মুহিব চৌধুরী দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। হাত কচলে দেখি বেশ কিছু পাউন্ডের কাগজে মুদ্রা !
বিস্ময় কাটতে সময় লাগে না। এ হচ্ছে সিলেটি বদান্যতা। লন্ডনের প্রথম যখন গিয়েছিলাম। সেই নব্বইয়ের দশকে। যে ঘরেই যাই, সবাই পাউন্ড গুজে দিচ্ছিলেন। ষাট পেরুনো যৌবনে এ নিয়ে কথা বলি, প্রবীণ প্রবাসী শফিক চৌধুরীর সাথে। একানব্বই বছর বয়সে দূরের পথ গাড়ি চালিয়ে দেখা করতে এসেছেন। সাথে কিছু লৌকিক উপহারও নিয়ে এসেছেন। বললাম , প্রথম যখন লন্ডন আসি , তিন দশক আগে আপনি আমাকে ৫০ পাউন্ড উপহার দিয়েছিলেন!
সংশোধন করে দিয়ে বললেন, পঞ্চাশ নয় ১০০ পাউন্ড দিয়েছিলাম !
শুধু গিফট দিয়েছিলেন, এমন নয়। মনেও রেখেছেন। নব্বই পেরুনো যুবকের কাছে লজ্জ্বাই পেলাম।
যাদের জন্ম দেখেছি, এমন চাচাতো ভাই শরীফ এবং ইমাম – একই কাজ করলো। বড় ভাইকে নয়, সৌজন্যার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যই তাঁরাও পকেটে পাউন্ড গুজে দেয়ার কাজটি করলো !
শফিক চৌধুরী জানালেন, লন্ডনে এ এক পুরনো ঐতিহ্য। একসময় অনেকেই নানাপথে আসতেন, শুরুতে তাঁদের কাছে কোন অর্থ থাকতো না। সামান্য কিছু পাউন্ড , একটা শার্ট উপহার পেলে খুব কাজে লাগতো। রাজনৈতিক নেতারা আসতেন, তাদেরও সিলেটিরা হাতে গুজে কিছু ‘পন'(পাইন্ড) ধরিয়ে দিতেন।
মাওলানা ভাসানী, জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ব্রিটেনের এমন বহু ঘরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ১৯৫৮, ১৯৬৩, ১৯৬৪, ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিব ব্রিটেন সফর করেন। এমন এক সফরের কথা স্মরণ করলেন শফিক চৌধুরী। সিলেটের লোকজন এমনি করে তাঁদের প্রিয় নেতাকেও উপহার দিয়েছেন। এর জের ধরেই মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটেনে থাকা সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীরা মুজিব নগর সরকারের জন্য অর্থ পাঠিয়েছেন।
ইতিহাস বলে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা লড়ার জন্য বিলেত প্রবাসীরা ‘শেখ মুজিব ডিফেন্স ফান্ড’ গঠন করেন। চাঁদা তুলে লন্ডনের বিখ্যাত আইনজ্ঞ স্যার থমাস ওয়েলিয়ামকে তাঁরা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে পাঠিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু আগরতলা মামলা থেকে খালাস পান ও আইয়ুব খানের পতন ঘটে। সংগ্রামী জনতা তখন তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। বিলেত প্রবাসী বাঙালীরা এ উদ্যোগ না নিলে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়ত বা অন্যভাবে লেখা হতো। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি লাভের পর ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালীদের ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানাবার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের ২৬ অক্টোবর লন্ডন সফর করেন। লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে হাজারো বাঙালী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানায়। এর আগে কখনও বিদেশী কোন নেতাকে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ এই ব্রিটিশ বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে দেখেনি কেউ।
শফিক চৌধুরী বলেন, একাত্তর সালে ওসমানী সাহেব রণাঙ্গন থেকে সাহায্য চেয়ে চিঠি দিয়েছেন ব্রিটেন প্রবাসী সিলেটের লোকজনকে। এ চিঠিতে সাড়া দিয়ে সাধারণ সিলেটি লন্ডনীরা মুক্ত হস্তে তাঁদের বদান্যতা দেখিয়েছেন। শফিক চৌধুরী বলে যাচ্ছিলেন, ওসমানী তো আমাদের লন্ডনেই মারা গেলেন ! কথা বলতে বলতে হঠাতই যেন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। বললেন, আমাদের আথিতেয়তায় লন্ডনে বসে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেন, বিজয় দেখেন, দেখেন না প্রবাসীদের অবদান। এখন আর ওসমানীকেও তাঁরা মনে করেন না।
ক্ষোভের সাথে বললেন, আমাদের সাহায্যে, আশ্রয়ে থেকে সিলেটের লোকজনকে কেউ কেউ ‘লাঙ্গল টু লন্ডন’ বলে হেয় করে আনন্দ পেয়েছেন।
আজ ব্রিটেনে যে বাংলাদেশীর পরিচয়, তার ভিত্তি সাধারণ মানুষ। এখানে বাংলা সংস্কৃতি , বাংলা ভাষা তুলে ধারার কাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নেয়া কোন লোক করেননি। শান্তিনিকেতন থেকে পাশ করে আসা কেউ ব্রিটেনে এসে বাংলা সঙ্গীত শুরু করেননি। একসময় গ্রামগঞ্জ থেকে আসা লোকজন ১২/ ১৪ ঘন্ঠা কাজ করে ঘরে আসতেন। এসব লোকজনের কোন সামাজিক জীবন ছিলো না। পরিবার পরিজন ছিল না। ঘরে এসে বাউল গান, শাহ আব্দুল করিমের গান, আরকুম শাহ , শিতালং শাহ, কারী আমীর উদ্দিনের গান চর্চা করতেন নিজেদের মতো করে। এরাই ব্রিটেনে বাংলা সংস্কৃতির ভিত্তি তৈরী করে গেছেন। ব্রিটেনের মেঘলা আকাশে পথ চলতে গিয়ে এরাই বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ভাইছাব ভালা আছইননি?
বাংলাদেশের বাইরে বাংলা সংবাদমাধ্যমের বিস্তৃতি ঘটেছে। লন্ডনের বুকে শক্ত ভীত গড়ে তুলে আজ বিশ্ববাংলায় বাংলা সংবাদমাধ্যমের ব্যাপক কোলাহল। তারও গোড়াপত্তন হয়েছে সব সাধারণ সিলেটিদের অসাধারণ বদান্যতায়। এ ধারা এখনও চলমান আছে।
শফিক চৌধুরীর কথা শুনছিলাম। একজন মুহিব চৌধুরীর চেহারা চোখের সামনে ভাসছিল। বৃটিশ সৌজন্য আর সিলেটি বদান্যতার বিমিশ্র ভালোবাসা। মানুষটিকে ধন্যবাদ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। হাতে গুজে পাওয়া পাউন্ড পেয়ে এতোটাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম !
ইব্রাহীম চৌধুরী
সম্পাদক, প্রথম আলো, উত্তর আমেরিকা সংস্করণ।