ধর্ষণ প্রতিরোধে মৃত্যুদণ্ড কোনো কার্যকর পন্থা নয়- কাজী এনায়েত উল্লাহ
প্রকাশিত হয়েছে : ১:৩৪:০৬,অপরাহ্ন ১৬ অক্টোবর ২০২০ | সংবাদটি ৯১৪ বার পঠিত
সম্প্রতি বাংলাদেশে ধর্ষণের হার অধিক হারে বেড়ে গেছে। দেশজুড়ে অনেকেই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। প্রতিবাদ, সভা-সেমিনার, টক শো, মানববন্ধনের পাশাপাশি ধর্ষকের ফাঁসি দাবি করা হয়েছে। বিষয়টিকে আমলে নিয়ে সরকার দ্রুত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পরিবর্তন এনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড করেছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর বিলটিতে রাষ্ট্রপতি সইও করেছেন ইতোমধ্যে।
বিষয়টি অতি উদ্বেগের এবং সামঞ্জস্যহীন বলে মনে হয়। কেননা মৃত্যুদণ্ডের মতো কোনো সাজার বিষয়ে আইন পাস করার আগে নানা রকমভাবে যাচাই-বাছাই ও গবেষণা করা প্রয়োজন। সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আদৌ সেই অপরাধ কমাতে কতটা সক্ষম? সমাজে এর প্রতিক্রিয়া কী? এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কেউ লাভবান হবে কি না? কারও প্রতি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে ধর্ষণকে মুখ্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ কাজে লাগাবে কি না ইত্যাদি বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন ছিল।
আমাদের দেশে মানুষ হত্যার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে অনেক আগে থেকেই। তাই বলে মানুষ হত্যা কি কমেছে? প্রতিদিনই পত্রিকার পাতাজুড়ে থাকে মানুষ হত্যার খবর। তাহলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান এখানে কতটা কার্যকর? একইভাবে ধর্ষণ প্রতিরোধের উপায় না খুঁজে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান কখনোই এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা কমাতে সহায়ক হবে বলে মনে করি না।
পৃথিবীতে প্রথম মানব-মানবী সৃষ্টির পর থেকে আজ অবধি মানবজীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোর পাশাপাশি জৈবিক চাহিদাও অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। এটাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে সামাজিক অবক্ষয়, অশিক্ষা, সুশিক্ষার অভাব, পারিবারিক বন্ধনে শিথিলতা, মাদকের অবাধ বিস্তার, বেকার সমস্যা, ইন্টারনেটের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা ইত্যাদি কারণে সমাজে বিভিন্ন অনাচারের পাশাপাশি ধর্ষণের প্রবণতা বেড়েছে।
বিশ^খ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড প্রদত্ত মানুষের ‘মানসিক বিকাশ’ হচ্ছে এক বৈপ্লবিক তত্ত্ব। তিনি মানসিক বিকাশকে যৌনতার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। তাঁর মতে, মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ সর্বমোট পাঁচটি যৌনস্তরের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ হয়। এর যেকোনো একটিতে সমস্যা, বিশেষ করে অতৃপ্তি ঘটে গেলে মানুষের ব্যক্তিত্ব অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে; এবং মানুষ তখন যৌনতা ও মাদকের প্রতি আসক্ত হয়।
ফ্রয়েড তত্ত্বের আলোকে নিশ্চিন্তে বলা যায়, উপরিউক্ত সমস্যাগুলো সমাধানে মনোযোগ দিলে সমাজের যাবতীয় অনাচার সহজেই কমে আসবে। আমরা নরওয়ের দিকে তাকালে দেখি, সেখানে অপরাধ দমনের জন্য সব রকমের শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেও নেই কোনো অপরাধী। দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা থাকার কারণে ধীরে ধীরে জেলখানাগুলো ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। এসব কিছু এক দিনে গড়ে ওঠেনি। দীর্ঘ সাধনা, গবেষণা ও সচেতনতার ফলেই একটি দেশ হয়ে ওঠে শান্তির প্রতীক।
অন্যদিকে আমাদের দেশে আইন আছে, কিন্তু নেই এর সঠিক বাস্তবায়ন। আবার যেসব সংস্থা আইন বাস্তবায়নের কাজে নিয়োজিত, তারা অধিকাংশই ঘুষ-দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত। এ কারণে যখন কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়, তখন অপরাধী যদি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হন কিংবা ক্ষমতাসীন দলের মদদপুষ্ট হন, তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থের মাধ্যমে হাত করে যে সুবিধা তিনি গ্রহণ করেন, তা একজন দরিদ্র মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান খড়্গ হিসেবে পতিত হবে মূলত দরিদ্র মানুষের জীবনে।
আমাদের দেশে বরাবরই দেখা গেছে, ধনীক শ্রেণিকে সবাই সমীহ করে চলে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, তারা অর্থের বিনিময়ে সব সময়ই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিংবা সরকারি দলকে তুষ্ট করতে পারে অনায়াসে। অতীতে দেখা গেছে, ধনীক শ্রেণির কেউ খুন বা ধর্ষণ করলে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তদন্তকারী সংস্থাকে হাত করে মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করছে নতুবা ওই মামলার বাদীকে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য করেছে। একই সাথে পেশিশক্তির প্রতাপ খাটিয়ে মামলা প্রত্যাহার বা শিথিল করার ঘটনাও অহরহ চোখে পড়ে।
পক্ষান্তরে একজন দরিদ্র ব্যক্তি যখন কোনো অন্যায় সংঘটিত করে, তখন অর্থাভাবে সে কোনো সুবিধাই গ্রহণ করতে পারে না। এ কারণে যাবজ্জীবন কারাদ- কিংবা মৃত্যুদণ্ড ধনীদের চেয়ে দরিদ্রদের জীবনকে অধিক দুর্বিষহ করে তোলে। এক শ্রেণির জনগণ ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাইল আর সাথে সাথে তা আইনে পরিণত করা কোনো যুক্তিযুক্ত কাজ হতে পারে না। এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। সেই সাথে কোনোভাবে প্রভাবিত না হয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে একজন ধর্ষকের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি মোটা অঙ্কের আর্থিক জরিমানা করা যেতে পারত; এবং জরিমানার সমুদয় অর্থ ভিকটিমকে প্রদান করলে দেখা যেত, অপরাধী একদিকে আজীবন জেল খাটছেন, অন্যদিকে তাঁর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে দিলে তিনি আরও বেশি শাস্তির সম্মুখীন হতেন। ধর্ষণের ঘটনা যেভাবে মিডিয়ায় প্রচার পায়, একইভাবে এ বিষয়টিও ঠিকমতো প্রচার পেলে কেউ আর এ ধরনের অপরাধে জড়ানোর সাহস পেত না।
২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হবে। এই অর্ধশত বছরে একটি দেশকে ঠিক যতটা এগিয়ে নেয়া সম্ভব ছিল, ততটা আমরা পেরেছি কি না? দীর্ঘ এই সময়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে দুর্নীতি। সবার আগে দেশ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা জরুরি। সেই সাথে সামাজিক অবক্ষয় রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ, শিক্ষার মানোন্নয়ন, পারিবারিক সুশিক্ষার বন্ধন তৈরি, দেশ থেকে ১০০ ভাগ মাদক নির্মূল, বেকার সমস্যার সমাধান এবং তরুণ-যুবকদের মাঝে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা প্রতিরোধের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব একটি সুখী, সুন্দর ও সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা। কোনো একটি অপরাধ দমনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান কখনোই কোনো দেশের অপরাধ প্রবণতা কমাতে পারেনি এবং পারবেও না। কেননা ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, মিসর, বাহরাইন ও উত্তর কোরিয়ার মতো বেশ কয়েকটি দেশে ধর্ষণের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও সেখানে ধর্ষণ তেমন কমেনি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উদ্যোগ সমসাময়িক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে। ওনার মতো বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞাশীল ব্যক্তিত্বের প্রতি সমস্ত আস্থা থাকা সত্ত্বেও আমার ধারণা, এটা নিতান্তই সময়ের দাবি মাত্র। ওনাকেও সময় সময় অনিচ্ছাকৃত অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
কাজী এনায়েত উল্লাহ
প্রেসিডেন্ট
ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন (ডব্লিউবিও)
জেনারেল সেক্রেটারি
অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন (আয়েবা)
প্যারিস, ফ্রান্স