যাকাতের নিসাব ও বন্টনের খাত
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:৪৮:২৫,অপরাহ্ন ০৯ মে ২০২০ | সংবাদটি ২৪৯৫ বার পঠিত
‘সাদাকা (জাকাত) তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণভারাক্রান্তদের জন্য, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান, আল্লাহ সব জানেন, প্রজ্ঞাময়। (সূরা : আত তওবা : আয়াত ৬০)।
।। মুসাফির আব্দুস সালাম ।।
পবিত্র কোরআনে নামাজের নির্দেশ যেমন ৮২ বার রয়েছে, অনুরূপ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যাকাত দেওয়ার নির্দেশও ৮২ বার রয়েছে। ‘ زكاة ’ শব্দ দ্বারা ৩০ বার, ‘انفاق ’ শব্দ দ্বারা ৪৩ বার এবং ‘ صداقة ’ শব্দ দ্বারা ৯ বার। এর দ্বারা যাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।
যাকাত এর অর্থ: যাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ- বৃদ্ধি পাওয়া, পবিত্রতা, শুদ্ধতা ইত্যাদি।
শরিয়তের পরিভাষায়- জীবন যাত্রার প্রয়োজনের পর নির্দিষ্ট পরিমান সম্পদ পূর্ণ ১ বছর অতিক্রম করলে ঐ সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাই যাকাত।
(সুতরাং যাকাত দেওয়ার মাধ্যমে প্রথমত সম্পদ পবিত্রতা লাভ করবে, দ্বিতীয়ত সম্পদ বৃদ্ধি পাবে।)
যাকাত দাতার জন্য সু সংবাদ:
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ
অনুবাদ :
নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সৎকাজ করেছে, নামায প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং যাকাত দান করেছে, তাদের জন্যে তাদের পুরষ্কার তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে। তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না। ( সুরা বাকারা – ২৭৭)
যাকাত অনাদায়ে কঠিন শাস্তি:
ِ وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
অনুবাদ :
আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। (সুরা তাওবাহ -৩৪)
يَوْمَ يُحْمَىٰ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ ۖ هَـٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنتُمْ تَكْنِزُون
অনুবাদ :
সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এখন আস্বাদন কর যা তোমরা জমা করে ছিলে। ( সুরা তাওবা – ৩৫ )
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُم ۖ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ ۖ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۗ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۗ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
অনুবাদ :
আল্লাহ তাদেরকে নিজের অনুগ্রহে যা দান করেছেন তাতে যারা কৃপণতা করে এই কার্পন্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেন ধারণা না করে। বরং এটা তাদের পক্ষে একান্তই ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হবে। যাতে তারা কার্পন্য করে সে সমস্ত ধন-সম্পদকে কিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ী বানিয়ে পরানো হবে। আর আল্লাহ হচ্ছেন আসমান ও যমীনের পরম সত্ত্বাধিকারী। আর যা কিছু তোমরা কর; আল্লাহ সে সম্পর্কে জানেন।
( সুরা আল ইমরান – ১৮০)
বোখারী শরীফের হাদীস
‘আলী ইবনু আবদুল্লাহ (রহঃ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে (বিষের তীব্রতার কারণে) টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পাশ্ব কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল। ( বুখারি শরিফ – ১৩২১ )
চন্দ্র / আরবি মাস হিসাবে যাকাত দেয়া: যাকাতের ক্ষেত্রে চন্দ্র মাসের হিসাবে বছর ধরা হবে। যখনই কেউ নিছাব পরিমাণ অর্থ বা সম্পদের মালিক হবে তখন থেকেই তার যাকাতের বছর শুরু ধরতে হবে।
( ইংরেজি বা বাংলা মাস হিসাবে নয় )
যাদের উপর যাকাত ফরজ: যাদের নিসাব পরিমান সম্পদ রয়েছে এমন প্রত্যেক জ্ঞান সম্পন্ন প্রাপ্ত বয়স্ক নর নারীর উপর যাকাত ফরজ।
রূপা ৬১২গ্রাম (৫২.৫ ভরি) অথবা স্বর্ণ ৮৭ গ্রাম (৭.৫ ভরি) কিংবা সমমূল্যের অর্থ বা ব্যবসায়ের পণ্য ১ বছর মেয়াদকাল থাকা সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ।
সংক্ষেপে বলা চলে কারো নিকট ৫২.৫ তোলা রূপার সমপরিমাণ মূল্যের অর্থ যেমন রূপা বর্তমানে ১০০০ টাকা তোলা হলে তাতে ৫২.৫ তোলার দাম ৫২৫০০ টাকা। এখন যদি কারো মালিকানা যে কোন একাউন্ট এ ফিক্সডডিপজিট, সঞ্চয় সমিতি, জিবন বীমায়, শেয়ার বাজারে,কাউকে ধার দেওয়া যা ফেরৎ পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে, ব্যাবসার মাল,গুদামজাত মাল, কাঁচা মাল, অথবা দোকানের মালিক কে এডভান্স দেওয়া বাবদ, ৫২৫০০ টাকা এক বৎসর জমা থাকে আর তার ব্যাক্তিগত বা সাংসারিক ঋণ বা ব্যাবসায়িক ঋন থেকে অতিরিক্ত হয়। তাহলে তার উপর যাকাত ফরজ।
কারো ঋণ যদি যাকাত যোগ্য সম্পদের কারণে না হয় যেমন ঋণ করে জায়গা কিনলো বা গাড়ী কিনলো তাহলে তার এই ঋণ যাকাতের ক্ষেত্র বাদ দেওয়া হবে না। কারণ বাড়ী গাড়ীর জায়গার উপর যাকাত ফরজ নয়।
তেমনি ভাবে কেউ ব্যাংক থেকে লোন নিলো ১০ লক্ষ টাকা যা ১০ বছরে পরিশোধ করবে। তাহলে তার বছরে পরিশোধ যোগ্য ঋণ হলো ১ লক্ষ টাকা তাতে সে যাকাত হিসাব করার সময় এক লক্ষ টাকা ই ঋণ ধরবে ১০ লক্ষ টাকা নয়।কারণ সে এক বছরের যাকাত দিচ্ছে ১০ বছরের নয়।
যাদেরকে যাকাত দেওয়া যাবে:
۞ إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
অনুবাদ :
যাকাত হল কেবল ফকির, মিসকীন, যাকাত আদায় কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্যে-ঋণ গ্রস্থদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
( সুরা তাওবাহ – ৬০)
শতকরা ২.৫০% হারে যাকাত প্রদান করতে হয়।
অর্থাৎ ৪০ হাজার টাকায় এক হাজার টাকা ১ লক্ষ টাকায় ২৫০০ টাকা হারে হিসাব করে যাকাত আদায় করা ফরজ।
যাকাত আদায়ের সর্বোত্তম স্থান :
لِلْفُقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الْأَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُم بِسِيمَاهُمْ لَا يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا ۗ وَمَا تُنفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ
অনুবাদ :
দান ঐ সকল গরীব লোকের জন্যে যারা আল্লাহর পথে আবদ্ধ হয়ে গেছে-জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র ঘোরাফেরা করতে সক্ষম নয়। অজ্ঞ লোকেরা যাঞ্চা না করার কারণে তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে। তোমরা তাদেরকে তাদের লক্ষণ দ্বারা চিনবে। তারা মানুষের কাছে কাকুতি-মিনতি করে ভিক্ষা চায় না। তোমরা যে অর্থ ব্যয় করবে, তা আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই পরিজ্ঞাত।
( সুরা বাকারা – ২৭৩)
আমাদের হিসাব করে জেনে বুঝে যাকাত আদায় করতে হবে। আমাদের ধারণা অনুযায়ী কেউ গরীব কিন্তু খবর নিলে জানা যাবে হয়তো তার একটা ‘ডি পি এইচ’ আছে যেখানে ৫২৫০০ টাকা থেকে বেশি জমা আছে। তাহলে তাকে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হবে না।
এজন্য বর্তমান সমস্ত ওলামায়ে কিরাম দের মতামত হলো নিকটতম আত্বীয় যাদের দারিদ্রতার ব্যাপারে নিশ্চিত জানা আছে তাদের কে দেওয়ার পর যে সব মাদরাসায় লিল্লাহ্ বোডিং আছে সে সকল মাদরাসায় দিয়ে দেওয়া উত্তম যা সুরা বাকারার ২৭৩ নং আয়াতের উদ্দেশ্য।
যাকাতের অর্থ যাদের দেওয়া যায় না :
১) পিতা-মাতা (ঊর্ধ্বতন পুরুষ),
২) ছেলে-মেয়ে (অধস্তন পুরুষ),
৩) ধনী লোক (নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক),
৪) সায়্যিদ বংশের লোক (হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রকৃত বংশধর),
৫) স্বামী বা স্ত্রী কে,
৬) অমুসলিম।
পিতা-মাতা ও ছেলে-মেয়েকে দেওয়া যায় না। কারণ, তারা অসচ্ছল হলে তাদের ভরণপোষণ এই ব্যক্তির দায়িত্বে। সুতরাং এদের দিলে আসলে দেওয়াই হয় না বরং নিজের কাছেই থেকে যায়।
যাকাত ফরজ অবস্থায় মৃত্যু হলে: কারও ওপর যাকাত ফরজ অবস্থায় তার মৃত্যু হলে, প্রথমে তার সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করতে হবে। অবশিষ্ট সম্পদ যথারীতি ব্যবহৃত হবে। (জাকাত নির্দেশিকা, পৃষ্ঠা: ১২৮)।
যাকাত প্রদান কালে কেনো দুর্ঘটনা হলে: যাকাত প্রদান করতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়ভার যাকাত দাতা বা আয়োজকদের উপর বর্তাবে। যথা: কেউ আহত হলে তার চিকিৎসা ব্যায়ভার নিতে হবে।
আর কেউ নিহত হলে; অনিচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের জন্য তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হলো জনপ্রতি ১০০ উট।
লেখক: হাফিজ মাওলানা মুসাফির আব্দুস সালাম, পরিচালক, মারকাজুত তাহফিজ ইন্টা. মাদরাসা, মিরপুর শাখা।