একজন আনোয়ার শাহজাহান – শায়খ শফিকুর রহমান আল মাদানী
প্রকাশিত হয়েছে : ২:৫৬:৫৭,অপরাহ্ন ২২ নভেম্বর ২০২২ | সংবাদটি ১৪০৭ বার পঠিত
শায়খ শফিকুর রহমান আল মাদানী:
ইসলাম মানুষের সাথে মানুষের ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের জন্য অনুপ্রেরণা দেয়। মানুষের সেবা করতে এবং তার কষ্ট ও অসুবিধা দূর করার জন্য রাসুল (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন। মানবসেবা ইসলামের একটি শাখা। মুসলমান হিসেবে আমাদের কর্তব্য মানুষের দুঃখ-কষ্টে পাশে থাকা এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। আল্লাহর প্রেরিত নবি, রাসুল, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ি, তাবে তাবেয়ি, আইম্মায়ে মুজাতাহিদিন, সলফে সালিহিন, আউলিয়ায়ে কেরামসহ সময়ে সময়ে যাঁরা ইসলাম প্রচারের জন্য হিজরত করেছিলেন, তাঁরা সবাই মানবতার সেবায় নিবেদিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সিলেট অঞ্চলে অন্যতম ছিলেন শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.)। তিনি ৩৬০ জন সঙ্গীসহ সিলেটের মাটিতে ইসলাম প্রচারের জন্য সুদূর ইয়েমেন থেকে এ মাটিতে এসেছিলেন।
ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত খোদাভীরু ব্যক্তিত্ব হজরত শাহজালাল (রহ.) ছিলেন মানবতার সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। তিনি মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে অবিচল থাকতে পারেননি। কেউ কষ্ট পেয়ে কাতরাচ্ছে শুনতে পেলেই তাড়াতাড়ি চলে যেতেন তার কাছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সিলেটের হিন্দু রাজা গৌর গোবিন্দ কর্তৃক গাজী বুরহান উদ্দিনকে যখন অত্যাচার করা হচ্ছিল, ঠিক তখনই এ খবর শুনে সুদূর ইয়েমেন থেকে তিনি ছুটে আসেন সিলেটের মাটিতে। বুরহান উদ্দিনকে উদ্ধার করেন জালিমের জুলুমের কবল থেকে।
যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আনোয়ার শাহজাহান একজন নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘদিন থেকে তিনি দেশ-বিদেশে মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং সমাজের নানামুখী কল্যাণমূলক কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন। মানবতার সেবাই তাঁর জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
আনোয়ার শাহজাহানের সমস্ত পরিচয়ের বাইরেও তাঁর একটি স্বতন্ত্র পরিচয় রয়েছে; তিনি একজন মুসলিম। একজন মুসলিম হিসেবে তিনি ধর্মকর্ম পালনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। বিশেষত, কোরআনুল কারিমের শিক্ষাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তাঁর চিন্তাচেতনা ও সৃজনশীলতার বিকাশে প্রতিষ্ঠা করেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক অনলাইন প্রচারমাধ্যম জালালাবাদ টিভি। সমাজ, দেশ ও বিশ্বের কল্যাণমুখী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এ টিভিতে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘কোরআনের আঙিনায়’। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি কোরআনের শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে ভ‚মিকা পালন করছেন।
বর্তমান বিবিশ্বে প্রাজ্ঞ ইসলামি চিন্তাবিদ ও আলেমরা এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য উপস্থাপন করে থাকেন, যা থেকে উপকৃত হচ্ছেন কোরআনপ্রেমী অসংখ্য তৃষ্ণার্ত মানুষ। অসংখ্য দর্শক এই অনুষ্ঠানকে উপভোগ করার জন্য মুখিয়ে থাকেন। বিশেষ করে, পরবর্তী প্রোগ্রামের জন্য অনেকেই অপেক্ষায় থাকেন। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আনোয়ার শাহজাহানের। তিনি আপাদমস্তক একজন ধর্মানুরাগী। জালালাবাদ টিভির মাধ্যমে তিনি ইসলামের প্রচার ও প্রসারে আন্তরিকভাবে ভূমিকা পালন করছেন।
আনোয়ার শাহজাহানের বোধের জীবন থেকেই তাঁর সত্তার সাথে জুড়ে গেছে একটি গুণ- সমাজসেবা। সমাজকে নিয়ে তিনি চিন্তা করেন বলেই তাঁকে বলি সমাজচিন্তক। মানবসেবার মধ্যেই তিনি পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তি খুঁজে পান। মূলত এটিই তাঁর জীবনের ব্রত। এ জন্য তিনি প্রবাসে থেকেও সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন। নিজের অবস্থান থেকে মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দায়বোধসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব আনোয়ার শাহজাহান। ইসলাম সেই জন্য এমন ব্যক্তি হওয়ার নির্দেশ করে, যাঁরা নিজেরা না খেয়েও তাঁর অপর ভাইকে বা প্রতিবেশীকে খাবার দিতে বেশি পছন্দ করেন।
এ ক্ষেত্রে একটি হাদিস উল্লেখ করা আবশ্যক : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব কষ্টসমূহ থেকে কোনো কষ্ট দূর করবে, কিয়ামতের কষ্টসমূহ থেকে আল্লাহ তার একটি কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে দুনিয়ায় ছাড় দেবে, আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে ছাড় দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করে যায়।” (মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি)।
আনোয়ার শাহজাহান হাদিসের এই শিক্ষাকে সর্বতোভাবে লালন-ধারণ করার চেষ্টায় নিয়োজিত আছেন। এটি তাঁর বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি ও সমাজ উন্নয়নমূলক কাজ থেকে প্রতিভাত হচ্ছে।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত। আমাদের আদি পিতা আদম (আ.) এবং মা হাওয়া (আ.) থেকে আমাদের মানবকুলের বংশ বিস্তৃত। সেই হিসেবে আমরা একজন আরেকজনের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। প্রত্যেক মানুষ একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে এই সুন্দর ভুবন গড়ে তোলা সম্ভব। ইসলাম এ শিক্ষা দিয়েছে। ইসলামে মুসলমান ও বিধর্মী সবার সাথেই ভালো ব্যবহার এবং প্রয়োজনে তাদের সেবা ও উপকার করার কথা বলা হয়েছে।
ইসলামে বলা হয়েছে আর্ত ও দুঃখীর সেবায় যথাসম্ভব নিজেকে নিয়োজিত করতে। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। মহানবি (সা.) আমাদের জানিয়ে দিয়ে গেছেন কীভাবে জীবনে চলতে হবে। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেছেন, রাসুল (সা.) জীবনে কখনো কোনো সাহায্যপ্রার্থীকে না বলেননি, খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি। মানবসেবাকে তিনি নিজের জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। নবিজি (সা.) তাঁর মহৎ কার্যক্রমের মাধ্যমে সেই সময় আরব সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। মক্কার জনসাধারণ তাঁকে উপাধি দিয়েছিল ‘আল-আমিন’, যার অর্থ বিশ্বাসী।
সাংবাদিক আনোয়ার শাহজাহানও মনে করেন, একমাত্র বিশ্ব রাসুল (সা.)-এর আদর্শেই মানবজাতির শান্তি ও মুক্তি। তাঁর আদর্শ এমনই সর্বজনীন যে এই আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে ব্যক্তি যেমন দুনিয়াতেও শান্তিতে থাকতে পারে, তেমনি পরকালীন জীবনেও মুক্তির জন্য তাঁর আদর্শ ব্যতীত কোনো বিকল্প নেই। আনোয়ার শাহজাহান নিরন্তরভাবে বিশ্বনবি (সা.)-এর আদর্শ পথে চলার চেষ্টা করছেন। ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত অমায়িক ও বিনয়ী আনোয়ার শাহজাহান মানুষকে খুব সহজেই কাছে টানেন। আপন করে নেন। মানবের প্রতি তাঁর দায় অসীম বলেই যেকোনো সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।
আনোয়ার শাহজাহান একজন সফল সংগঠক। সাংগঠনিকভাবে সমাজকল্যাণে ভ‚মিকা রাখার ব্যাপারে তিনি খুব আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান। তিনি জানেন, নবিজি (সা.) হিলফুল ফুজুল নামে একটি সংগঠন করে আর্তমানবতার সেবা, অসহায়দের সাহায্য-সহযোগিতা করে আরবের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। রাসুল (সা.)-এর এই মানবসেবামূলক কাজ বিধর্মীদের কাছেও প্রশংসনীয় ছিল। তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিজে না খেয়ে গরিব-দুঃখীকে খাবার দিয়েছেন। অন্যকে সাহায্য করার জন্য নিজের প্রয়োজনকে ত্যাগ করেছেন। মহানবি (সা.) বলেন, “সালামের প্রসার ঘটাও, দরিদ্রকে খাদ্য দান করো, মানুষ যখন ঘুমন্ত, তখন ঘুম ছেড়ে সালাত আদায় করো। তাহলে নিরাপত্তা সহকারে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (তিরমিজি) এই ছিল মহানবি (সা.)-এর শিক্ষা।
আনোয়ার শাহজাহান বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে সমাজের অসহায় ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রবাসে বসেও তাঁর এমন মহতী উদ্যোগ সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্ম আনোয়ার শাহজাহানের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সমাজকল্যাণে ভ‚মিকা রাখছে। তিনি পরোপকারী ব্যক্তিত্ব। অপরের কল্যাণে তাঁর ভ‚মিকা অপরিসীম। প্রবাসে থেকেও তিনি নিজ এলাকায় স্কুল প্রতিষ্ঠা ছাড়াও সামাজিক উন্নয়নে সহযোগিতা করছেন; যার ধারাবাহিকতা এখনো চলমান।
মানবকল্যাণ এবং একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা ও সহানুভ‚তিতে রয়েছে চরম আত্মতৃপ্তি। আবার লক্ষ করুন, আল্লাহর নবি মোহাম্মদ (সা.) মানবজাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, “যারা তার প্রতিবেশীকে উপোস রেখে খায়, সে মূলত আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর আদর্শের অনুসারী নয়।” (হাকিম ও তাবারানি) এই হাদিসটি মানবজীবনের এক বিরাট শিক্ষা। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে গরিব মানুষের দিকে মানবতার দৃষ্টি নিয়ে একটু ফিরে তাকালে তা ইবাদত পালনের একটি অংশ হবে।
সাংবাদিক আনোয়ার শাহজাহানের আছে সহানুভ‚তিশীল একটি হৃদয়। এ যেন মানুষের দুঃখে তিনি ব্যথিত হন, কষ্ট পান। সুদূর প্রবাসে থাকলেও দেশের আর্তপীড়িত মানুষগুলোর কথা ভাবেন তিনি। নিজে অত্যন্ত সহজ-সরল জীবন যাপন করেন। কল্যাণমুখী দৃষ্টি ও মন নিয়ে তিনি প্রতিনিয়তই সমাজ ও দেশকে উপহার দিচ্ছেন ভালোবাসার শুভ্র গোলাপ। এ গোলাপ সুরভি ছড়াচ্ছে দীন-দুঃখীদের অন্তরে। সত্যিই তিনি রাসুল (সা.)-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত একজন আদর্শবাদী ব্যক্তিত্ব।
আনোয়ার শাহজাহান ইসলামের সুমহান আদর্শকে ধারণ করেই এসব দুঃখী ও অভাবী মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর জীবন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সত্যিকার অর্থেই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিরা সেই আলোকেই পথ চলেন, যে আলোর উৎস স্বয়ং রাব্বুল আল-আমিন। তাঁর আলো ছাড়া কেউ আলোকিত হতে পারে না। এই আলো হচ্ছে ইসলাম। শান্তির ধর্ম ইসলামের মাধ্যমেই দুনিয়ায় যেমন শান্তি লাভ সম্ভব, তেমনি পরকালেও মুক্তি ও শান্তি অর্জন সম্ভব। আনোয়ার শাহজাহান ইসলামকে ধারণ করেই তাঁর জীবনকে পরিচালিত করেন। আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিন ইসলামের জন্য তাঁর খেদমতকে কবুল করুন। আমিন।
লেখক পরিচিতি : কোরআন গবেষক এবং সাবেক মুসলিম চাপলেইন (ধর্মীয় উপদেষ্টা), এনএইচএস, ইউকে।