রবীন্দ্র গবেষক প্রবীর বিকাশ সরকারের সাথে কথোপকথন:জাহেদ জারিফ
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৩৯:১২,অপরাহ্ন ২৬ মে ২০২১ | সংবাদটি ৩৩৬৬ বার পঠিত
প্রবীর বিকাশ সরকার,দীর্ঘ দিন থেকে জাপানবাসী।প্রবাসজীবনে তিনি বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা করে যাচ্ছেন অবিরত।ঐতিহাসিকভাবে জাপানের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক তা সবারই জানা।কিন্তু প্রবীর বিকাশ সরকার সেই চেনাজানা পথে নয় বরং অনাবিষ্কৃত,অনালোচিত পথে হাটতে সিদ্ধহস্ত।তিনি কঠোর সাধনা,শ্রম,সময় ও প্রজ্ঞা খাটান গবেষণায়।তাঁর গবেষণার উপজীব্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক ইত্যাদি।তাঁর গবেষণালব্দ গ্রন্থগুলো ইতোমধ্যে ইতিহাস সচেতন পাঠকের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে।বাংলা ও জাপানি উভয় ভাষার মননশীল পাঠকের কাছে প্রবীর বিকাশ সরকার একজন রবীন্দ্র গবেষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।সংগত কারণে খ্যাতনামা এই রবীন্দ্র গবেষক বাংলাভাষী পাঠকের কাছে ব্যাপক আলোচনার দাবিদার মনে করছি।তাঁর জীবন ও সাহিত্যের নানা বিষয় আগ্রহী পাঠকদের জানান দেবেন নিউইয়র্কবাসী জাহেদ জারিফ।
জাহেদ জারিফ:কেমন আছেন?করোনাকালীণ বিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে কেমন যাচ্ছে দিনকাল?
প্রবিস:অবশ্যই ভালো নেই।চাকরী থেকে ছাঁটাই হয়েছি গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে।আজ পর্যন্ত চাকরীর সংস্থান করতে পারিনি।করোনার কারণে জাপানে প্রচুর কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে।ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে।কলকারখানায় উৎপাদন হৃাস পেয়েছে উদ্বেগজনক হারে।তবে সরকারের আর্থিক সহযোগীতা ও প্রণোদনা বেড়েই চলছে।ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে।আমি বেকার ভাতায় জীবন ধারণ করছি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য।অবসর গ্রহণের বয়সও হয়েছে,অবসর ভাতা নেয়ার ইচ্ছে।পাশাপাশি গবেষণা ও “কিশোরচিত্র”পুনরায় প্রকাশের চিন্তা করছি।শারিরীকভাবে ভালো আছি।লড়াই করে বাঁচতে হবে এটাই মূল কথা।
জাহেদ জারিফ:আপনার প্রকাশিত গ্রন্থ তালিকা জানতে চাই।
প্রবিস:আমার প্রকাশিত গ্রন্থ তালিকা যথাক্রমে-‘সেই ঘরে সুন্দর’(কাব্যগ্রন্থ/আজকাল পরিষদ,কুমিল্লা,১৯৮৪)
‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’(রাজনৈতিক ছড়া/মানচিত্র,জাপান,১৯৯৫)
‘অবাক কাণ্ড’(শিশু-কিশোর ছড়া/বাংলাদেশ শিশু একাডেমী,ঢাকা,২০০২)
‘তালা’(উপন্যাস/স্বরব্যন্জ্ঞন,ঢাকা,২০০৫)
‘জানা অজানা জাপান’(প্রবন্ধ সংকলন,১ম খন্ড/মানচিত্র,ঢাকা,২০০৮)
‘জানা অজানা জাপান’(২য় খন্ড/মানচিত্র,জাপান,২০০৯)
‘জানা অজানা জাপান’(৩য় খন্ড/অনুপ্রাণন প্রকাশন,ঢাকা,২০০১৫)
‘জানা অজানা জাপান’(হিন্দি,দেশ প্রকাশন,দিল্লি,ভারত,২০০৮)
‘জাপানের নদীনারী ফুল’(প্রবন্ধ/দশদিক,জাপান,২০০৯)
‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জাপান:শতবর্ষের সম্পর্ক’(ইতিহাস/বিবেকবার্তা,জাপান,২০১১)
‘Ravindranath Tagore:India-Japan Cooperation Perspectives’(Essay Collection/India Center Foundation,Japan,2011)
‘জাপানে গণিকা সংস্কৃতি’(প্রবন্ধ/চৈতন্য,সিলেট,২০১৫)
‘জাপানে রবীন্দ্রনাথ’(ইতিহাস সংকলন/হাতেখড়ি,ঢাকা,২০১৬)
‘রাহুল’(উপন্যাস/চৈতন্য,সিলেট,২০১৬)
‘রবীন্দ্রনাথ ও জাপান:শতবর্ষের সম্পর্ক’(প্রবন্ধ/আত্মজা পাবলিশার্স,কলকাতা,২০১৬)
‘জাপানে রবীন্দ্রনাথ’(প্রবন্ধ/বলাকা প্রকাশন,ঢাকা,২০১৭)
‘অপরাজিত’(উপন্যাস/সাহিত্য বিকাশ,ঢাকা,২০১৭)
‘জাপানি ব্যবসায়ীদের মননে রবীন্দ্রনাথ’(প্রবন্ধ/আত্মজা পাবলিশার্স,কলকাতা,২০১৮)
‘সূর্যোদয়ের দেশে সত্যজিৎ রায়’(প্রবন্ধ/আত্মজা পাবলিশার্স,কলকাতা,২০১৯)
‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’(আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথা/অনুপ্রাণন প্রকাশন,ঢাকা,২০১৯)
‘অপরাহ্নে বৃষ্টি’(উপন্যাস/অনুপ্রাণন প্রকাশন,ঢাকা,২০২০)
‘রবীন্দ্রনাথ ও জাপান:শতবর্ষের সম্পর্ক’(প্রবন্ধ/একত্রিত ৩য় খন্ড,আত্মজা পাবলিশার্স,কলকাতা,২০২০)
‘কলকাতার স্মৃতিকথা’(ভ্রমণ সাহিত্য/অনুপ্রাণন প্রকাশন,ঢাকা,২০২০)এবং ‘নিহোন গা আজিয়া অ মেজামে সাসেতা’(‘জাপান এশিয়াকে জাগ্রত করেছে’/জাপানি ভাষা,ইতিহাস,হার্ট পাবলিকেশন্স,জাপান,২০২০)
জাহেদ জারিফ:সম্প্রতি রবীন্দ্র বিষয়ক আপনার একটি গ্রন্থ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে,সে বিষয়ে আমাদেরকে কিছু বলুন?
প্রবিস:রবীন্দ্র-জাপান বিষয়ে আমার কয়েকটি গ্রন্থ আছে।তবে ঐ গ্রন্থটি রবীন্দ্র বিষয়ক নয়।প্রচ্ছদে রবীন্দ্রনাথের ছবি ব্যবহার হয়েছে মাত্র।কারণ,রবীন্দ্রনাথ জাপানসহ বিশ্বের অনেক দেশেই অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন বাঙালী ব্যক্তিত্ব।গ্রন্থটির নাম’নিহোন গা আজিয়া অ মেজামে সাসেতা’,যার অর্থ হচ্ছে,‘জাপান এশিয়াকে জাগ্রত করেছে’।গ্রন্থটি জাপানি ভাষায় লিখিত এবং ইতিহাস গবেষণামূলক।
ভারতীয়,বাঙালি এবং জাপানিরা অধিকাংশই জাপানের আধুনিক এবং সমকালীন ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহের ইতিহাস জানেন না।কারণ ,এই নিয়ে বিস্তারিত ও তৃণমূল পর্যায়ে গবেষণা হয়নি।তার জন্য নানা কারণ ও পটভূমি বিদ্যমান।কীভাবে জাপান একটি গ্রামীণ সভ্যতা থেকে দেড়শ বছর আগে আধুনিক সভ্যতায় পরিণত হল?কী করে প্রভূত পাশ্চাত্যের শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সমকক্ষ হয়ে তৎকালীন শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অন্যতম প্রধান রাশিয়াকে যুদ্ধে পরাভূত করেছিল রুশ-জাপান মহাযুদ্ধে,১৯০৪-০৫ সালে?কীভাবে এই যুদ্ধ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পরাধীন প্রায় সমগ্র এশিয়া মহাদেশকে প্রভাবিত করলো,উদ্বুদ্ধ করল,জাগ্রত করল এশিয়ার জাতিগুলোকে সেইসব ইতিহাস যথার্থভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি কোনো দেশেই।এই যুদ্ধের আগেই ১৯০২ সালে জাপানের তৎকালীন আন্তর্জাতিক মনীষী,পন্ডিত শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিন কলকাতায় যান,পরিচিত হন স্বামী বিবেকানন্দ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর,অরবিন্দ ঘোষ,ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখের সাথে।মাস দশেকের অবস্থানকালে ওকাকুরা বাংলার তরুণ সমাজের মধ্যে স্বাধীকারের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।বিপ্লবী গুপ্ত সংগঠন”অনুশীলন সমিতি”তারই উদ্যোগে গঠিত হয়েছিলো।এরপরই এশিয়ায় ঘটল এক অভাবনীয় ঘটনা।বিপুলতর রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্র জাপান রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধে জয়ী হল!যদি জাপান জয়ী হতে পারে তাহলে আমরা পারবনা কেন?এই স্বাদেশিক উপলব্ধি এবং জাগরন থেকেই এশিয়ার বিভিন্ন উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা জাপানের ভূয়সী প্রশংসায় মেতে উঠলেন,প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হলেন।এদের মধ্যে মহাচীনের জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী নেতা,পরবর্তীকালে চীনা জাতির পিতা ড.সান ইয়াৎ সেন,জেনারেল চিয়াং কাইশেক;ভারতের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,জওহরলাল নেহরু,লাল লাজপত রায়,বাল গঙ্গাধর তিলক,রাসবিহারী বসু,রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ সিং,হাজী বরকতউল্লাহ,ভিয়েতনামের ফান বোই চাও,কোরিয়ার কিম অক্কিউন,ফিলিপাইনের জোসে প্রতাসিও রিজাল,বার্মার বা মোও প্রমুখ জাপানের সাথে যোগাযোগ গড়ে তুলতে লাগলেন।কেউ কেউ পালিয়ে এসে জাপানে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করলেন।তাদের মধ্যে ড.সান ইয়াৎ সেন,রাসবিহারী বসু,হেরম্বলাল গুপ্ত,আনন্দমোহন সহায়,বা মোও,কিম অক্কিউন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।কোন, কোন জাপানি,কেন,কী লক্ষ্যে দীর্ঘবছর তাদেরকে আগলে রেখে নানাভাবে সাহায্য সহযোগীতা করলেন,কীভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পরে জাপানএশিয়াকে দখল করে প্রাচ্যভাতৃবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এশিয়ার পরাধীন দেশগুলোর স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করল বিপুল পরিমাণ জানমালের ক্ষয়ক্ষতিসহ চারটি বছরের সেইসব রক্তক্ষয়ী ঘটনাসমূহের ইতিহাস জাপান,ভারত,বাংলাদেশ,চীন,ফিলিপাইন,বার্মা,ভিয়েতনাম,ইন্দোনেশিয়া,কোরিয়ার প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানার বাইরে থেকে গেলো আজ পর্যন্ত।
এই শত বছরের ইতিহাস,বিশেষ করে,দুই বাংলার সঙ্গে জাপানের শিক্ষা,সাংস্কৃতিক,ধর্মীয়,রাজনৈতিক,বাণিজ্যিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে গভীর গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান।জাপানিরা জানেন না যে,স্বামী বিবেকানন্দ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,রাসবিহারী বসু,হেরম্বলাল গুপ্ত,নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু,টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালখ্যাত বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল এবং বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাঁরা জাপানের সঙ্গে অকাট্য সম্পর্কে সম্পর্কিত সকলেই বাঙালি!তাছাড়া,বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে জাপানের ভূমিকা,সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে জাপানের ভূমিকা যে বিগত শত বছরের জাপান-বাংলার দ্বিপাক্ষিক ভাববিনিময় সম্পর্কেরই ধারাবাহিকতা-এই অজানা দিকগুলোর উপর বর্ণিত ইতিহাসের সঙ্গে সংক্ষিপ্তাকারে ২৩০ পৃষ্ঠার উক্ত গ্রন্থে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি জাপানি বন্ধু-বান্ধব ও আমার স্ত্রীর সহযোগীতায়।এই ধরণের গ্রন্থ জাপানে এই প্রথম প্রকাশিত হয়েছে বলে অভিজ্ঞ জাপানিদের অভিমত।এমনকি,ভারত বা বাংলাদেশেও কেউ লিখেছেন বলে আমার জানা নেই।গ্রন্থটি সুদীর্ঘ সময়ের প্রত্যাশার সুফসল মনে করি।এই জন্য যে,প্রথমত,এই ইতিহাস জাপান,ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বর্তমান বন্ধুত্বকে আরো জোরদার করবে বলে আমার বিশ্বাস।জাপান সম্পর্কে অনেক মিথ্যা রটনা,মনগড়া ধারণা এবং ভিত্তিহীন”মিথ”সমূহ ভেঙ্গে যাবে।
দ্বিতীয়ত,গ্রন্থটির মাধ্যমে একজন এশিয়বাসী হিসেবে,একজন বাঙালি হিসেবে নানা ক্ষেত্রে জাপানের লাগাতার সাহায্য সহযোগীতা এবং অর্থনৈতিক অবদানের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানোর তাগিদ অনুভব করে আসছিলাম।বিগত ৩০বছর ধরে এই দেশে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা বহু তথ্য-উপাত্ত,দলিলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে এবং বিদগ্ধ জাপানিদের সান্নিধ্যে আসতে পারার সুবাদে জাপানি মানস সম্পর্কে আমার যে ধারণা ও অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে তা প্রকাশ করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছি এই গ্রন্থে,যা জাপান-বাংলার বন্ধুত্বকে অনাগত প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবে স্বমহিমায়।
জাহেদ জারিফ:মূল্যবান এই গ্রন্থটি বাংলাভাষী ও অন্যান্য ভাষাভাষী পাঠকের জন্য বাংলা বা ইংরেজীতে অনুবাদের তাগিদ অনুভব করেন না?
প্রবিস:হ্যাঁ,গুরুত্ব বিবেচনায় তা বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
জাহেদ জারিফ:আপনি নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন,আপনার কাজই কথা বলছে।জানান দিচ্ছে একজন লেখকের আত্মপরিচয়।বিষয়টি কেমন অনুভব করেন?
প্রবিস:কাজের লোক নীরবেই কাজ করেন।আপনার চারপাশের পরিবেশ আপনাকে নানাভাবে চেতনে বা অবচেতনে প্রভাবিত করবেই।জাপানিরা কথা বলেন কম,কাজ করেন বেশী।আমিও এই নীতি অনুসরণ করে চলছি।বাঙালি কথা বলে বেশী,লেখেও অখাদ্য বেশী,করেও বেশী অনর্থক কাজ।আমাদের মননশীল সাহিত্যের দিকে তাকান,সহজেই বিষয়টি বুঝতে পারবেন।এখানে গবেষণা কম হয়।মানসম্মত গবেষক এখন কতজন আছেন তা আঙুলে গোনে বলা যাবে।এতেই বুঝা যায় কেউ পরিশ্রম করতে চায় না।সস্তা জনপ্রিয়তা চায়।প্রচার চায়।উচ্চ শিক্ষার পরিধিও সীমিত হয়ে গেছে।প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক বলেন সব জায়গাতেই গবেষণা অতি সীমিত!সৃজনশীল সাহিত্য অবসরের জিনিস,কিন্তু মননশীল সাহিত্য নিত্যপাঠ্য ও জরুরী বিবেচিত না হলে আমরা পিছিয়ে যাবো।বাংলা একাডেমী,পশ্চিমবঙ্গ আকাদেমি বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ থেকে বছরে কয়টি মননশীল গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে তা আপনিও ভালো জানেন।যতবেশী পত্রিকা,ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে,যত অনলাইন নিউজ পোর্টাল আত্মপ্রকাশ করছে ততবেশী আমাদের সামগ্রীকভাবে বারোটা বাজছে,ততবেশী চিন্তা চেতনার দৈন্য উন্মোচিত হচ্ছে।
জাহেদ জারিফ:জাপানের রাজনীতি,অর্থনীতি,শিক্ষা ও সাহিত্য সম্পর্কে আপনার ভালো অভিজ্ঞতা আছে।বাংলাদেশকে সেই লেভেলে পৌছতে হলে করণীয় কী হওয়া চাই?
প্রবিস:বাংলাদেশ সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে সাম্প্রতিককালে উদ্ভাবিত ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি AI(Artificial Intelligence),3D Printing technologyএবং বিজ্ঞান ও ইনোভেশনের দিকে ধাবিত হওয়া।ইনোভেশন ছাড়া বাংলাদেশ ভবিষ্যত প্রতিযোগিতায় অস্থিত্ব সংকটে পড়বে!বর্তমান বস্তিমুখী ভোটের রাজনীতি,ধর্মীয় উন্মাদনা এবং দূর্বল শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে শিশু-কিশোর-কিশোরীকে আগামী দিনের জন্য উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা একেবারে অসম্ভব।করোনা পরবর্তী বিশ্ব হবে সম্পূর্ণরূপে প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্ব।সুতরাং সরকার,রাজনীতিবিদ ও জনগনের উচিত সেই বস্তাপচা সেকেলে রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসা।
সর্বত্র মাতৃভাষার চর্চা নিশিত করতে হবে।আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজীকেও অবহেলা করা যাবে না।জাপানসহ সব উন্নত দেশ নিজেদের মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দিয়েই দারিদ্র দূর করেছে।বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে ধাতব উন্নয়ন,মাতৃভাষা তথা মানসিক উন্নয়ন তলানিতে ঠেকেছে।দুই দশক পর জাতি ধাতব মূর্খ হয়ে পড়ে কি না এটাই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাহেদ জারিফ:ছড়া দিয়ে শুরু হলেও এখন মননশীল সাহিত্য চর্চায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।সৃজনশীল সাহিত্য থেকে কিভাবে মননশীল সাহিত্যে মনোনিবেশ করলেন?
প্রবিস:জাপানে না এলে এখনো হয়তো ছড়াই লিখতাম,লিখতাম কবিতা,গল্প ইত্যাদি।তাতে আমার খুব একটা লাভ হতো বলে মনে হয় না।জাপানে এসেই বুঝতে পেরেছি,সৃজনশীল সাহিত্য হলো অবসরের খোরাক,প্রতিদিনের নিত্য পাঠ্য নয়।মননশীল সাহিত্য চিন্তালব্ধ ও গবেষণা নির্ভর।তাতে তথ্য-উপাত্ত,ইতিহাস,মতামত,অভিমত,বিশ্লেষণ,অনুসন্ধিৎসার মাধ্যমে নানাভাবে জ্ঞান লাভ করা যায়।বৈচিত্রময় হয় জানার জগৎটা।সৃষ্টির উন্মাদনা জাগে।নানা সমস্যার সমাধান,দিকনির্দেশনা উপস্থাপনের সুযোগ পাওয়া যায়।তাছাড়া যুগের পর যুগ ধরে গবেষণালব্দ প্রবন্ধ বা গ্রন্থ জীবন্ত থাকে।সময়ের পরিবর্তনেও তার আবেদন হারায় না।এই বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেই গবেষণায় মনোনিবেশ করি।জাপান ও জাপান-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্ক নিয়ে কাজ করার তীব্র তাগিদ অনুভব করি।পাঠক সমাজে আমার লেখাগুলো গ্রহণযোগ্য হচ্ছে দেখে কাজে আনন্দও পাচ্ছি।আপনারা আমার কাজের সূত্র ধরেই আমাকে খুঁজছেন।আমার মতামত নিচ্ছেন।এগুলো আমার কাজের প্রেরণা।
জাহেদ জারিফ:জাপানে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বলুন।
প্রবিস:জাপানিদের মধ্যে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ জন্মেছিলো বিংশ শতকের প্রথমার্ধে মূলত রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে,যখন তিনি এশিয়া মহাদেশে প্রথম নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন ১৯১৩ সালে।সেই বছরই তাঁর কবিতা জাপানি ভাষায় অনুবাদ হয়।অতিদ্রুত অনূদিত হয় ‘গীতাঞ্জলি’,’ডাকঘর’প্রভৃতি।জাপানে ব্যাপক সাড়া ফেলে এই ঘটনা।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই রবীন্দ্র বুম দেখা দেয়,অনেক কাজ হয় তাকে নিয়ে।তাঁর অনেক গ্রন্থ অনূদিত হয়।১৯১৬ থেকে ১৯২৯সাল পর্যন্ত তিনি পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করেন।অনেক জাপানি কলকাতা,শান্তিনিকেতন এবং বাংলাদেশে যান বাংলা ভাষা,সাহিত্য,সংস্কৃতি,শিল্পকলা,ধর্ম,রাজনীতি,ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহী হয়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ষাটের দশকে পুনরায় রবীন্দ্র বুম দেখা দেয় জাপানে তাঁর শততম জন্মবর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে।প্রচুর অনুবাদ হয়।বাংলা ভাষার শিক্ষাকেন্দ্রও তালুর চেষ্টা করা হয়।সত্তরের দশকে জাপানে বাংলা ভাষা শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেন অধ্যাপক ড.ৎসুয়োশি নারা,ইসকান্দার আহমেদ চৌধুরী ও কল্যাণ দাশগুপ্ত।একঝাঁক তরুণ জাপানি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে রবীন্দ্রনাথ সহ অনেক বাঙালি কবি,লেখক ও সাহিত্যিকদের বিখ্যাত রচনাসমূহ অনুবাদ ও গবেষণা করেন।অনিয়মিত একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন জাপানি ভাষায়”কল্যাণী”প্রকাশিত হয়।এঁদের মধ্যে অধ্যাপক কাজুও আজুমা,মাদাম কেইকো আজুমা,অধ্যাপক ড.উসুদা মাসাইউকি,অধ্যাপক ড.নিওয়া কিয়োকো,অধ্যাপক ওনিশি মাসাইউকি,অধ্যাপক তোমিও মিজেকামি,অনুবাদক সুজুকি কিকুকো উল্লেখযোগ্য।নব্বইয়ের দশকে সুজুকি কিকুকো শুধুমাত্র বাংলাদেশের সাহিত্যভিত্তিক একটি বার্ষিক জাপানি ভাষার ম্যাগাজিন”সোকা” বা “উজান যাত্রী” প্রকাশ করেন এক যুগ।তাতে বাংলার লোকসাহিত্য,মূলধারার সাহিত্য,মুক্তিযুদ্ধ বিষয় আলোচনা ও অনুবাদ প্রকাশিত হয়।এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে।বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হলে জাপানেও বাংলা ভাষার কদর বৃদ্ধি পাবে,যদিও স্বল্প সংখ্যক জাপানি টোকিওস্থ সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করছেন।জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম NHK এর বেতারে বাংলা ভাষার সম্প্রচার হয়ে আসছে অনেক বছর ধরে।ভাষার সঙ্গে উৎপাদন ও কর্মসংস্হানের প্রশ্ন সম্পর্কযুক্ত।বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে বিদেশে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কদর বৃদ্ধি পাবে বলাই বাহুল্য।আশা করা যায় জাপানেও অদূর ভবিষ্যতে বাংলা ভাষা শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটবে।
অন্যদিকে,জাপান প্রবাসী বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গকেন্দ্রিক বাঙালির সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।দুই বাংলা মিলিয়ে ৩০হাজারেরও বেশী বাঙালি জাপানে নানাভাবে বসবাস করছেন।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই বাঙালিরা জাপানে উচ্চ শিক্ষার্থে দুই বাংলা থেকেই জাপানে আগমন ঘটে।ফিরে গিয়ে গ্রন্থাদিও লিখেছেন।বিপ্লবীরা এসেছেন,স্থায়ী হয়েছেন,তাঁদের কেউ কেউ বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন।সম্ভবত বাঙালিদের মধ্যে প্রথম বাংলা সাহিত্যের জাপানি অনুবাদ করেন রাসবিহারী বসু।যতখানি মনে পড়ে১৯৩০ সালের দিকে রবীন্দ্রনাথের “শেষের কবিতা”তাঁর এক জাপানি বন্ধুর সঙ্গে যৌথভাবে জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেন।তাছাড়া তিনি নিজে কমপক্ষে ১৪টি গ্রন্থ জাপানি ভাষায় লিখেছেন।যা এখন ক্রমাগত পুন:সংস্কার হচ্ছে।
আশির দশকের প্রথম থেকেই জাপান সরকারের পরিকল্পনাধীনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিদেশি উচ্চ শিক্ষার্থীরা জাপানে আগমন করেন,তাদের মধ্যে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরাও ছিলেন।আমি তাদেরই একজন।এভাবে বাঙালি আগমনের ফলে এখানে বাংলা ভাষায় পত্রপত্রিকা প্রকাশ ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে।ক্রমে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শাখাও গঠিত হয়।আমি ১৯৯০সালে বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান শাখা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করি।১৯৯১সালে জাপানে প্রথম মুদ্রিত বাংলা কাগজ”মানচিত্র” প্রকাশ করি।যা জাপান,বাংলাদেশ,ভারত সহ অন্যান্য দেশে বসবাসরত বাঙালি সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো।”মানচিত্র”প্রকাশের পরপরই আরো কমপক্ষে ১৮টি বাংলা কাগজ প্রকাশিত হয় এই দেশে।গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক সংগঠন “উত্তরণ”,”আড্ডা টোকিও:একটি সৃজনশীল পাঠচক্র”, “স্বরলিপি কালচারাল একাডেমি” ইত্যাদি।সেই সঙ্গে ঢাকা সহ আঞ্চলিক জেলাভিত্তিক সংগঠন।এভাবে আমাদের কবি,লেখক,সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিককর্মীরা জাপানের বাঙালি পাড়াকে মাতিয়ে রেখেছেন তিন যুগের বেশী সময় ধরে।প্রবাসী লেখক সাংবাদিকরা গড়ে তুলেছেন “বাংলাদেশ সাংবাদিক-লেখক ফোরাম জাপান”।কিন্তু বাংলা ভাষা শিক্ষার জন্য পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে একাধিকবার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা আজোবদি সম্ভব হয় নি নানা কারণে।ফলে আমাদের সন্তানেরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা ছাড়াই বেড়ে উঠছে।তবে পূর্বে যা বলেছি,বাংলাদেশের উন্নয়নের ফলে ভবিষ্যতে হয়তো বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র গড়ে উঠবে বলেই আশাবাদী।
জাহেদ জারিফ:আপনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন।মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা লোহমর্ষক বর্ণনা আপনার বইয়ে পাই।যুদ্ধকালীণ স্মরণীয় বিশেষ কোন স্মৃতি যদি জানান।
প্রবিস:১৯৭১ সালের ৮ই ডিসেম্বর ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাটি দেখতে পেয়েছিলাম পত পত করে উড়ছে রোদ ঝলোমল কুমিল্লা রেজিস্ট্রি ভবনের মাথায়।যা আমাদের বাসার সামনের পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত।পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির আনন্দ প্রত্যক্ষ্য করা সৌভাগ্যের ব্যাপার।তখন আমি ১২বছরের কিশোর।যা আমার জীবনে একটি অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।
জাহেদ জারিফ: পিতার সততা ও অর্থনৈতিক দৈন্যতা আপনার জীবনকে প্রভাবিত করেছিলো?
প্রবিস:প্রভাবিত করেছিলো।যা আমাকে ভীষণভাবে জীবনমুখী হতে শিখিয়েছে।আমার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ”অতলান্ত পিতৃস্মৃতি”তে তা আলোচনা করেছি।পদে পদে দৈন্যতা ছিলো কিন্তু আমার পিতা তাঁর আদর্শ বিচ্যুত হননি।
এই দৈন্যতাই আমাকে পরিশ্রমিক ও স্বাপ্নিক হতে শিখিয়েছে।স্বপ্নই আমাকে জাপানের সঙ্গে চিরদিনের বন্ধনে বেঁধে দিয়েছে।জাপানে এসে নিজেকে আবিষ্কার করেছি,নিজের আত্মিক শক্তি বলি আর প্রতিভাই বলি কাজে লাগাতে ক্রমাগত পরিশ্রম করেছি।স্বাধীনভাবে পরিশ্রম করে ভাগ্য বদলের ঐতিহ্যবাহী দেশ হচ্ছে জাপান।স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্বর্গরাজ্য হলো জাপান যদি যথার্থ শিক্ষা নিয়ে জাপানে আসা যায়।দৈন্যদশা ছিলো বলেই স্বপ্ন দেখেছি।দারিদ্র-দৈন্যতাই হলো স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্খার জননী।
জাহেদ জারিফ:আপনার লেখক জীবনে কাদের ভূমিকা বেশী?
প্রবিস:অবশ্যই আমার বাবা,আমার জাপানি স্ত্রী এবং কতিপয় বন্ধু।
জাহেদ জারিফ:আপনার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বলুন?
প্রবিস:আমার স্ত্রী চাকরিজীবী,একমাত্র মেয়েও চাকরি করছে।ওরা সবসময়ই আমাকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগীতা করে,একাধিকবার বাংলাদেশেও গিয়েছে।আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি আমাকে নিজের সন্তানের মতো করে ভালোবাসেন।
জাহেদ জারিফ:মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
প্রবিস:আপনাকেও ধন্যবাদ।