ইব্রাহীম চৌধুরী খোকনের সাক্ষাৎকার।জাহেদ জারিফ।
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:০৯:২১,অপরাহ্ন ১২ এপ্রিল ২০২১ | সংবাদটি ৩২৬০ বার পঠিত
ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন,এই নামটির সাথে রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, লেখক, সাংবাদিক, সমাজসেবী, সংগঠক ইত্যাদি অনেকগুলো বিশেষণ জড়িত। এগুলোর একটিকে বাদ দিয়ে প্রকৃত মানুষটিকে আবিষ্কার করা বা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঊনিশ শ আশি ও নব্বইয়ের দশকে সামরিক শাসন-বিরোধী আন্দোলনের সিলেটের মাঠ কাঁপানো প্রথম সারির কয়েকটি নামের মধ্যে তিনি একজন। সত্তরের দশকের মধ্য ভাগ থেকে আরম্ভ করে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত শুধু স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথ কাঁপানো সৈনিকই নয়, গণমানুষের প্রত্যেকটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি ছিলেন প্রথম সারির একজন অকুতোভয় সৈনিক।ইব্রাহীম চৌধুরী খোকনের জন্ম ঐতিহ্যবাহী গোলাপগঞ্জ উপজেলার ১নং বাঘা ইউনিয়নের খ্যাতিমান এক শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে। তাঁর পরিবারের অনেকেই সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পিতা এবং পিতামহ ছিলেন গোলাপগঞ্জ থানার খ্যাতিমান শিক্ষক।ইব্রাহীম চৌধুরী খোকনের প্রাথমিক শিক্ষার হাড়েখড়ি পরিবারে, দাদার কাছে। তার পরে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়, এম সি একাডেমি এবং মদনমোহন কলেজে। একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে প্রত্যেকটি শিক্ষাঙ্গনে তিনি তাঁর মেধার পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি ছাপ রেখেছেন খেলাধূলা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে।
মাধ্যমিক স্কুলে ছাত্র রাজনীতির সুযোগ না থাকায় কলেজ জীবন থেকেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হলেও তিনি বাল্যকাল থেকেই ছিলেন মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফুটাবার, তাদের জন্য নিজেকে নিবেদিত করার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হিসেবে ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে আসলেও মেহনতি মানুষের জন্য কাজ করার লক্ষ্যে দীক্ষা নেন জাসদ ছাত্রলীগে। এম সি কলেজে থাকা অবস্থায়ই ছাত্র রাজনীতির অগ্রসর এক লড়াকু সংগঠক হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করেন। পাশাপাশি সিলেটের সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানা কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতেশুরু করেন। ১৯৭৯ সালে জেলা জাসদ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং ৭৯-৮০ সালে মদনমোহন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে তিনি সিলেট থেকে জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে জাতীয় ভাবে প্রশংসা কুড়ান।
কলেজে অধ্যয়নকালীন নাট্যাভিনয়েও তাঁর হাতেখড়ি। ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) দুভাগে বিভক্ত হয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। তখন মূলত ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন ও তাঁর সহকর্মীদের হাত ধরেই সিলেটে জন্ম নেয় বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) ছাত্র সংগঠন। একই সময়ে ‘সিলেট গভর্নমেন্ট স্কুল ছাত্রাবাস রক্ষা’য় গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’। তিনি ছিলেন এ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্রথম সারির নেতা ও অন্যতম প্রধান সংগঠক।
জাহেদ জারিফ:স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলন,সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।গণমানুষের প্রত্যেক আন্দোলন সংগ্রামে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন।এসব আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণে কিভাবে উদ্বুদ্ধ হলেন?
ইব্রাহীম চৌধুরীঃ আসলে একটা ক্ষুব্ধ সময়ে আমাদের বেড়ে উঠা। সদ্য স্বাধীন দেশ। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসা মানুষের বুকে প্রত্যশার আগুন তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে। দ্রোহ আর সংগ্রাম করে সদ্য স্বাধীন দেশে সামাজিক, সাংস্কৃতিক লড়াইকে এগিয়ে নেয়ার তাড়না থেকেই জড়িয়ে পড়া। এগিয়ে যাওয়া।
জাহেদ জারিফ:কলেজ জীবন থেকেই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।রাজনীতিতে জড়াবেন এই তাড়না আগে থেকেই ছিলো?
ইব্রাহীম চৌধুরীঃ হ্যাঁ , তাড়িত হয়েছি। এই যে বললাম , সদ্য স্বাধীন দেশের তখন নতুন তাড়না । বৈষম্যহীন একটা আধুনিক সমাজ গড়ার তাগিদ। সময়টাও ভিন্ন ছিলো। আমরা অনেক কিছুতে ঝাঁপিয়ে পরতে চেয়েছিলাম। অস্থির সময়ের অস্থির প্রজন্ম !
জাহেদ জারিফ:গণমানুষের রাজনীতি করেছেন।খেলাধুলা,নাট্যাভিনয়,সাহিত্য,সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতায়ও ছিলেন সরব।পরিবার থেকে সমর্থন পেতেন?
ইব্রাহীম চৌধুরীঃ পরিবার থেকে সতর্ক করে দেয়া হতো। তখনও আমাদের পরিবারগুলো থেকে বেপরোয়া চলাচলের সুযোগ খুব একটা ছিল না। বাঁধা দেয়া হয়নি, তবে পিছুটান ছিলো। আমার শিক্ষক বাবা মনে করতেন কঠিন ও জটিল পথে চলাচল বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে। বিপদজনক হয়েছেও বহুবার। উতরে গেছি। কখনো নিছক ভাগ্যের কারনেই। ভালো কাজের প্রতি সমর্থন ছিল।
জাহেদ জারিফ:শুধু শহরকেন্দ্রিক নয়,গ্রামভিত্তিক অনেক সংগঠন করেছেন।তারুণ্যে আপনার সমাজ ভাবনা সম্পর্কে বলুন।
ইব্রাহীম চৌধুরীঃ আমি গ্রাম থেকে আসা মানুষ। আমার গ্রামের একদম প্রান্তিক লোকজনের সাথে বড় হয়েছি। আমার সাথে পাঠশালায় যে গ্রামের ছেলেটি পড়তো, সে আমার উপর ভরসা করতো। মনে করতো , তাঁর ভাগ্য পরিবর্তনের সাথে আমার এগিয়ে যাওয়া জড়িত। সব সময় এদের পাশে পেয়েছি। তাদের নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। স্থানীয় ক্লাব , সংস্থা গড়ে তুলেছি। শিকড়ের সাথে শহরমুখী শিকড় বিছিন্ন মানুষ হতে চাইনি কখনো। গ্রামে নলকূপ বসানো থেকে শুরু করে গ্রামের কর্মহীন লোকজনের কর্মসংস্থানের জন্য নিবিষ্ট থেকেছি সব সময়। সামাজিক দায় হিসেবেই এমন করেছি। জীবন তো শুধু নিজের জন্য নয় ! পরিবার , সমাজ , প্রতিবেশী – সবার জন্যই একটা দায়ের তাড়না আমার মধ্যে সব সময় কাজ করেছে।
জাহেদ জারিফ:আপনি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান।পরিবারে মুক্তিযুদ্ধে শহীদও আছেন।যুদ্ধের দামামা প্রথম কিভাবে উপলব্ধি করলেন?
ইব্রাহীম চৌধুরীঃ সত্তরের নির্বাচনে। প্রাদেশিক পরিষদ থেকে আমাদের এলাকায় প্রার্থী ছিলেন তখনকার কর্নেল(অবসরপ্রাপ্ত) ওসমানী। তাঁর মাধ্যমেই সরাসরি স্বাধীনতার কথা জানতে পারা। তাঁর সভায় প্রথম’ জয় বাংলা ‘ স্লোগান দেয়া। মরহুম জেনারেল ওসমানীর সাথে আমাদের পারিবারিক লোকজনের নিবিড় সম্পর্কের কারনেই ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা একই বাড়ি থেকে যুদ্ধ করতে গেলেন। আমার চাচা সায়েফ উদ্দিন চৌধুরী ফিরে আসেনি। জীবন দিয়ে দেশের পতাকা আনা বীর যোদ্ধা সায়েফ উদ্দিন চৌধুরী। যুদ্ধের সময় শহর থেকে আশা শরণার্থী পরিবারগুলোর প্রাথমিক আশ্রয় ছিল আমাদের বাড়ি। তাদের দেখভাল করেছি। মুক্তিযুদ্ধের দামামার মধ্য দিয়ে আমাদের বেড়ে উঠা !
জাহেদ জারিফ:দীর্ঘ রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিকতা জীবনে যখন পিছন ফিরে তাকান,স্মৃতিকাতর হোন তখন ঐসব ঘটনা প্রবাহে যে ইব্রাহিম চৌধুরী ভেসে উঠে।তাকে সফল নাকি ব্যর্থ মনে হয়?
ইব্রাহীম চৌধুরীঃ ধন্যবাদ জারিফ। সাফল্য শব্দটা খুব আপেক্ষিক। বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন, তার উপর উত্তরটা নির্ভর করে। আমার দৃষ্টিতে সাফল্য ব্যর্থতা – দু’টোই আছে। স্বাধীন বাংলাদেশে যে সমাজ আমরা নির্মান করতে চেয়েছিলাম , তা হয়নি। সমাজ পশ্চাদপদ হয়েছে। যে চেতনার জাগরণ ঘটাতে চেয়েছিলাম , সেখান থেকে দেশ সমাজ বহু দূরে – এসবকে সফল বলা যাবে না।
ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে একজন সফল মানুষ মনে করি। যে লড়াই করতে চেয়েছি, তা করে যাচ্ছি। আজও নিসংকুচে নিজের কথা নিজের মতো করে বলতে পারি। নিজের উচ্চারণে ভালোবাসা ও ঘৃণার কথা বলতে পারি। যখন যা দায়িত্ব নিয়ে করতে চেয়েছি, তাই করেছি। একজন মানুষের জীবনে এটাকে আমি চরম সাফল্য বলে মনে করি। নিজের ইচ্ছে মতো জীবনকে এগিয়ে নেয়া। আনন্দ বেদনার মধ্যে নিজের মতো অবগাহন করা। এতো সফল মানুষের চাওয়া !
জাহেদ জারিফ:জেনারেল এমএজি ওসমানীর স্নেহ ধন্য আপনি।তাকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নাকি প্রধান সেনাপতি সম্ভোধন করা উচিত।আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
ইব্রাহীম চৌধুরীঃ মহান মুক্তিযুদ্ধের সমরনায়ক মরহুম জেনারেল ওসমানী।মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি।
জাহেদ জারিফ:দৈনিক প্রথম আলোর যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘ,স্টেইটস ডিপার্টমেন্ট সহ জাতীয় ও আন্তর্জানিক বহু সংবাদ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছেন।সংগত কারণে বিভিন্ন কমিউনিটির সাফল্য ব্যর্থতা,উন্নতি অবনতি প্রত্যক্ষ করেছেন।মার্কিন মুলুকে সাহিত্য,সাংবাদিকতা,শিক্ষা,চিকিৎসা ও প্রশাসনে আমাদের অর্জন নিয়ে বলুন।
ইব্রাহীম চৌধুরীঃ আমাদের বিরাট অর্জন। বাঙ্গালীর বিস্তৃতির সাথে বাংলা ভাষার বিস্তৃতি ঘটছে। আমাদের প্রবাসে থাকা কবি সাহিত্যিকরা লিখছেন। প্রতিবছর অনেকগুলো বই বেরুচ্ছে। এসবের মধ্যে সাহিত্য ও বোধের যোগ ছাড়াও অর্থনীতির যোগ আছে। একটি সংযোগ সংস্কৃতির সময় চলছে আমাদের। আমাদের পরবর্তি প্রজন্ম দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমেরিকায় প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীরা লড়াকু হয়ে থাকেন। এ অভবাসীরাই পরের প্রজন্মের জন্য একটা কাঠামো করে যায়। আমাদের ক্ষেত্রেও তা হচ্ছে।আমাদের নতুন প্রজন্মের লোকজন সর্বক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে। সমাজ , রাজনীতি , সাহিত্য সংস্কৃতিতে আমাদের অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে খুব দ্রুতই।
জাহেদ জারিফ:মূল ধারার রাজনীতিতে আমাদের ব্যর্থতার কারণ কি?উত্তোরণেরইবা উপায় কি?
ইব্রাহীম চৌধুরীঃ আমাদের অনৈক্য অনেকাংশে দায়ী। ক্রমাগত ব্যর্থতার মধ্যে আমাদের একটা বোধদয় ঘটবে। এরমধ্যেই যোগ্য লোকজন বেরিয়ে আসবে।কেবল নিজ কমিউনিটির প্রার্থী নয় , আমেরিকার সব কমিউনিটির প্রার্থী হয়ে উঠতে হবে আমাদের প্রার্থীদের। এ নিয়ে আমাদের বেশীদিন অপেক্ষা করতে হবে না। এর মধ্যেই আমি মনে করি সাফল্য দৃশ্যমান হয়ে উঠবে।
জাহেদ জারিফ:অতিমাত্রায় স্বদেশী রাজনীতি কমিউনিটিতে বিভক্তি ও বিদ্বেষ তৈরী করছে।প্রবাসে দেশীয় রাজনীতির আদৌ কোন উপযোগীতা আছে বলে মনে করেন?
ইব্রাহীম চৌধুরীঃ প্রবাসে একদমই দেশের রাজনীতি করার কোন মানে আছে বলে আমি মনে করি না। একজন মানুষ আমেরিকায় থাকবে , আমেরিকার সমাজ নিয়ে ভাববে। এ কাজ করে যদি নিজের দেশের ভালোমন্দের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে পারে , তা ভালো। কিন্তু আমি নিজের ঘরের খবর রাখলাম না , নিজের সন্তানদের ভবিষ্যৎ যে সমাজের উপর নির্ভর করছে, তাঁর কোন খবর রাখলাম না , এ তো হয়না । এছাড়া এসব করতে গিয়ে বিদ্বেষ আর সহিংসতায় অনেককেই আমরা জড়িয়ে পরতে দেখি। এরপরও ভালো কিছু করতে পারলে , তেমন ক্ষমতা নিয়ে কেউ এগিয়ে আসতে পারলে , আমরা নিরুৎসাহিত করতে পারি না ।
জাহেদ জারিফ:আপনার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
ইব্রাহীম চৌধুরীঃ স্ত্রী সন্তান , ভাই বোন মিলে আমরা নিউইয়র্ক , নিউজার্সিতেই থাকি। আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে রাটগার্টস থেকে গ্রাজুয়েশন করে অ্যামাজনে কাজ করে। মেয়ে রাটগার্টসে যাচ্ছে এখনো।
জাহেদ জারিফ:আপনাকে ধন্যবাদ।
ইব্রাহীম চৌধুরী:আপনাকেও।