কবি আবু মকসুদের জীবন ও সাহিত্যের অনালোচিত দিক নিয়ে সাক্ষাৎকার।জাহেদ জারিফ।
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৫৭:৫৭,অপরাহ্ন ১৩ মার্চ ২০২১ | সংবাদটি ২২৫০ বার পঠিত
আবু মকসুদ। জন্ম ১৯৭০ সালে। মৌলভীবাজার জেলার কলিমাবাদে। পেশা ব্যবসা। ১৯৮৭ সাল থেকে বিলেত প্রবাসী। লেখালেখির শুরু আশির দশকের শেষভাগে। ছড়া দিয়ে শুরু। লিখেছেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ। বাংলাদেশের শীর্ষ পত্রিকাগুলো সহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কাছাড়ের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়, সাহিত্য কাগজে ছাপা হয়েছে অসংখ্য ছড়া, কবিতা, গল্প। সম্পাদনা করছেন বিলেত এবং বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত সাহিত্যের ছোট কাগজ ‘শব্দপাঠ’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৪ সাল)।
প্রকাশিত গ্রন্থ- নটার ট্রেন কটায় ছাড়ে (২০০৪ সাল), মিথ্যাবাদী রাখাল ছেলে (প্রথম প্রকাশ ২০০৫ সাল, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৮ সাল), একটি গুলি (২০০৬ সাল), দূরতর গ্রহ জীবন (২০১০ সাল), ক্রমাগত ঘুমের উনুন (২০১৩ সাল), খনিজ ভুলের কাছে জমা রাখি জলের মোহর (২০১৩ সাল), মৃত্তিকার মেঘলা ভ্রমণ (২০১৪ সাল), পাশে রেখে শুদ্ধ শিশির (২০১৫ সাল), আহত ঐতিহ্যের নদী (২০২০ সাল)। সম্পাদনা গ্রন্থ- বিলেতের ছড়া (২০০২ সাল), তৃতীয় বাংলার কবি ও কবিতা (২০০৯ সাল)।আবু মকসুদের জীবন ও সাহিত্যের নানা অজানা ও অনালোচিত দিক সাহিত্যানুরাগী পাঠকদের জানান দিতে তাঁর মুখামুখি হয়েছেন নিউইয়র্কের তরুন লেখক ও সাহিত্যিক জাহেদ জারিফ।
জাহেদ জারিফ: আপনার সাহিত্য চর্চার শুরুটা কিভাবে হলো জানতে চাই?
আবু মকসুদ: পারিবারিক আবহ ছিল বইয়ের। আমার আব্বা ছিলেন বইপ্রেমী, আম্মাকেও অবসরে বই উল্টাতে দেখেছি। আমার বড়ভাই পাঠকের পাশাপাশি লেখক ছিলেন, ছড়া লিখতেন। তাঁর লেখা ছাপা হত, ছাপার অক্ষরে তাঁর নাম দেখেই বোধহয় নিজের নামের প্রতি আগ্রহ জাগে। বড়ভাইয়ের মত নাম ছাপানোতে গিয়ে আমার লেখালেখি শুরু, অবশ্য প্রথম লেখা বড়ভাইয়ের খাতা থেকে চুরি করা।
আমার আব্বার লেখালেখির অভ্যাস ছিল, যৌবনে কবিতা লিখতেন, আব্বার যৌবন ব্রিটিশ ভারতের। তখনকার দিনে ছাপার এতো সুবিধা ছিল বলে জানা নেই, কোন লেখা ছাপা হয়েছিল কিনা তাও জানি না। তবে আমরা যখন বড় হচ্ছি তখন লিখতে দেখি নি। বড়ভাই বাসায় পুরানো কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে আব্বার লেখার খাতা পেয়ে যান, আমরা যেনে যাই আব্বা একজন লেখক। আমার দাদারও টুকটাক লেখার অভ্যাস ছিল একশ বছর আগের একটা নথির সাথে কিছু কাগজ পাওয়া গেছে সেখানে দাদার লেখা বচন এবং কবিতা পাওয়া গেছে।
জারিফ: একজন লেখক হবেন সেই ভাবনা থেকেই কি লেখালেখি শুরু করেন?
আবু মকসুদ: লেখক হওয়ার ভাবনা থেকে লেখালেখি শুরু এটা বললে ভুল বলা হবে, যখন প্রথম ছড়া ছাপা হয় বয়স দশ। দশ বছরের বালক পরবর্তীতে লেখক হবে এমন ভাবনা নিয়ে লিখবে না। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম এবং বাক্যের শেষে অন্তমিল দিতে পারার দক্ষতা লেখালেখি চালিয়ে যেতে উৎসাহ যোগায়।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে বন্ধুবান্ধবদের চোখে ভিন্নতা দেখা, আমি লিখতে পারি এটা তাদের থেকে আমাকে আলাদা করে দেয়, অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ করে দেয়। বন্ধুবান্ধবদের যেকোন সমস্যার সমাধান আমাকে দিতে হত, সেটা খেলার মাঠের হোক কিংবা বই পাঠের হোক। নিজের ইমেজ বজায় রাখার জন্য লিখতে হবে, সেই কৈশোরেই এই বোধ মনে গেঁথে গেছে। সেই বোধই হয়তো লেখকে পরিণত করেছে।
জারিফ: আমরা জানি পারিবারিকভাবে আপনি একটি অনুকূল সাহিত্য পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন।এ সম্পর্কে আমাদেরকে বলুন।
আবু মকসুদ: আগেই বলেছি আমাদের বাসা বইময় ছিল। বই পড়ার অবাধ স্বাধীনতা ছিল, পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি আউটবই পড়তে কেউ বাধা দিত না। দাদা, আব্বা, বড়ভাই ছাড়াও আমার বড়বোন, ভাইবোনদের মধ্যে সবাই লেখালেখি করতেন। আমি যখন খুব ছোট ৪/৫ বছর বয়স বড়বোনের বিয়ে হয়ে যায়, তখন বড়ভাই একমাত্র সরব লেখক। সদ্য স্বাধীন দেশে একটা পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে, পুরাতনকে ঝেড়ে ফেলে নতুন কিছু করতে চাওয়ার হাওয়া, সেই হাওয়ায় দেশের প্রতিটি পরিবার প্রভাবিত হচ্ছে। আমাদের পরিবারেও সেই হাওয়া কমবেশি অনুভূত হয়েছে।
আমাদের বেড়ে উঠা কাল জটিল ছিল না, প্রতিকূল পরিবেশ ছিল, কিন্তু এই পরিবেশ বেশিদিন স্থায়ী হয় নি।কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যায় দেশে অন্ধকার নেমে এসেছিল, সেই অন্ধকার দীর্ঘদিন পুড়িয়েছে। আমরা সেই অন্ধকারে আগুনে ফুলের চাষ করতে চেয়েছি, হাসতে চেয়েছি, বাঁচতে চেয়েছি। সব প্রচেষ্টা বিফলে যায় নি, কিছু পরিমাণে হলেও অন্ধকার বিতাড়িত হয়েছে।
জাহেদ জারিফ: বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বিলাতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার শত বছরের ইতিহাস রয়েছে। সেই সমৃদ্ধ ইতিহাসের উত্তরাধিকার ধরে রাখতে আপনারা কতটুকু সক্ষম?
আবু মকসুদ: বিলেতে বাঙালি বসতির ইতিহাস প্রায় দেড়শ বছরের। প্রথম বাঙালি থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি বাঙালি বিলেতেও দেশের প্রসার চেয়েছে। বিলেতকে দেশের মত সাজাতে চেয়েছে। নিজের সাহিত্য, সংস্কৃতিকে বিলেতের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। এখন পর্যন্ত এসব ব্যাপারে যথেষ্ট সফলতা দেখাতে পেরেছে বাঙালি। নিজেদের আলাদা জাতিস্বত্ত্বা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।
বিলেতের বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতিতে এখনো দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রাধান্য বেশি, অর্থাৎ যারা দেশ থেকে বড় হয়ে এসেছে। যারা দেশ থেকে এসেছে তাদের বুকে দেশের প্রতি আলাদা মায়া, তারা দেশের প্রতি আলাদা টান অনুভব করে। কিন্তু এই প্রজন্ম এখন বিলুপ্তির পথে, অনেকেই গত হয়েছেন,আরো ১৫/২০ বছরে এই প্রজন্ম পুরোপুরি মুছে যাবে অথবা বয়সের কারণে অক্ষম হয়ে যাবে। তৃতীয় প্রজন্মকে বাংলামুখী বলা যাবে না, যাদের জন্ম বিলেতে তারা বাপদাদার মত দেশের টান অনুভব করবে না, করছেও না। তাদের কাছে বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশের মত, ছুটিছাটায় হয়তো যাওয়া যাবে কিন্তু একলা নির্জনে দেশ রোমন্থন করে চোখের পানি ফেলবে না।
এখন পর্যন্ত বিলেতে বাংলা বেশ ভালভাবেই আছে, দাপটে আছে কিন্তু তৃতীয় প্রজন্মের সময় কেমন থাকবে বলা যাচ্ছে না। তবে আশাহত হওয়ার কিছু নেই রক্তে বাঙালিয়ানা থাকলে কিছু পরিমাণ পাগলামি থাকবে, সাহিত্য সংস্কৃতি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হবে না এমন আশা রাখা যায়।
জাহেদ জারিফ: বাংলা সাহিত্যের প্রচার ও প্রসারে প্রবাসী সাহিত্যিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।আপনার অভিমত কি?
আবু মকসুদ: বাংলা সাহিত্য প্রচার ও প্রসারে প্রবাসীদের আলাদা ভূমিকা কেন রাখতে হবে? সাহিত্য কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। আমরা সবাই বাংলা ভাষার লেখক, বাংলা সাহিত্যের লেখক। অবস্থানগত কারণে কেউ হয়তো মূল ভূখণ্ডের বাইরে থাকতে পারে, তাই বলে তাকে আলাদা করার কোন যুক্তি নেই।
প্রত্যেক লেখক যার যার অবস্থান থেকে সাহিত্য চর্চা করে যাবে। যার যার অবস্থান থেকে প্রচার এবং প্রসারে ভূমিকা রাখবে।
যদিও প্রাসঙ্গিক নয় তবু বলি দেশের বাইরে যারা লেখালেখি করে তারা কিছু মাত্রায় হীনমন্যতায় ভোগে। মূল ভূখণ্ডের স্বীকৃতি তাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠে, যদিও এর কোন প্রয়োজন নেই। নিজের যোগ্যতা থাকলে স্বীকৃতি কোন ব্যাপার না, স্বীকৃতি কারো দান বা দয়া না। লেখকের কাজ লেখা এবং নিজের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা। লেখক কারো মূল্যায়নের ধার না ধরে লিখে যাবেন। মূল ভূখণ্ডের কে প্রশংসা করলো, পিঠ চাপড়ে দিল এটা প্রকৃতি লেখকের চাওয়া হতে পারে না, এতে নিজকে ছোট করা হয়, নিজের অবমূল্যায়ন করা হয়।
প্রবাসী অনেক লেখক মূল ভূখণ্ডের ভাল লেখকের চেয়ে ভাল লিখেন, দেশি লেখা প্রবাসী লেখা বিভাজন ঠিক না, এতে সামগ্রিক সাহিত্যের ক্ষতি হয়।
জাহেদ জারিফ: মরণোত্তর পদক বা মূল্যায়নের সমালোচনা ও প্রশংসা দুটিই আছে। মরণোত্তর পদক বা মূল্যায়ন বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাই।
আবু মকসুদ: ‘জীবনে যারে তুমি দাও নি মালা, মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল’! এ প্রশ্ন আমারও।
মরণোত্তর মূল্যায়ন মৃত ব্যক্তির সাথে তামাশা, মরণোত্তরে আমি আগ্রহী নই। যদি কাউকে আমাদের ভাল লাগে, কেউ যদি আমার বোধে সামান্য ঢেউ তুলতে পারে আমি তাকে জানাবো। তাকে পছন্দ করি জানতে দেরী কিংবা দ্বিধা করবো কেন?
ভালোলাগা জানাতে যদি মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে সেই ভাললাগা মেকী, প্রকৃত নয়।
যে মরে গেছে সে কবরে শান্তিতে ঘুমাক, তাকে অহেতুক যন্ত্রণা দেয়া উচিৎ না। যে এখনো জীবিত সে জানুক কেউ তাকে ভালবাসে, সে জানুক সে কারো হৃদয়ে আছে। তার হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ হোক, সে বেঁচে থাকতে দেখুক মূল্যায়িত হয়েছে। সে জেনে যাক তার প্রচেষ্টা বিফলে যায় নি। মৃত্যুর পূর্বে সে মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হোক।
জাহেদ জারিফ: প্রবাসী সাহিত্যিকরা যোগ্যতানুসারে দেশে যথোপযুক্ত মূল্যায়ন পাচ্ছেন বলে মনে হয়?
আবু মকসুদ: আমি তা মনে করি না, আগেই বলেছি লেখক কারো মূল্যায়নের তোয়াক্কা করে না। ঈশ্বর, আল্লাহ, সৃষ্টি প্রত্যেক মানুষের জন্য মান, সম্মান, যোগ্যতা, মূল্যায়ন নির্ধারণ করে রেখেছে। তার জন্য নির্ধারিত মূল্যায়নের চেয়ে বেশি কিছু সে পাবে না।
দেশের কেউ দ্বারা আমি কেন মূল্যায়িত হবো? যে মূল্যায়ন করবে তার যোগ্যতা কতটুকু? নিজের লেখালেখি নিয়ে আস্থা থাকলে কোন মূল্যায়নের চিন্তা মাথায় ভর করবে না। স্বীকৃতি লেখায় মিলবে কারো স্বীকার অস্বীকারে না। মূল ভূখণ্ডের বাইরে থেকে যারা লেখালেখি করে তাদের হীনমন্যতা ত্যাগ করে নিজের প্রতি আস্থাশীল হতে হবে। পদক, পুরষ্কার কোন মূল্যায়ন না এতে সাহিত্যের ক্ষতিবৃদ্ধি হয়, পদক পুরষ্কারকে মূল্যায়নের পিছু ধরা বোকামি হবে।
জাহেদ জারিফ: পাঠকের কাছে একজন সাহিত্যিকের ধর্ম ও রাজনৈতিক দর্শন নাকি তাঁর সৃষ্টিশীলতা কোনটি বিবেচ্য হওয়া উচিত মনে করেন?
আবু মকসুদ: আমি নিজে পাঠক হিসাবে লেখকের লেখাকেই পড়বো, লেখককে নয়। লেখার সাথে লেখককে খুঁজতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে হতাশ হতে হবে। ব্যক্তি জীবনে একজন লেখক দ্বিমুখী হতে পারে তার নিজস্ব দর্শন, ধর্ম বিশ্বাস তার লেখার সাথে সাংঘর্ষিক পারে তার। হয়তো ব্যক্তি জীবনে লেখক এমন না, এমন হলে তাকে গ্রহনে কিছু দ্বিধা থেকে যাবে তবু লেখকের ব্যক্তিজীবন আমার পাঠ্য নয়, তার পরিবেশন পাঠ্য।
তবে যদি লেখক পাঠকের মতানুসারী হয়, সেটা বাড়তি পাওয়া। সর্বক্ষেত্রে লেখক পাঠক সংযোগ হয় না, পাঠকের তা আশা করা বোকামি।
যদিও লেখকের কিছুমাত্রায় সামাজিক দায়িত্ববোধ থাকে, যেহেতু লেখক প্রভাবিত করতে পারে। লেখক নিজের দায়িত্ব শুভ বোধের দ্বারা পরিচালিত করবে, মানুষের সাথে থাকার চেষ্টা করবে। মানুষ বিমুখ লেখক টিকে না, তার লেখা সর্বজনগ্রাহ্য হয় না।
লেখক নিজের কাছে বিশ্বস্ত থাকবে, বাজার ভাওয়ে বিকোবে না। লেখকের মুখ উজ্জ্বল, প্রস্ফুটিত থাকবে। মুখোশ লেখকের জন্য নয়, যা বিশ্বাস করে লেখক তা অপকটে বলবে। যদিও মানুষে দ্বৈতসত্ত্বা অস্বাভাবিক নয় কিন্তু লেখক কে দ্বৈতসত্ত্বা মুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। একজন লেখককে মানবিক হতে হবে। একজন লেখককে ধার্মিক হতে কোন বাধা নেই, ঈশ্বর অবিশ্বাসী হতেও বাধা নেই। তবে কোন ভাবেই মানবিকতা বোধ বিসর্জন দিতে পারবে না, মানবিকতা বর্জিত লেখক পরিত্যাজ্য।
জাহেদ জারিফ: একজন সাহিত্যিকের সাহিত্য জীবনে প্রশংসা ও নিন্দা দুটোই থাকে। একজন পাঠক আবু মকসুদ হিসেবে লেখক আবু মকসুদের সমালোচনা করুন?
আবু মকসুদ: প্রশংসা এবং নিন্দা জমজ, পাশাপাশি থাকে। যে লেখক প্রশংসিত হয় না সে যথেষ্ট পরিমাণ প্রভাবিত করতে পারছে না, আবার যে লেখক নিন্দিত হচ্ছে না সে মৃত লেখক। পাঠক নাড়া দিতে হলে প্রশংসা নিন্দা দুটোর মাধ্যমেই নাড়া দিতে হবে। একজন লেখক দুটোর জন্য তৈরি থাকবেন।
আবু মকসুদের সমালোচনায় বলা যায় তিনি অতিমূল্যায়িত। আবু মকসুদ যা নয় বন্ধু মহলে তার চেয়েও বেশি আলোচিত। তার লেখায় নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, নতুন চিন্তা তার লেখায় নেই বললেই চলে।
তবু আবু মকসুদের চেষ্টার প্রশংসা না করে পারা যায় না, হচ্ছে না জেনেও চেষ্টার কমতি করছে না। আবু মকসুদ লেগে থাকছে, এই লেগে থাকা একদিন তাকে নিশ্চয়ই লেখক বানাবে। লেগে থাকাকে সম্মান জানানো যায়।
জাহেদ জারিফ: লেখক আবু মকসুদ হয়ে ওঠার পিছনে কাদের প্রতি আপনার সাহিত্য ঋণ আছে?
আবু মকসুদ: প্রত্যেক লেখকের হয়ে ওঠার পিছনে কিছু কারণ, কিছু অনুসঙ্গ, কিছু প্রভাব থাকে। আমার কারণ বড়ভাইয়ের মত ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখা। বড়ভাই আবদুল হামিদ মাহবুব যদি লেখালেখি না করতেন তাহলে হয়তো আমি এই সাক্ষাতকারের উপযোগী হতাম না। দাদা এবং আব্বাও লিখতেন কিন্তু আমি যখন শুরু করি জানতাম না আমার রক্তে লেখক প্রবাহিত হচ্ছে। যখন জানতে পারি উৎসাহ বেড়ে যায়, আমার লেখালেখিতে তাদের প্রভাবও অস্বীকার করতে পারি না।
বড়ভাইয়ের দেখাদেখি আমার শুরু ছড়া দিয়ে, কবিতায় আসতে অনেক দেরী করে ফেলি। তবে আতাউর রহমান মিলাদ যদি এতো বেশি না আওড়াতাম আমার কবিতায় আসা হতো না, আমার কবিতার জন্য দায়ী কবি আতাউর রহমান মিলাদ। সাহিত্য নিয়ে আহমদ ময়েজের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা বাহাস করেছি, কবিতা হওয়া না হওয়া নিয়ে যুক্তি দিয়েছি, তর্ক করেছি। পদ্যে ন্যূনতম কবিতার আভাস পেলে আহমদ ময়েজ সযতনে আগলে রাখতেন, আহমদ ময়েজের সাহচর্য আমাকে কবিতার পথে হাঁটতে সাহস যুগিয়েছে। ফকির ইলিয়াস প্রথম কবি যিনি আমার এলেবেলে লেখাকে কবিতার মর্যাদা দিয়েছেন, কবিতার ঘর গৃহস্থালির তাঁর প্রভাবে অনেকটা আয়ত্ত্ব করতে পেরেছি। আমার গ্রন্থ গুলো তার ছোঁয়ায় বিশুদ্ধ হয়েছে। অঙ্গসৌষ্ঠব থেকে শুরু করে নামকরণ পর্যন্ত কবি ফকির ইলিয়াস সাথে থেকেছেন, তাঁর পরামর্শে গ্রন্থ পূর্ণাঙ্গ হতে পেরেছে।
আমার লেখায় কিছু প্রভাব আকমল হোসেন নিপু যোগ করেছেন। মুজিব ইরম, সুমন সুপান্থ, সৈয়দ রুম্মানকে এখনো এড়ানো যায় না। তবে গত কয়েক বছর থেকে কবি আসাদ মান্নান জেঁকে বসেছেন, দীর্ঘদিন পরেও ঘাড় থেকে নামবেন বলে মনে হচ্ছে না। দুই সহোদর সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল আর শিহাব শাহরিয়ার আমাকে কবিতার প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছেন।
কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু আমার জীবনের এক অধ্যায়, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অধ্যায়। একদিন আমিও কবরস্থ হবো কিন্তু মঞ্জু থেকে বিস্মৃত হতে পারবো না। আমার জীবনে এমন প্রভাববিস্তারকারী আর কেউ আসে নি, আসবেও না।
ছড়ার হাতেখড়ি বড়ভাইয়ের মাধ্যমে, তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য ছড়াকারও আমাকে কমবেশি প্রভাবিত করেছেন দিলু নাসের তাদের অন্যতম। শাহাদাত করিম, রব্বানী চৌধুরী, শহীদ সাগ্নিক এরা ছড়ায় পথ প্রদর্শনকারী। জাতীয় পর্যায়ে সুকুমার বড়ুয়া, রফিকুল হক, আলী ইমাম, লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম, ফারুক নওয়াজ আমাকে প্রচুর পরিমাণে প্রভাবিত করেছেন। অনুজ ছড়াকারদের মধ্যে রেজুয়ান মারুফ, তাকে আমি ঈর্ষা করি। সৈয়দ হিলাল সাইফ আরেকজন ছড়াকার যার মত ছড়া আমি লিখতে চাই।
জাহেদ জারিফ: আপনার ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে বলুন?
আবু মকসুদ: ব্যক্তি আমি সম্পূর্ণ পরাধীন ন্যূনতম স্বাধীনতা নেই। চল্লিশ পেরুনোর পরেই আমার পায়ে বেড়ি পড়ানো হয়েছে। আমার চশমার পুরুত্ব বেড়েছে কিন্তু সাধ আহ্লাদ চিকন হয়ে গেছে। আমার স্ত্রী সম্পূর্ণরূপে আমাকে বশীভূত করে ফেলেছেন। তার কথার বাইরে চলা মুশকিল। চায়ের চিনি তিনি নির্ধারণ করেন, ঘুমাবার পূর্বে চিরতার রস পান করতে বাধ্য করেন। তেলেভাজা কোন সাধ আমার থাকতে পারবে না, তার মর্জি হলে মিষ্টান্ন কিছু জুটতে পারে।
আমি দুয়েকদিন বিদ্রোহী হওয়ার চেষ্টা করেছি সফল হই নি, কারণ ছেলে মেয়ে দুটো মায়ের জোটের। মায়ের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা তাদের পক্ষে সম্ভব না।
আমার উপর এতো শাসনের কারণ স্ত্রী চান না, স্বামী অকালে ঝরে যাক, বিধাতা বাংলা সাহিত্যের বিশাল দায়িত্ব তার স্বামীর স্কন্ধে দিয়েছেন তাড়াতাড়ি বিদায় নিলে দায়িত্ব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
আমার মেয়ে আইনের স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে একটা আইন ফার্মে আইন উপদেষ্টার কাজ করছে। ছেলেও আইন পড়ছে, অনার্স প্রথমবর্ষ। স্ত্রী ঘরের কর্তী ছেলে মেয়েকে সাথে নিয়ে আমাকে শাসন করেন।
আমি সম্পূর্ণ পরাধীন তবু অসুখী নই, ল্যাপটপের চাবিতে আঙুল চালানোর সময় যখন স্ত্রী চিনিযুক্ত চা নিয়ে হাজির হন মনে সুখের পায়রা উড়ে।
জাহেদ জারিফ: আপনাকে ধন্যবাদ।আপনার সুকুমারবৃত্তির সফলতা কামনা করছি।
আবু মকসুদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।