অনুমোদনহীন হাসপাতাল কিভাবে করোনা চিকিৎনায় যুক্ত হলো?
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:১০:০৩,অপরাহ্ন ০৮ জুলাই ২০২০ | সংবাদটি ১২৩১ বার পঠিত
আহমেদ মোস্তফা, ঢাকা থেকে:: রিজেন্ট হাসপাতাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে যুক্ত হয় গত ২১ মার্চ। অথচ হাসপাতালটির অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৪ সালেই। পরে আর সেটা নবায়ন করা হয়নি। অনুমোদনহীন একটা হাসপাতাল করোনা ভাইরাসের মতো সময়ে কী করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
করোনা পরীক্ষার ভুয়া সনদের তথ্যে রাজধানীর উত্তরা ও মিরপুরে রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে অনেকটা কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। উঠে আসে ভয়ঙ্কর জালিয়াতির তথ্য।
মালিক শাহেদ পালিয়ে গেলেও গ্রেফতার করা হয় হাসপাতালের আট জনকে। র্যাব বলছে, এত কিছুর পরও কীভাবে হাসপাতালটি সনদ নিয়েছে বোধগম্য নয়। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।
এদিকে, বুধবার (৮ জুলাই) রিজেন্ট হাসপাতালের ৮ আসামির ৭ জনের রিমান্ড ৫ দিনের মঞ্জুর করেছেন আদালত। এছাড়া মঙ্গলবার উত্তরায় রিজেন্ট হাসপাতালের প্রধান কার্যালয় সিলগালা করার পর গতকাল মিরপুর শাখাও সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। দু‘টি হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। হাসপাতালটির মালিক রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহেদকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। র্যাব বলছে, তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এমএলএম ব্যবসার প্রতারণার দায়ে আগেও গ্রেফতার হয়েছিলেন শাহেদ। তার নামে বিভিন্ন থানায় অন্তত ৩২টি মামলা রয়েছে।
রিজেন্টের চেয়ারম্যান শাহেদের বিষয়ে র্যাব সদর দফতরের লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জানান, গণমাধ্যমে তার নানা অপকর্মের কথা জানতে পেরেছি। বিভিন্ন সময় তিনি প্রতারণার দায়ে আটক হয়েছিলেন, জেলও খেটেছেন। মিথ্যাকে কেন্দ্র করেই তার উত্থান। ভুয়া পরিচয় দিয়ে নানাভাবে প্রতারণা করেছেন মানুষের সঙ্গে। সে একটা এমএলএম কোম্পানি খুলে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল, যার জন্য জেলও খেটেছে। আমরা জানতে পারছি তার আরও অনেক নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে লাইসেন্সও নেয়া হয়নি। প্রতিদিন নানা জায়গা থেকে অসংখ্য ফোন রিসিভ করছি, তারা শাহেদের অপকর্ম-অরাজকতার বিষয়ে জানাচ্ছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তোলাকে কেন্দ্র করেই তিনি প্রতারণা করতেন। প্রতারণার জন্যই ছবিগুলো তুলেছে বলে তদন্তে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। প্রতারকদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। শাহেদ সব সময়ই মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে আসছিলেন, আসলে তার কোনো পরিচয় নেই।
বুধবার দুপুরে র্যাব সদর দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম বলেন, করোনার নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার নামে প্রতারণা করায় রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. শাহেদকে খুঁজছে র্যাব। র্যাব ছাড়াও অন্যান্য বাহিনী সতর্ক থাকায় তিনি দেশ ছেড়ে পালাতে পারবেন না। শিগগিরই তাকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, দুই রাত ধরেই তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন জায়গায় আমরা খোঁজ করছি। বলে রাখতে চাই, সে অবশ্যই ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়। কারণ কেউ ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়। যারাই আইনের ঊর্ধ্বে যাওয়ার চেষ্টা করবে অবশ্যই তাকে আমরা আইনের আওতায় আনতে সক্ষম। তার বিষয়ে অন্যান্য সংস্থাও সতর্ক।
লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক বলেন, রিজেন্টের প্রতারণায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত আরও ৯ জনকে আসামি করে নিয়মিত মামলা হয়েছে। মামলার প্রধান আসামি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শাহেদ পলাতক। অভিযানের পরই সে গা ঢাকা দিয়েছে। মঙ্গলবার (৭ জুলাই) রাতেও আমরা বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়েছি। শাহেদের মোবাইল নম্বর বন্ধ। প্রথম দিন দেখেছিলাম ফেসবুকে অ্যাক্টিভ ছিলেন, কিন্তু এখন তিনি সবকিছু থেকেই নিষ্ক্রিয়। তবে আশা করছি দ্রুত তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হবো। এক প্রশ্নের জবাবে অচিরেই প্রতারক শাহেদকে গ্রেফতারের সুখবর দিতে পারবেন আশা প্রকাশ করে র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, তিনি অবশ্যই ধরাছোঁয়ার বাইরে নন। কারণ কেউ ধরাছোঁয়ার বাইরে নন।
করোনাকে ঘিরে আমরা নানা অপতৎপরতা দেখেছি। বিভিন্ন ভুক্তভোগীর মাধ্যমে জানতে পারি, কিছু হাসপাতাল করোনা টেস্টকে ঘিরে নৈরাজ্য শুরু করেছে। ব্যক্তি পর্যায় থেকেই অনুসন্ধানের কাজ শুরু করেছিলাম। রিজেন্ট হাসপাতাল হোম ডেলিভারির মতো বাসায় গিয়ে করোনার নমুনা সংগ্রহ করে দ্রুততার সঙ্গে রিপোর্ট সরবরাহ করছিল।
প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে আমরা গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছি। এরপর কেঁচো খুঁড়তে সাপ নয়, এনাকোন্ডা বের করে আনতে সক্ষম হই। দুদিন ধরে রিজেন্টের বিরুদ্ধে আমরা ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করছি। তাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, তারা নমুনা নিয়ে টেস্টের সঠিক রিপোর্ট পাঠায় না। প্রায় সাড়ে চার হাজার নমুনার টেস্ট না করেই কম্পিউটার অপারেটর মনগড়া রিপোর্ট দিয়ে সরবরাহ করেছে। ফলে বুঝে না বুঝে অনেকেই ভুয়া পজিটিভ হয়ে কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন। তারা প্রথমবার টেস্টে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা নিতেন পরবর্তী টেস্টের জন্য আবার এক থেকে দেড় হাজার টাকা আদায় করতেন।
সরকারের সঙ্গে বিনামূল্যে চিকিৎসার চুক্তি স্বাক্ষরের নামে আসলে হঠকারিতা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তারা রোগীদের মোটা অঙ্কের বিল দিতে বাধ্য করেছে। পাঁচ সদস্যের একটি পরিবার গত ২০ দিনে দুই লাখ ৭০ হাজার টাকা রিজেন্টের কর্মচারী পলাশকে দিয়েছে বলে জানতে পেরেছি। রিজেন্ট হাসপাতাল ১০ হাজার টেস্ট করেছে। এর মধ্যে সাড়ে চার হাজার টেস্টের কাগজ আমাদের হাতে রয়েছে, যা সরকারের কোনো সংস্থা এ ধরনের রিপোর্ট তৈরি করেনি বলে জানতে পেরেছি।
রিজেন্টের কম্পিউটার অপারেটর আমাদের বলেছে, চেয়ারম্যান নিজে ব্যক্তিগতভাবে এসব করিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি তিন মাসে প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা নিয়েছে। সেসব টাকা কোথায় গেছে তা খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হবে।