সোশ্যাল মিডিয়া, বিকল্প গণমাধ্যম এবং ঝুঁকি…
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৩৫:২০,অপরাহ্ন ০৩ জুলাই ২০১৯ | সংবাদটি ৩৮৭ বার পঠিত
।অনুপম মাহমুদ।
সাদাকালো নিউজপ্রিন্ট কাগজের সংবাদপত্র, রেডিওনির্ভর খবরের জন্য এক সময় আমরা সারাদিন অপেক্ষা করতাম। এখনো স্পষ্ট মনে আছে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকা শুনবার জন্য সন্ধ্যা এবং রাতে চায়ের দোকান কিংবা পাড়ার মোড়ে জটলা বাঁধত, তখন বিটিভি ছাড়া বিকল্প কোনো টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না! ক্যাবল টেলিভিশন তো সেদিন এলো! ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের খবর শুনতে পাবনা জেলার ইশ্বরদিতে বহু মানুষ জড়ো হতো জনৈক কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে। পরবর্তী সময়ে সেই ব্যস্ত বাজার পরিচিতি পায় ‘বিবিসি বাজার’ নামে।
ইলেকট্রনিক মিডিয়া আসবার পর অনেকেই বলেছিলেন, প্রিন্ট মিডিয়ার যুগ শেষ! তবে সময়ের অতি মূল্য, পেশাদারিত্ব এবং দক্ষতার অভাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রিন্ট মিডিয়ার টুটি চেপে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়া অনুসন্ধিৎসু রিপোর্ট লিখতে পারলে আমরা এখনো মনোযোগ দিয়েই সংবাদপত্র পড়ি।
তবে ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং প্রিন্ট মিডিয়া এখন যতটা না সংবাদমাধ্যম, তার চেয়েও বেশি কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠিত করপোরেট হাউজের মুখপাত্র বা উইং, হাতিয়ার বলতে রুচিতে বাধছে। তাই ক্রমেই সংবাদ তার আবেদন হারাচ্ছে আর দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন প্রাতিষ্ঠনিক সংবাদ থেকে। ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া এখন বিনোদন নির্ভর। আর কোনো ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনায় যেভাবে লাইভ টেলিকাস্ট করা হয় তা রীতিমতো দৃষ্টিকটু!
ক্রমেই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার খবর তার আবেদন হারাচ্ছে। তাছাড়া একই নিউজ কপি পেস্ট করে ব্যাঙয়ের ছাতার মতো পোর্টালে এখন অনলাইন ভরপুর। মানহীন এই সব নিউজের সূত্র কিংবা উৎস নিয়ে পাঠকের অজ্ঞতা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এমনকি প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া হাউজের নামে বেনামে রয়েছে ক্লোন ওয়েবসাইট, যা রীতিমতো বেআইনি। তাদের উদ্দেশ্য যে ইতিবাচক নয়, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকবার কারণ নেই।
তারচেয়ে সোশ্যাল মিডিয়া এখন হয়ে উঠেছে বিকল্প সংবাদমাধ্যম! তবে সমস্যা হচ্ছে এই মিডিয়ায় সূত্র কেউ তলিয়ে দেখছি না। যেকোনো ঘটনাই খবরের আদলে তথ্য ক্রমেই দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে গণজাগরণ মঞ্চ, কোটা প্রথা সংস্কার, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণেই বেগবান হয়েছে। তবে এই সুযোগে গুজব ছড়িয়ে অনেকেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী এবং মডেল অভিনেত্রী জেলে গিয়েছেন পর্যন্ত।
মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের ছোঁয়ায় বেশ কয়েকটি দেশে রাষ্ট্র প্রধানের পতন হয়েছে। ফ্রান্সে তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ইয়েলো ভেস্ট মুভমেন্ট গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে। হংকংয়ে আম্ব্রেলা মুভমেন্ট, থাইল্যান্ডে ইয়েলো টি শার্ট মুভমেন্ট আর ভারতে অগণিত সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে সম্প্রতি। তবে গুজবের জন্য খোদ ভারতেই অঘটন ঘটেই চলেছে। কখনো ছেলেধরা, কখনো গো মাংস বিক্রেতা বলে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মানুষ হত্যার খবর এখন ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ারই শিরোনাম।
এই সুযোগে একদল প্রতারক বিভিন্ন মাধ্যম, বিশেষত ইউটিউবে চটকদার কনটেন্ট বানিয়ে নিমিষেই লক্ষ লক্ষ ভিউ পেয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। বেশিরভাগ কন্টেন্ট নোংরা, কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল এবং অবশ্যই জনমনে সন্দেহ আছে এমন ইস্যুই তাদের টার্গেট। নির্মাতাদের অনেকেই এই ক্ষেত্রে নিজের পরিচয় গোপন রাখছেন!
চলমান বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সি নিয়ে জনমনে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় উঠে এবং এই নিয়ে বিসিবি প্রধান ব্যাখ্যা দিতে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। এমনকি জাতীয় সংসদে পর্যন্ত আলোচনা হয়েছে। অবশেষে বিপুল জনমতের চাপে পরিবর্তন হয়েছে জাতীয় দলের জার্সি।
ঈদের ঠিক আগে দেশের শীর্ষ একটি বুটিক শোরুমে অতিরিক্ত মূল্যে পণ্য বিক্রি করায় তাদের একটি আউটলেট বন্ধ এবং জরিমানা করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অভিযান পরিচালনাকারীকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়! অথচ ঈদের ছুটি তখন শুরু হয়ে গিয়েছিল আর সরকারি কর্মঘণ্টার বাইরে তখন রাত। সোশ্যাল মিডিয়া এই বদলিও রুখে দেয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে সেই সরকারি কর্মকর্তাকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন, এটা কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার একটা বিরাট অর্জন।
উপরোক্ত দুটি ঘটনা ভীষণ সাম্প্রতিক আর দুই ক্ষেত্রেই সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর জনদাবি জয়ী হয়েছে। তাই সোশ্যাল মিডিয়াকে পাশ কাটানোর সুযোগ এখন নেই বললেই চলে।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক বিশ্বাস, আঞ্চলিকতাভিত্তিক অগণিত ক্লোজ গ্রুপ আছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, যা প্রকাশ্য কিংবা পাবলিক নয়। এই গ্রুপে নিজের মনোভাবের লোকজন সম্পৃক্ত হচ্ছেন এবং নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান করছেন নির্বিঘেœ। এই সবকিছু গ্রুপ (সকল গ্রুপ অবশ্যিক নয়) আমার কাছে হীরক রাজার দেশের সেই মগজ ধোলাই কক্ষ্যের মতোই মনে হয়। খুব দ্রুত এই সব গ্রুপেই ছড়িয়ে যেতে পারে উদ্দেশ্যমূলক গুজব আর ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। বরগুনায় ০০৭ (জেমস বন্ড এর সাংকেতিক চিহ্ন) গ্রুপের কিছু চ্যাট ইতিমধ্যেই ফাঁস হয়েছে। যেখানে একটা বিষয় স্পষ্ট, রিফাতকে খুন করা হয়েছিল পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে! আর সহায়ক হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া!
সত্যি বলতে কি, সোশ্যাল মিডিয়ার অগণিত ইতিবাচক দিক আছে। দূর-দূরান্তে কত মানুষ আছে যাদের খুব সহজেই আমরা কাছে পাচ্ছি। কত কম খরচে এবং ঝক্কি ঝামেলা ছাড়াই দেখিতেও পাচ্ছি মুঠোফোনের স্ক্রিনে। এই কিছুদিন আগেও শহরের অলিতে গলিতে উচ্চমূল্যের টেলিফোনের দোকান ছিল দেশে কিংবা বিদেশে কথা বলবার জন্য। পকেটের টাকা শেষ হলেও মন ভরতো না, বরং এক বুক কষ্ট নিয়ে আমরা ঘরে ফিরতাম।
আলফ্রেড নোবেল যুদ্ধ কিংবা অকল্যাণ কামনা করে ডিনামাইট আবিষ্কার করেননি। একজন কামার আগুনে পুড়িয়ে ঘামে ভিজে হাতুড়ি পিটিয়ে এই উদ্দেশ্যে দা বানায়নি যে কেউ একজন সেই দা দিয়ে দিনে দুপুরে কোনো মানব সন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করবে! তবে কখনো কখনো তাই হয়, যা আমরা চাই না।
মধ্যপ্রাচ্যে এমনকি বাংলাদেশেও আন্দোলন ঠেকাতে সোশ্যাল মিডিয়ার গতি হ্রাস কিংবা কখনো কখনো সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। এতে আন্দোলন হয়তো গতি হারিয়েছে তবে রাষ্ট্র এবং সরকার তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে ন্যাক্কারজনকভাবে। আর এই সুযোগে আরও ব্যাপকতা পেয়েছে গুজবের গতি! তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের এই যুগে আপনি বন্ধ করে রুখতে পারবেন না সোশ্যাল মিডিয়া! বিকল্প পথে প্রযুক্তির ব্যবহার জানে এই প্রজন্ম!
ইলেন্ট্রনিক্স এবং প্রিন্ট মিডিয়াসহ রাষ্ট্রকে নিতে হবে এর দায়। প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের নিজেদেরও আগে সচেতন হতে হবে, তা না হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবো আমরাই, আর এই ক্ষতি স্পর্শ করবে গোটা সমাজকে।
লেখক: অধিকার কর্মী