রমযানের শেষ দশদিন ঈদ প্রস্তুতির জন্য নয়
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:০৬:৩৪,অপরাহ্ন ২৬ মে ২০১৯ | সংবাদটি ১১৬১ বার পঠিত
:মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেক:
আমাদের একটি শ্রেণী-মাশাআল্লাহ- রোযা রাখেন কিন্তু রমযানের শেষ দশকে তারাবী ছেড়ে ঈদ শপিংয়ের চক্করে ফেঁসে যান। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, রমযানে দিবসের করণীয় হল রোযা আর রাতের করণীয় তারাবী ও তাহাজ্জুদ। তারাবী হল সুন্নতে মুয়াক্কাদা। এ থেকে বঞ্চিত থাকার অর্থ হল হাফেযের মুখ থেকে কুরআন মজীদ শ্রবণ করা থেকে বঞ্চিত থাকা। এটা কত বড় ক্ষতিগ্রস্ততা!
কিছু মানুষ এমনও আছেন যারা মাশাআল্লাহ রোযার সঙ্গে তারাবীরও পাবন্দী করেন এবং তারাবীতে খতমও করে থাকেন, কিন্তু তারা পনেরো বা বিশ রমযানের মধ্যেই খতম শেষ করে দেন এবং শেষ দশকে শুধু সূরা তারাবী পড়ে থাকেন, জামাতের সঙ্গে কিংবা একা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কুরআন খতম থেকে আগে ফারেগ হওয়ার উদ্দেশ্য থাকে বাইরে যাওয়া আসায় সুবিধা সৃষ্টি করা। অথচ গোটা রমযানের মধ্যে শেষ দশকের ফযীলতই সবচেয়ে বেশি। এজন্যই এতে ইতিকাফ এবং লায়লাতুল কদর তালাশ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সালাফে সালেহীন রমযানের প্রথম বিশ দিনের তুলনায় শেষ দশকে নামায, তেলাওয়াত এবং অন্যান্য ইবাদতে অনেক বেশি মেহনত করতেন। এজন্য শেষ দশকের রাতগুলো খুব বেশি করে আবাদ রাখা কর্তব্য। এই বরকতময় রাতগুলো কোনোভাবেই মার্কেটিংয়ের পিছনে নষ্ট করা উচিত নয়।
এর উপর যখন নারীরা নির্লজ্জ বেপর্দা হয়ে মার্কেটগুলো দখল করে বসে আছে তখন পুরুষরা যদি তাদের ঈমানকে রক্ষা করার জন্য এবং দৃষ্টির হেফাযতের জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়ে মার্কেটে ঘোরাঘুরি বর্জন করেন তাহলে কী অসুবিধা?
এখানে একটা বড় ভুল ধারণা এই যে, অধিকাংশ মানুষ ঈদের দিনের জন্য নতুন পোশাক পরিধান করা এবং অন্যদের পরিধান করানো বা হাদিয়া দেওয়াকে ঈদের অপরিহার্য অংশ মনে করে অথচ এই কথাটা একদম গোড়া থেকেই সঠিক নয় যে, ঈদের জন্য নতুন কাপড় মাসনূন; বরং দলীল দ্বারা শুধু এটুকু প্রমাণ হয় যে, নিজের কাছে বিদ্যমান কাপড়গুলোর মধ্যে উত্তম ও পরিষ্কার কাপড়টি পরিধান করবে।
كَانَ ابْنُ عُمَرَ يَلْبَسُ فِيْ الْعِيْدَيْنِ أَحْسَنَ ثِيَابِهِ
এক প্রস্থ উত্তম কাপড় বানিয়ে কিংবা ক্রয় করে তা জুমআ ও ঈদে পরিধান করাতে কোনো অসুবিধা নেই। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে একটি উত্তম পোশাক ছিল যা তিনি জুমআ, ঈদে কিংবা বিভিন্ন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাত করার সময় পরিধান করতেন। -আসসুনানুল কুবরা বায়হাকী ৩/২৮০-২৮১; যাদুল মাআদ ১/৪২৫
মোটকথা, পরিষ্কার ধোয়া কাপড় যা বিদ্যমান কাপড়গুলোর মধ্যে যে কাপড়টি সবচেয়ে উত্তম তা ঈদের দিন পরিধান করা কাম্য। যদি ঘটনাক্রমে তা নতুনও হয় তাহলেও অসুবিধা নেই, কিন্তু প্রত্যেক ঈদের জন্য নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করাকে মাসনূন মনে করা একদম ঠিক নয় এবং এর ওপর শরীয়তের কোনো দলীলও বিদ্যমান নেই।
মুসলমানদের আর্থিক স্বচ্ছলতার যুগ অতীত হয়েছে (যখন তাদের দ্বীন ও ঈমানের হালতও বর্তমানের চেয়ে হাজার গুণ ভালো ছিল) কিন্তু ইতিহাস থেকে এটা প্রমাণ করা যায় না যে, তাদের কাছে রমযান ও ঈদুল ফিতর বিশেষ ব্যবসা-বাণিজ্যের মওসুম ছিল, যেখানে ঈদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ-আয়োজন থাকত। এখন তো বিষয়টি শুধু কাপড়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, নতুন কাপড়ের সঙ্গে চাই নতুন জুতো, মহিলাদের সাজসজ্জার সকল উপকরণ নতুন হওয়া চাই, বাচ্চাদের জন্যও সবকিছু নতুন হওয়া চাই। ঘরের আসবাবপত্র নতুন হওয়া চাই। পুরানো শুধু একটি বস্ত্তই, তা হচ্ছে ঈমান ও আমল। একে উন্নত ও নতুন করার কোনোই আয়োজন নেই। বলাবাহুল্য, মুসলিম সমাজের এটা এক দুর্ভাগ্যজনক চিত্র, যার নজির বিগত শতাব্দীগুলোতে পাওয়া যাবে না।
কেউ বলতে পারেন যে, ইসলামে জায়েয সাজসজ্জাকে বৈধ রাখা হয়েছে এবং ঈদের সময় তা পছন্দনীয়ও বটে? অবশ্যই পছন্দনীয় তবে একে সীমার মধ্যে রাখা হলে। মুবাহ সাজসজ্জার মধ্যেও বাড়াবাড়ি করা নিষেধ। এরপর এখানে আলোচনা শুধু সাজসজ্জা সম্পর্কেই নয়; বরং এতে সীমালঙ্ঘন করে রমযানের সবচেয়ে বরকতময় সময়গুলোকে বিনষ্ট করা সম্পর্কেও। প্রশ্ন এই যে, শরীয়তে এই প্রান্তিকতাও কি কাম্য ও পছন্দনীয়, নাউযুবিল্লাহ?! এরপর মুবাহ ও বৈধ সাজসজ্জাকে বাহানা বানিয়ে যারা অবৈধ সাজসজ্জার পেছনে পড়ে যায় তাদের কথা তো ভিন্নই!
মোটকথা, রমযনের শেষ দশক নিজেকে এবং নিজেদের পরিবার-পরিজনকে অন্যান্য ঝামেলা থেকে মুক্ত করে ইবাদতে নিমগ্ন করা উচিত। নফল নামায, তেলাওয়াত, যিকর ও দুআ ইত্যাদিতে মশগুল হওয়া কর্তব্য। নিজেও ইতিকাফ করার চেষ্টা করবে এবং ঘরের অন্যান্য লোকদেরকেও ইতিকাফের সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। মহিলাদেরকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করবে। একই বছর সবার পক্ষে সম্ভব না হলে পালাক্রমে করার চেষ্টা করবে। আর দুই তিন দিনের নফল ইতিকাফ তো প্রতি রমযানে প্রত্যেকেই করতে পারেন।
আমাদের মনে রাখা উচিত যে, রমযানের শেষ দিনগুলো ঈদ-উদযাপনের প্রস্ত্ততি গ্রহণের জন্য নয়; বরং ঈমান ও আমলের তরক্কীর জন্য। আমরা যদি আমাদের কর্মের মাধ্যমে এর বিপরীত কিছু প্রমাণ করি তাহলে সেটা হবে ইসলামের অত্যন্ত ভুল রূপায়ন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাযত করুন ও সাহায্য করুন। আমীন।