রাণাপিং আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের ইতিহাস বিকৃতি:প্রাসঙ্গিক জবাব
প্রকাশিত হয়েছে : ২:৩৩:২৩,অপরাহ্ন ২৫ মে ২০২০ | সংবাদটি ১১৮৫ বার পঠিত
ডা.আক্তার হোসেনঃ
রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ গোলাপগঞ্জ ইউনিয়নের একমাত্র মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যাপীঠ। এই ইউনিয়নাধীন এলাকাটি মোঘল আমলে প্রশাসনিক ইউনিট রাণাপিং পরগণা নিয়েই গঠিত। সে হিসেবে বর্তমান গোলাপগঞ্জ এবং রাণাপিং নাম দুটি একে অপরের পরিপূরক। এই ইউনিয়নের ৮ টি প্রাইমারি স্কুল। এই স্কুলগুলোর ছাত্রছাত্রীদের প্রাইমারি পরীক্ষা পাশ করে হয় যেতে হতো এম সি একাডেমিতে নতুবা ঢাকাউত্তর মোহাম্মদপুর হাইস্কুলে। রণকেলী গার্ল্স পৌরসভা গঠিত হবার আগে এই ইউনিয়নাধীন হলেও দূরত্ব্রের কারণে ছাত্রীরা এই স্কুলেও যেতেন না। সে হিসেবে এর মধ্যবর্তী অঞ্চলে মাদ্রাসা ছাড়া আর তৃতীয় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলনা। ফলে দূর থেকে পায়ে হেঁটে শিক্ষার্থীদেরকে মূলত এই দুটি বিদ্যালয়েই বিদ্যার্জনের জন্য যেতে হতো। অদম্য ইচ্ছা শক্তির ছাত্রছাত্রী ছাড়া মূলত যাতায়াত বিড়ম্বনার কারণে তখনকার বেশির ভাগ শিক্ষার্থীদেরকে প্রাথমিক শিক্ষার পর লেখাপড়ার ইতি টানতে হতো। ফলে রাণাপিং আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের প্রতিষ্ঠা অনেকটা মরুভূমির মধ্যে প্রাণের স্পন্দন বলা চলে।
কিন্তু এই এলাকায় এ ধরণের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা চাট্টিখানি কথা ছিল না। বিশেষ করে রাণাপিং এলাকায় সে সময়ে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়তে গেলে এর প্রথম প্রতিবন্ধকতা ছিল উপমহাদেশের বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাণাপিং আরাবিয়া মাদ্রাসা দুর্ভেদ্য দেয়াল ও এর অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রভাব। কোনো মতে পাঠশালা পাশ করলেই তখনকার অভিভাবকেরা সন্তানদেরকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিতেন। আমার নিজের পিতাও ছিলেন রাণাপিং মাদ্রসায় কৃতি ছাত্র।তবে তিনি বেশ মুক্তমনা মানুষ ছিলেন।তিনি রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রতিষ্টাকালীন অবৈতনিক(খন্ডকালীন) শিক্ষকতাও করেছেন।
বর্তমান গোলাপগঞ্জ ইউনিয়নাধীন এলাকায় মাদ্রাসা শিক্ষার কী ধরনের প্রভাব ছিল তার একটি ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যাক। ১৯৬০-এর দশকে রাণাপিং বাজারের পূর্বদিকে কালিদাশপাড়া সরকারি প্রাইমারী স্কুলের পাশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কালিদাশপাড়া নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি যখন হাটি হাটি পা পা করে শাখা মেলতে শুরু করে। কিন্তু তখন রাণাপিং মাদ্রাসার প্রভাবের কারণে এলাকার প্রবীন মুরব্বীরা বিশেষ করে মেয়েদের পর্দা ও মাদ্রাসার সম্মান রক্ষা করতে গিয়েই মেয়েদের স্কুলমুখী হতে নিরোৎসাহী করেন এবং এভাবেই শিক্ষার্থীদের অভাবে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়।
তাই তখনকার সময়ে রাণাপিং এলাকায় স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা তুলতে হলে লম্বা দম নেয়ার ক্ষমতা ও অদম্য সাহস থাকতে হতো। এই দুরূহ কাজটি যাঁরা করেছেন তাঁদেরকে যথার্থ মূল্যায়ন করার জন্যে আজকে আমার এ লেখা। মাদ্রাসার দোহাই দিয়ে সেকেন্ডারি স্কুল প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতার মোদ্দা কথা দাঁড়ায় তখনকার সমাজব্যবস্থা ছিলো অনেকটা মাদ্রাসা প্রভাবিত। বাংলাদেশে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, কোনো আন্দোলনে সাফল্য পেতে হলে যেকোনো ভাবেই হোক তাতে ধর্মকে জুড়ে দাও, তারপর দেখতে থাকো, যা করার ধর্মান্ধ জনগণ’ই করবে। রাণাপিং আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ প্রতিষ্ঠায় এই ধর্মীয় শৃঙ্খল ভাঙার দুরূহ কাজটিতে হাত দিয়ে যারা সাফলতা দেখিয়েছিলেন তাদের সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া য়ায় চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাণাপিং আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রথম ভূমিদাতা প্রবাসী আব্দুল খালিকের স্মৃতিচারণমূলক জবানবন্দী থেকে। ২০০৬ সালে প্রকাশিত রাণাপিং আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় স্মারক গ্রন্থে প্রকাশিত একটি লেখায় বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে স্মতিচারণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি দেশে আসি। যেদিন আসি ঐদিনই রাতে আমার দেশে আসার খবর পেয়ে ফারুক আহমদ আমার বাড়িতে আসেন। কুশল বিনিময়ের পর আমাকে জানান যে, আমার অনুপস্থিতিতে তারা বার বার চেষ্টা করেও একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে, কিভাবে এলাকাবাসি ‘রায়গড় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ উদ্যোগ নেন এবং সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতায় তার ভূমিকা কি ছিলো ইত্যাদি। কথাগুলো বলার পর ফারুক আমাকে বলেন যে, এ বছর বলিষ্ট উদ্যোগ নিয়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা না গেলে আর কোনও দিনই স্কুল করা সম্ভব হবেনা। আমাদের দুর্বলতার সুযোগে হয়তো অন্য স্থানে স্কুলটি হয়ে যাবে। তাই চুড়ান্ত ফয়সালার জন্য তারা আমার দেশে আসার অপেক্ষা করছেন। ঐ দিন সম্ভবত রাত ৭টা থেকে ১১-১২টা পর্যন্ত ফারুক আহমদের সাথে এ নিয়ে আমার আলাপ-আলোচনা চলে। ফারুক আহমদ আমাকে বুঝাতে চাচ্ছিলেন যে, আমি জমি দান করলেই স্কুলটি হয়ে যাবে। তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। দীর্ঘ জার্নি করে এসেছি, ঘুম হয়নি বিধায় ক্লান্ত শরীর। কিন্তু সেদিন একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে আমি এতোই বিভোর ছিলাম যে, খাওয়া-দাওয়া বা বিশ্রাম নেয়ার প্রয়োজনটুকুও মনে করিনি। তেমনি ফারুক আহমদও এমন নাছোড় বান্দা। সে আমার কাছ থেকে জমিদানের প্রতিশ্রুতি আদায় না করে যেন বসা থেকে ওঠবে না। আমিও ভাবলাম একটা স্কুল হোক। তাই তাকে প্রতিশ্রুতি দিলাম, তোমরা স্কুল আরম্ভ করো, আমি যে ভাবেই হোক জমি দেবো। পরের দিন ফারুক আহমদ, হুসেন আহমদ, রিয়াজ উদ্দীন, ছাদিক আহমদ ও আমি ‘চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাইমারী স্কুলে’ এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হয়ে কিভাবে স্কুলটি আরম্ভ করা যায় এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে আমরা একটি সভা আহবান করি। হাজি আব্দুল মনাফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অনেক জনসমাবেশ হয়। সভায় আমরা উক্ত প্রাইমারি স্কুলের পাশে অস্থায়ীভাবে একটি টিনসেডের ঘর বানিয়ে আপাতত স্কুলের ক্লাস আরম্ভ করার সিদ্ধান্ত নেই। তখন এলাকা থেকে স্কুলঘর বানানোর জন্য বাঁশ সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয় আব্দুল হেকিম, মাশুক উদ্দীন, শওকত আলী, আবুল কালাম, দুদু মিয়া প্রমুখকে। এই সভায় আরও সিন্ধান্ত নেয়া হয় যে, ডিসেম্বর মাসের শেষ সাপ্তাহে সম্ভবত স্কুলের ফলাফল প্রকাশের দিন এ বিষয়ে চড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে ফলাফল প্রকাশের পর পরই ছাত্রছাত্রীগণ সার্টিফিকেট নিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি হবার আগেই আমাদেরকে দ্রুত স্কুল আরম্ভ করতে হবে। নতুবা ছাত্রছাত্রী পাওয়া যাবে না। ফলাফল প্রকাশের দিন অনুষ্টিত সভায় সম্ভবত আবারও হাজি আব্দুল মনাফ সভাপতিত্ব করেন। এতে স্কুলের জন্য টিন দান করেন হুসেন আহমদ, মাখন মিয়া, তমজ্জুল আলী (তুতামিয়া) প্রমুখ। স্কুলের জন্য ব্যনারের কাপড় ও প্রয়োজনীয় খাতাপত্র দানের প্রতিশ্রুতি দেন আব্দুল ওদুদ। এছাঢ়াও দু-একজন আর্থিকভাবে সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতিও দেন। সভায় ফারুক আহমদকে প্রধান শিক্ষক, হুসেন আহমদকে সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং আছমান উদ্দীন ও ছাদিক আহমদকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে জানুয়ারি মাসের পহেলা তারিখ থেকে ছাত্রছাত্রী ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যথাসময়ে তিন চারজন ছাত্রছাত্রীও স্কুলে ভর্তি হন। প্রাইমারি স্কুলে তাদের ক্লাস আরম্ভ হয়। এ ব্যপারে প্রসংশনীয় ভুমিকা পালন করেন প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক রিয়াজ উদ্দীন। সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় সগৌরবে আরম্ভ হয় ‘রাণাপিং উচ্চবিদ্যালয়’-এর যাত্রা। পরে এ নামটির সাথে আদর্শ শব্দটি যোগ করে বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় ‘রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়’।
বিদ্যালয়ে প্রথম ভূমি দাতা প্রবাসী আব্দুল খালিকের তথ্যমতে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে ধারণা পাওয়া যায় সে সম্পর্কে করো দ্বিমত থাকার কোনো অবকাশ নেই। কারণ স্মারক গ্রন্থে বিদ্যালয়ের অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক ও বিদ্যালয় প্রতিষ্টায় নিয়োজিত সমাজসেবীগণ স্মৃতিচারণের যা লিখেছেন, আব্দুল খালিক সাহেব অনেকটা হুবহু তাই লিখেছেন। কিন্তু অতি সাম্প্রতি বিদ্যালয়ের নামে খোলা বিভিন্ন ফেইসবুক পেইজে বর্তমান প্রজন্মের কেউ কেউ মূল ইতিহাস বিকৃত করে সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জনাব আব্দুল মুকিত স্যারকে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসাবে পরিচিত করার হীন প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। স্যারকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করছেন। আব্দুল মুকিত স্যার নিজেও এই স্মারক গ্রন্থের একজন লেখক। এমনকী এই স্মারক গ্রন্থটির অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তাও তিনি। বর্তমানে একমাত্র আব্দুল খালিক ও রিয়াজ উদ্দিন ছাড়া স্মারক গ্রন্থের অন্য সকলেই জীবিত। যে সকল অর্বাচীনরা স্কুলের ইতিহাস বিকৃতির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তাদের অবগতির জন্য এবার দেখা যাক বিদ্যালয়ের প্রথম স্মারক গ্রন্থে স্বয়ং আব্দুল মুকিত স্যার নিজে এবং তার সহকর্মীরা কী লিখেছেন।
আব্দুল মুকিত স্যার স্মারক গ্রন্থে প্রকাশিত স্কুল প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন, “১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে রণকেলীস্থ ‘গোলাপ কুঁড়ি কিন্ডার গার্টেনে’ যোগদান করি।…১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসে ফারুক আহমদ, জনাব আব্দুল খালিক, ডা. আলাউদ্দিন, হোসেন আহমদ, হাজী আব্দুল মনাফ, জিয়া উদ্দিন, সমসুদ্দিন, মাখন মিয়া, আব্দুল ওদুদ, বদর উদ্দিন টুনু চৌঘরী গোয়াসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে সভা আহবান করে চাঁদা ধার্য্য করেও প্রয়োজনীয় জমির অভাবে ব্যর্থ হন। কিন্তু আমার দেশে আসার সুবাদে এবং আমি একজন শিক্ষক বিধায় আমারই ছাত্র বিশিষ্ট সাহিত্যিক, গীতিকার ফারুক আহমদ উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে পরামর্শ করে ১৯৮৭-এর ১৯ জানুয়ারি চৌঘরী গোয়াসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক সভা আহবান করেন এবং সভায় অংশগ্রহণ করে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতঃ বিদ্যালয়ের লেখাপড়া সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ের দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য আহবান জানান।
স্যার যে প্রথম থেকে এই স্কুল প্রতিষ্ঠায় ছিলেন না তাঁর এই লেখাটিই তার বড় প্রমাণ। কেননা, ১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য এলাকার কোথাও কোনো সভা হয়নি। হয়েছিল ১৯৮৫ সালে ‘রায়গড় সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। সেই সভায় জনাব ডা. আলাউদ্দিন ও ফারুক আহমদ স্যার ছাড়া উল্লিখিতদের মধ্যে আর কেউই উপস্থিত ছিলেন না। মুকিত স্যারও তখন বিদেশে। তিনি আসেন এর পরের বছর ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে। তাই তিনি হয়তো কারো কাছ থেকে শুনে জনাব আব্দুল খালিক, হোসেন আহমদ, হাজী আব্দুল মনাফ, জিয়া উদ্দিন, সমসুদ্দিন, মাখন মিয়া, আব্দুল ওদুদ, বদর উদ্দিন টুনু স্যার প্রমুখের কথা লিখেছেন। মুকিত স্যার আরও লিখেছেন ১৯৮৭ সালের ১৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একটি সভায় তাঁকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেয়ার আহবান জানানো হয়। এবং ৫ ফেব্রুয়ারি স্কুলের যাত্র শুরু হয়।
আমরা আব্দুল খালিক সাহেবের লেখা থেকে আগেই জেনেছি স্কুলটি চালু হয়েছিল ১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারি। এবার দেখা যাক স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক, বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী জনাব হোসেন আহমস স্যার কী লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে সম্ভবত ১ তারিখ ছাত্রছাত্রী ভর্তি করে কাঁচাঘর বানানোর পূর্বে প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস শুরু করা হয়। তখন আমি ব্যবসায় জড়িত হয়ে গেছি। তাই আমরা ফারুককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তির কাজ আরম্ভ করি। ফারুকের পূর্ববর্তী আলোচনার সূত্রে একটি সভায় আব্দুল খালিক লন্ডনি প্রাইমারি স্কুলের সম্মুখভাগস্থ মসজিদের দক্ষিণ পাশের জমিটি স্কুলের জন্য দান করেন। আমরাও জায়গাটিতে খুঁটি দিয়ে চিহ্নিত করি। কিন্তু তাঁর অংশীদারগণ রাজী না হওয়াতে পরবর্তীকালে ফারুকের সঙ্গে আলোচনা করে বর্তমান জাগয়াটি দান করেন। এই জমি দানের পূর্ব থেকেই ছাত্রছাত্রী ভর্তি ও ক্লাস চলছিল। তখন শিক্ষক ছিলেন: ফারুক আহমদ, বদর উদ্দিন (টুনি মিয়া), আসমান উদ্দিন, সাদিক আহমদ, মৌলানা আব্দুল লতিফ ও আমি। মাঝেমধ্যে হেলাল উদ্দিন আহমদ (মেম্বার) ও আসতেন। তখন পর্যন্ত জনাব আব্দুল মুকিত স্কুলে যোগদান করেন নাই। তাঁকে স্কুলে আনার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় রিয়াজ ভাইকে। তিনি যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হওযায় আমরা ফারুককে এ দায়িত্ব দিই। সে তাঁকে স্কুলের শিক্ষক হিসেবে আসতে রাজী করায়। সম্ভবত তিনি স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিন প্রথম আসেন।”
এবার আসা যাক রিয়াজ উদ্দিনের স্যারের লেখায়। তিনি লিখেছেন, “১৯৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি, প্রবাসী আব্দুল খালিক, ফারুক আহমদ, হোসেন আহমদ ও সাদিক আহমদ এ পাঁচজন মিলে একটি সভা করে সিদ্ধান্ত নেই যে, যা হবার হবে আমরা ১৯৮৭সালের ১ জানুয়ারি থেকে ‘চৌঘরী গোয়াসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ই ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণি চালু করবো। এ সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডিসেম্বর মাসের শেষ দিন স্কুলের বার্ষিক রেজাল্ট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে একটি সভার আয়োজন করি। এতে আটাশজন অভিবাবক ও এলাকাবাসীর উপস্থিত ছিলেন। সভায় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শক্রমে স্কুলের নির্মানাধীন আইডিএ কক্ষ সংলগ্ন স্থানে কাঁচাঘর তৈরি করে এবং সাময়িকভাবে আমার অফিস কক্ষ ও আইডিএ কক্ষে ক্লাস চালু করা যায় কি না এ বিষয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে ১৯৮৭ সালের প্রথম দিন থেকে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে ছাত্রছাত্রী ভর্তির জন্য অভিবাবকদের সাথে যোগাযোগ ও ক্লাস চালু করার জন্য ফারুক আহমদ, হোসেন আহমদ, সাদিক আহমদ ও আসমান উদ্দিন প্রাণপন প্রচেষ্টা চালান। এ সময় আমাদের সহযোগী ও পরামর্শদাতা হিসেবে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন জনাব আব্দুল খালিক, আব্দুল ওদুদ, মাখন মিয়া, জিয়া উদ্দিন, ইসমাইল আলী, হাজি আব্দুল মনাফ ও মওলানা শামসুদ্দিনসহ (হোমিও ডাক্তার) আরো অনেকে। এছাড়া ছাত্রছাত্রীদেরকে স্কুলে ভর্তি হতে অনুপ্রাণিত করা অর্থাৎ যেখানে যা প্রয়োজন তা করতে বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করেন জনাব আব্দুল হেকিম, শওকত আলী, মাশুক আহমদ আবুল কালাম ও চুনু মিয়া প্রমুখ। আমাদের পরিকল্পনানুযায়ী ২ জানুয়ারি আমরা উক্ত বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণি খোলার অনুমতি লাভ করি এবং পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রছাত্রী ভর্তি করতে থাকি।” এর পরে তিনি লিছেখেন: সার্বক্ষণিক শিক্ষকরা প্রায় সকলেই ছিলেন অল্পবয়স্ক। তাই আমরা এম সি অ্যাকাডেমির প্রাক্তন শিক্ষক জনাব আব্দুল মুকিত সাহেবকে স্কুলে নিয়ে আসার জন্য উদ্যোগী হই। আমি তাঁকে আনার দায়িত্ব চাপিয়ে দেই ফারুকের উপর। সম্ভবত ১৯৮৭ সালের ১৯ জানুয়ারি ফারুক জনাব আব্দুল মুকিতকে স্কুলে শিক্ষকতায় যোগদান করাতে রাজী করায়। তখন ফারুক আহমদ আমাদের কাছে প্রস্তাব রাখেন মুকিত সাহেব তার শিক্ষক তাই স্বেচ্ছায় তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বটি জনাব আব্দুল মুকিত সাহেবকে অর্পন করতে চান। এরপর থেকেই জনাব আব্দুল মুকিত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব লাভ করেন। তবে তিনি রণকেলীস্থ ‘গোলাপ কুঁড়ি শিশু বিদ্যালয়’ থেকে শিক্ষাদান শেষে স্কুলে আসার পূর্ব পর্যন্ত ফারুক আহমদ সুষ্টুভাবে স্কুল পরিচালনা করতেন এবং এতে তাকে আমি সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছি।” এখানে আমরা স্কুল চালুর তারিখ পাচ্ছি ১ জানুয়ারি এবং মুকিত স্যারের স্কুলে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা শুরু হয় ১৯ জানুয়ারি। এবং মুকিত স্যার স্কুলে যোগদানের তারিখ ৫ ফেব্রুয়ারি। সুতরাং স্কুল ১ জানুয়ারি চালু হয়ে থাকলে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অবশ্যই কেউ এর ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা সহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কে? এর উত্তর আছে আব্দুল খালিক লন্ডনি, রিয়াজ উদ্দিন স্যার, হোসেন আহমদ স্যার, বদর উদ্দিন আহমদ (টুনু) স্যার, মওলানা আব্দুল হক জনাব জিয়াউদ্দিন প্রমুখের লেখায়। কিন্তু এদের কারো লেখায় আমরা মুকিত স্যারের নামটি পাচ্ছি না। সবাই লিখছেন মুকিত স্যারকে নিয়ে আসেন ফারুক স্যার। এ কথাটি স্বয়ং মুকিত স্যারের লেখায়ও আছে।
সাদিক স্যার সঠিক তারিখ উল্লেখ না করতে পারলেও লিখেছেন জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে। কিন্তু ফেব্রুয়ারি নয়। ফারুক স্যার স্কুল প্রতিষ্ঠার দিনক্ষণ উল্লেখ করে স্কুল প্রতিষ্ঠার পুরো ইতিহাস লিখেছেন। এবার দেখা যাক দীর্ঘদিন পরে দেশে এসে তিনি এটি সম্পাদনা করতে গেলেন কেন। তিনি কি এই দায়িত্ব ইচ্ছা করেই নিয়েছিলেন? নাকি কর্তৃপক্ষ তাঁর ওপর এই দায়িত্ব চাপিয়ে ছিলেন। চাপিয়ে থাকলে কেন?
সম্পাদকের কথায় ফারুক আহমদ স্যার লিখেছেন: “প্রায় এক যুগ প্রবাসজীবন কাঠিয়ে ২০০০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দেশে আসার পর ‘রাণাপিং আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে’ বেড়াতে যাই। সে দিন কথা প্রসঙ্গে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জনাব আব্দুল মুকিত সাহেবের নিকট থেকে জানতে পারি যে, তখন পর্যন্ত অর্থাৎ স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রায় চৌদ্দ বছর গত হওয়ার পরেও স্কুল থেকে কোনো ম্যাগাজিন বা কোনো স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয় নাই। তিনি নাকি স্কুলের ইতিহাস লেখার উদ্যোগ নিয়ে ছিলেন। স্কুল সংশ্লিষ্ট অনেকে তাঁর উদ্যোগের সাথে দ্বিমত পোষণ করায় তিনি আর অগ্রসর হতে পারেননি। কারণ হিসেবে আমাকে জানালেন যে, স্কুরেল প্রথম প্রকাশনা বিধায় কোনো কারণ ছাড়াই অনেকে মনে করছেন সে ইতিহাসে হয়তো তাদের সঠিক মূল্যায়ন হবে না। তাই শিক্ষকমন্ডলী এবং ম্যানেজিং কমিটি এহেন স্পর্শকাতর বিষয়ে হাত দিয়ে বিতর্কিত হতে নারাজ ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলো বলে তিনি আমাকে স্কুলের একটি সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস লিখতে অনুপ্রাণীত করেন। কিন্তু সময় স্বল্পতার জন্য আমি রাজী হই নাই।”
এখানেও মুকিত স্যার নিজেই বলছেন তিনি স্কুলের ইতিহাস লিখতে চেয়েছিলেন কিন্তু অনেকে সেটা মেনে নেননি। সেজন্য স্বয়ং তিনি ফারুক স্যারকে অনুরোধ করেন ইতিহাস লেখার জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে কেন তিনি ফারুক স্যারকে অনুরোধ করছেন? এর অর্থ হচ্ছে ফারুক স্যার এটির আদিঅন্ত জানেন। মুকিত স্যার বা অন্য কেউ মাঝপথ থেকে এসে না জেনে লিখতে পারবেন না। শুধু তাই নয় ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি খয়েরউদ্দিন আহমদ (চুনু মিয়া) সহ অন্যান্যদের বিশেষ অনুরোধেই ফারুক স্যার অনেকটা বাধ্য হয়েই এটি সম্পাদনা করতে রাজি হন। বইটির সম্পাদনা শেষ করে স্মারক গ্রন্থটি তিনি ম্যানেজিং কমিটির কাছেই দিয়ে যান। কিন্তু ম্যানিজিং কমিটি ২০০৬ সাল পর্যন্ত হয়তো টাকা পয়সার অভাবে বের করেনি। যারা এটিতে লেখা দিয়েছিলেন তাঁদের অনুরোধে ২০০৬ সালে ফারুক স্যারকেই স্মারকটি প্রকাশ করতে হয়। আমরা জানি যে এই স্মারক গ্রন্থটি প্রকাশের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো বিতর্ক হয়নি। কারণ, লেখক একা কোনো ব্যক্তি বিশেষ নয়, যারা স্কুল প্রতিষ্ঠায় জড়িত ছিলেন তারাই তারাই এটির লেখক। এলাকার সবাই এটাকে সঠিক ইতিহাস হিসাবেই গ্রহণ করেছেন। এর পরে কেটে গেছে আরও প্রায় দশক। অথচ অবাক হবার মতো বিষয় যে, ইদানীং স্কুলেরই কিছু অর্বাচীন ছাত্র, এই স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় যারা অবুজ ও নাবালক ছিল তারাই স্কুল প্রতিষ্টায় আমাদের পূর্বপুরুষদের লিপিবদ্ধ সঠিক(রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রথম ঐতিহাসিক স্মারক গ্রন্থ)ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে মনগড়া ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়ে কাউকে ছোট আবার কাউকে বড় ইত্যাদি লিখে যাচ্ছে। তাদেরকে বলবো আগে ইতিহাস জানুন তার পরে লিখুন।
ডাঃ আক্তার হোসেনঃ
প্রভাষক(সার্জারী বিভাগ) সিলেট সরকারী ইউনানী মেডিকেল কলেজ। সাধারন সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু লেখক-সাংবাদিক ফোরাম,ইউকে,সিলেট শাখা।সাংগঠনিক সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশান, সিলেট মহানগর শাখা।