করোনার তাণ্ডবে অস্থির কেনাকাটা
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:৫২:১৭,অপরাহ্ন ০৮ মে ২০২০ | সংবাদটি ৩৫৯ বার পঠিত
।। এডভোকেট মাওলানা রশীদ আহমদ ।।
কোনো জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ না দেখে প্রাণঘাতী করোনা এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ সব দেশ-মহাদেশকেই ঘাড়মটকে খাচ্ছে। গোলাবারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ বা অস্ত্রের ঝনঝনানি ছাড়াই থমকে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। দুনিয়ার সব মেরু ও গোলার্ধকেই শামিল করেছে মৃত্যুর মিছিলে। এ মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়ে তা বাংলাদেশকেও বাদ রাখেনি। মুখথুবড়ে পড়েছে দেশের কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিমান ও নৌবন্দর, সড়কপথ, রেলপথ, খেয়াঘাট সব কিছুই। স্তিমিত হয়ে গেছে মানবকুলের জীবনধারা। এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে সবাই নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে নিজের সীমানায়। ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক অনুষ্ঠানাদি বন্ধ। লোকালয়ের এ স্তব্ধতা উপাসনালয়েও। মসজিদ-মন্দিরেও অনিয়মিত-অস্বাভাবিক অবস্থা।
সৌদি, ইরানসহ মুসলিম দেশের মুসলমানরা তো সাপ, ব্যাঙ, বেজি খায় না। কিন্তু করোনার হানা সৌদিসহ আরব বিশ্বেও। করোনা থেকে বাঁচতে পবিত্র কাবা শরিফে ওমরাহ পালন এবং মদিনায় হুজুরপাক সা:-এর রওজা মোবারক জিয়ারতে অনির্দিষ্টকালের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের আলোকে বিদেশী ওমরাহযাত্রীদের সৌদি আরবে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দেশটির সরকার। সামনেই পবিত্র রমজান মাস। হজ মৌসুম সামনে রেখে, সৌদি সরকারের এই ঘোষণায় বিদেশী নাগরিকদের হজ পালন নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে সৌদিগামী সব ওমরাহ ফ্লাইট অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল করা হয়েছে।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন থেকে ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাসুমেহ ইবতেকার পর্যন্ত করোনার থাবায় পড়েছেন। করোনায় বিপর্যস্ত ইতালিতে ক্যাথলিকদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসকেও এ ভাইরাসে পেয়েছে বলেও খবর বেরিয়েছে। উৎপত্তিস্থল চীনে অঞ্চলভেদে পক্ষপাতিত্ব করলেও সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত, মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান, বাহরাইন, মিসর, আলজেরিয়ার মতো মুসলিম দেশও এ ক্ষেত্রে ছাড় পায়নি। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলারুস, ব্রাজিল, কম্বোডিয়া, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভারতে পর্যন্ত করোনা কোনো বাছবিচার করেনি।
এখন পর্যন্ত যেসব দেশ করোনা মোকাবেলায় সাফল্য অর্জন করেছে তারা প্রথমে কয়েকটি কাজ দ্রুত করেছে। চীন সন্দেহভাজনদের প্রচুর টেস্ট করেছে, দক্ষিণ কোরিয়া ফ্রি টেস্ট করেছে। রাশিয়া শুরু থেকে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। হংকং-তাইওয়ান সার্স ভাইরাসের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছে। ভিয়েতনাম চীনের প্রতিবেশী হয়েও করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি, উগান্ডাতো আরো সফল। করোনা মোকাবেলায় গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে দেশটি যা বহু দেশের জন্য স্বপ্ন বা কল্পনার। ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় দেশ করোনা মোকাবেলার প্রশ্নে উগান্ডাকে অনুসরণ করতে পারে। শঙ্কা থাকার পরও উগান্ডায় একজনও আক্রান্ত হয়নি। পুরো বিশ্ব যখন করোনায় মৃত্যু-আতঙ্কে, উগান্ডায় নাকি তখন খুশিতে আতশবাজি ফোটানো হচ্ছে।
করোনা রোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আভাস দেয়ার পর, একটুও দেরি করেনি উগান্ডা। চীনের উহানে প্রথম করোনার অস্তিত্ব ধরা পড়ার সাথে-সাথে অ্যাকশনে নামেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইয়োভেরি মুসেভেনি। দ্রুত সাফ-সুতরো করে ফেলা হয় দেশের পথঘাট, হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এক মাসের জন্য নিষিদ্ধ করে দেয়া হয় সামাজিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় সব ধরনের জমায়েত। বন্ধ করে দেয়া হয় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। দেশের সীমান্ত, বিমানবন্দর সিল করে ফেলা হলো। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় নিজ দেশের ও অন্য ১৬ দেশের নাগরিকদের ওপর। টিভি পর্দায় ভেসে ওঠেন উগান্ডার প্রেসিডেন্ট মুসেভেনি। সাবধানতা অবলম্বন বা পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এর ধারে-কাছেও যেতে পারেনি। এ বিলম্বের জের এখন টের পাচ্ছি সবাই।
কেবল বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই চীনা প্রযুক্তি ও সস্তা পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের কারণটা ভিন্ন। তা হচ্ছে, কমসময়ে পণ্যপ্রাপ্তি ও প্রতিযোগিতামূলক দাম। এ ধরনের অতিনির্ভরতা যে ভালো নয়, সেটির বড় শিক্ষা দিচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি। বেশি আমদানি হয়, এমন পণ্যের বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে। একইভাবে খুঁজতে হবে রফতানিবাজারও। বাণিজ্যযুদ্ধ এবং করোনাভাইরাসসহ নানা কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও চীনের বিকল্প দেশ খুঁজছেন। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এমনকি প্রতিবেশী ভারতও সুযোগটা নিচ্ছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নিজেদের দেশের দিকে টানতে উঠেপড়ে লেগেছেন তারা। এ দিকে, নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী চীন থেকে পণ্য আনা যাচ্ছে না। কিছু পণ্য এলেও সময় লাগছে অনেক। চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় প্রায় স্থগিত হয়ে গেছে চীনের সাথে বাংলাদেশের আমদানি রফতানির সম্পর্ক, যার প্রভাবে অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের বাজার। বাড়ছে চীন থেকে আমদানি পণ্যের দাম। কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে করোনা প্রাসঙ্গিক নয়। কেরানীগঞ্জ-জিঞ্জিরায় তৈরি করা মালামালের দাম বাড়ানোর পেছনেও করোনাকে দাঁড় করানো হচ্ছে অজুহাত হিসেবে।
বেশি আক্রান্ত বাংলাদেশের রফতানিমুখী পোশাকশিল্প। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন হাজার ৪১৩ ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে, এক হাজার ২১৭ কোটি মার্কিন ডলারের কাঁচামালের বড় অংশই এসেছে চীন থেকে। আবার পোশাক কারখানার যন্ত্রাংশের বেশির ভাগের জোগানদাতাই চীন। এর বাইরে আমাদের চামড়া, ওষুধ, রড, ঢেউটিন, সিরামিকসের কাঁচামালও চীননির্ভর। ভরা মৌসুমে রফতানি না হওয়ায় অনেক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। করোনা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পথেও। এসব প্রকল্পে কাজ করা চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, প্রকৌশলী ও কর্মীরা কাজে ফিরছেন না। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার ঘা কোনপর্যায়ে যাবে, সেটি এখনো আন্দাজ করা যাচ্ছে না। কত দিন এ ভাইরাসের প্রকোপ থাকে, অপেক্ষা করে সেটি দেখতে হবে। তবে, আরো কিছুদিন এভাবে চললে করোনায় ঘাটা গ্যাংরিনে গিয়ে ঠেকার শঙ্কা বিজনেস কমিউনিটিতে। উৎপাদন বন্ধ বা ঘাটতি হলে রফতানি কমে যাবে। বেকার হবে হাজার হাজার মানুষ। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির বিপরীতে মানুষের আয় থমকে যাবে। কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধিতে ছেদ পড়বে। বাজারের অস্থিরতা সমাজে বিশৃঙ্খলা বাড়াবে। সময়ের সদ্ব্যবহার করা চক্র লুফে নিচ্ছে মানুষের এ দুর্ভোগকে। এ খেলায় লাভ বেশি, যারা মানুষ মারছে তাদের। ভাবে, তারা নিজেই শুধু মানুষ। মৃতদের মানুষ মনে করে না। এ খেলার রেফারি, আমপায়ার, ধারাভাষ্যকার, উৎসাহদাতারা অচেনা নন। তবে, অধরা। সরকারও সময়ে সময়ে কাবু হয়ে যাচ্ছে এই পরাক্রমশালী চক্রের কাছে। আবার পরিস্থিতির শিকার অনেকেও এরই মধ্যে খাবার-দাবার, ডেটল, স্যাভলনÑ বস্তাবোঝাই কিনে সবকিছু ‘আউট অব মার্কেট’ করে ঘরে উঠেছেন।
চাল-ডাল, তেল, লবণ, সাবান, হ্যান্ডওয়াশসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের পাশাপাশি বিলাসী পণ্য কেনার ধুম। পরিমাণে দুই-তিন গুণ বেশি। পাড়ামহল্লা থেকে শপিংমল পর্যন্ত এ হুমড়ি খাওয়া। ক্ষেত্র বিশেষে কদাকার-কুৎসিত এ দৃশ্য। দরকষাকষি বা ভালোমন্দ যাচাইয়ের ফুরসতও নেই কারো কারো। এই ক্রেতাকুল অসাধারণ-অস্বাভাবিক কেউ নন। জনসাধারণ। আমজনতার অংশ। আপৎকালীন প্রয়োজন মেটানোর চেয়ে এ কেনাকাটার নমুনায় উৎসব ভাব বেশি যেন বিশাল ও জরুরি কোনো উপলক্ষ। তাদের অবশ্যই গুদামঘর নেই। রান্নাঘর, স্টোর, শোয়া-বসার রুমেই মজুদ করতে হচ্ছে পণ্যগুলো। করোনায় নিত্যপণ্যে আকাল আসবে এ ব্যাপারটা তারা ‘নিশ্চিত’ হয়েই পণ্যের স্টক গড়ছেন। এই করোনায় নিজেদেরও প্রাণ যেতে পারে সেটি ভাবনায় নিচ্ছেন না। রীতিমতো আজব ব্যাপার। বড় খারাপ লক্ষণ। বিশ্বে করোনা আক্রান্ত আর কোনো দেশে মানুষের কেনাকাটায় এমন বেপরোয়া দশার খবর নেই।
[লেখকঃ আইনজীবী, লেখক, গবেষক, কলামিস্ট, সম্পাদক ও প্রকাশক ” গোলাপগঞ্জ – বিয়ানীবাজার “সংবাদ “]