করোনায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ?
প্রকাশিত হয়েছে : ১:২৫:৩০,অপরাহ্ন ২১ এপ্রিল ২০২০ | সংবাদটি ৯৮৩ বার পঠিত
প্রাণঘাতী করোনা হানার কেবল বিস্তারই ঘটছে। প্রতিদিনই গড়ছে মৃত্যুর নতুন রেকর্ড। আক্রান্তের সংখ্যাও আগের দিনের রেকর্ড পার করছে। আর বাংলাদেশে করোনার উপসর্গ জ্বর-সর্দি, কাশি-শ্বাসকষ্টে মৃত্যুর সংখ্যাও ভয়াবহ। এসব মৃত্যু করোনায় মৃত্যুর তালিকার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এ রকম অবস্থায় ১৬ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত চিঠিতে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হলো সারা দেশকে। এতে আরোপিত বিধিনিষেধগুলোও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই তিনিই ক’দিন আগে বলেছিলেন বৈজ্ঞানিক তথ্য ও তার ওপর ভিত্তি করে বিশ্লেষণে দেখেছেন, দেশে করোনার ঝুঁকি নেই। ক’দিনের মধ্যেই আকাশ-পাতাল তফাত তার অবস্থানে। এই দায়িত্ববানরা মনে করতেন গরমের কারণে এখানে করোনার বিস্তার ঘটবে না।
দেশের ঝামেলা কতভাবেই শেষ করে দেয়া যায়। গোঁজামিলে তেলেপানি মেলানো যায়। সরকারি বিভিন্ন বাহিনী, এজেন্সি, ব্যুরোক্রেসি ইত্যাদি দিয়ে কথামালার বাহাদুরিতে দিনের ভোট রাতে করানো যায়। বিনাভোটেও জয়ী ঘোষণা করা যায়; কিন্তু এই বৈশ্বিক সঙ্কট মোকাবেলা একেবারে ভিন্ন বিষয়। দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা, লকডাউন করার আগে করোনাকে গুজব বলার চেষ্টাও করা হয়েছে। গুজব রটানোর অভিযোগে ধরপাকড়ও হয়েছে। এরপর স্বীকার করলেও একের পর এক প্রতিপক্ষ দাঁড় করানো হয়েছে।
কখনো প্রবাসীদের, কখনো ডাক্তারদের আর কখনো মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করে নিজের ব্যর্থতা আড়ালের চেষ্টা চলেছে। এরমধ্যেই প্রবাসীদের যথাযথ পরীক্ষা না করা, পোশাক শ্রমিকদের একেবার অরক্ষিত অবস্থায় ঢাকার বাইরে পাঠানো, আবার ঢাকায় নিয়ে আসার মাধ্যমে বিপজ্জনক করে দেয়া হয় গোটা দেশকে। যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ফ্রান্সের মতো উন্নত দেশও যেখানে অসহায় সেখানে লুকোচুরি জরুরি ছিল না। এটি পরিস্থিতিকে আরো জটিল করছে। অন্যরা কিভাবে আত্মরক্ষার তাগিদ অনুভব করেছে সেখান থেকে শিক্ষা নেয়ার পর্বটা বাদই থেকেছে। উপরন্তু, আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী, বিভিন্ন দেশের তুলনায় আমাদের পরিস্থিতি ভালো এ ধরনের স্থূল কথায় মানুষ হাসানো হচ্ছে এখনো। টেলিভিশনে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান বেশি করার পরামর্শও বাদ যায়নি।
বৈশ্বিক এ মহামারী লকডাউনের নামে দুনিয়াজুড়েই এক বন্ধ্যাত্ব তৈরি করেছে। দোকানপাট, বিপণি বিতান, কলকারখানা বন্ধ ঘোষণা হয়েছে দেশে দেশে। স্কুল-কলেজসহ সব রকমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন তালা ঝুলছে। পৃথিবীর কোথাও এখন নিরাপদ নয়। প্রাণে বাঁচতে মানুষের এখন আর এদিক-সেদিক ছোটার সুযোগও নেই। আমরাও ইতিহাসের এক কঠিন সময়ে। দেশে দেশে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মসজিদসহ অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো পর্যন্ত বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে করোনা তাণ্ডবের কারণে! পবিত্র কাবা শরিফ এবং রওজা মোবারকসহ ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে শত্রুর মোকাবেলায় মারণাস্ত্র তৈরি হয়েছে ঠিকই; কিন্তু আসল শত্রু না চেনার কারণে তার বিরুদ্ধে কোনোরকম প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ফলে ঢাল-তলোয়ারবিহীন মানুষ শত্রুর মোকাবেলায় প্রতিদিনই মার খাচ্ছে অসহায়ভাবে। আসল শত্রু করোনা বিনা বাধায় একের পর এক দেশ ও অঞ্চল দখল করে নিচ্ছে। ধনী, গরিব, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নারী-পুরুষ, শিশু-আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, সাদা-কালো-বাদামি, হিন্দু-মুসলামান-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ-ইহুদি-নাস্তিক সবার সামনে এখন একটাই শত্রু, করোনা।
এত প্রাণহানির পর বেঁচে থাকা মানবকুলের কী হবে? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে দেশে-দেশে। করোনার ধকল বিশ্ব-অর্থনীতিকে যেভাবে বিপর্যস্ত করছে, তাতে পৃথিবীর প্রায় ৫০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হতে পারে বলে সতর্ক করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অক্সফাম। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভা সামনে রেখে এই সতর্কবার্তা দিয়েছে নাইরোবি-ভিত্তিক সংস্থাটি। করোনাভাইরাস সঙ্কটে বিশ্বজুড়ে দরিদ্র পরিবারগুলোর আয় কমার পাশাপাশি ভোগ ব্যয় কতটা সঙ্কুচিত হচ্ছে, তা হিসাব করে দারিদ্র্যের মানচিত্রে সম্ভাব্য পরিবর্তনটি আঁচ করার চেষ্টা হয়েছে সেখানে। করোনা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ধারণাও ভয়াবহ। বিশ্বব্যাংক বলেছে, , করোনাভাইরাসের প্রভাবে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে থাকায় শুধু পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেই দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে এক কোটি ১০ লাখে দাঁড়াতে পারে।
ধনী দেশগুলো ইতোমধ্যে দেখিয়েছে যে, এ রকম সঙ্কটের সময়ে নিজেদের অর্থনীতিকে সচল রাখতে প্রয়োজনে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়ার সক্ষমতা তাদের আছে। সেই সক্ষমতা দেখাতে শুরু করেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোও। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। করোনাভাইরাস মহামারীতে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচটি প্যাকেজের আওতায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। তা বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংকগুলোকে বড় ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার ক্ষমতা বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর) ১ শতাংশ পয়েন্ট কমানো হয়েছে, যা কার্যকর হবে ১৫ এপ্রিল থেকে। সেই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেপো সুদহার শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এ নির্দেশনা ১২ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে।
প্রণোদনা ঘোষণার পর কিছু প্রশ্ন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এই প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন কিভাবে হবে। সব ক’টি প্যাকেজই ঋণনির্ভর। শিল্প, সেবা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা এসব খাতে যে অর্থায়নের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তার সবই ঋণ হিসেবে ব্যবসায়ীদের দেয়া হবে। ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ হারে সুদ পাবে। যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক দেবে ঋণগ্রহীতা ও বাকি অর্ধেক ভর্তুকি হিসেবে দেবে সরকার। কিন্তু শঙ্কা হলো, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় কমে গেছে আমানতের প্রবৃদ্ধি।
ব্যাংকগুলো বর্তমান পরিস্থিতিতে তারল্যসঙ্কটের মধ্যে ঋণ দেবে কিভাবে? ঘোষিত প্রণোদনার মধ্যে আরো সমস্যা হলো, কারা অর্থ পাবেন, যথাযথভাবে প্রণোদনার অর্থ দেয়া হবে কি নাÑ এসব নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে পাওয়ার যোগ্যদের পাওয়ার কোনো গ্যারান্টি কি আছে?
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশেরও এই মুহূর্তে প্রধান প্রতিপক্ষ, শত্রু করোনাভাইরাস। এই শত্রু একেবারে অজানা না হলেও অদৃশ্য। হাতের কাছে করোনা শত্রু সামনাসামনি মোকাবেলার কোনো কার্যকর অস্ত্র (ভ্যাকসিন কিংবা সুনির্দিষ্ট ওষুধ) নেই। ওষুধ আবিষ্কারের আগে করোনা ঠেকানোর একমাত্র পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত, লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করা। এ তাণ্ডব থেকে রক্ষার উপায় খোঁজার অন্ত নেই। বিজ্ঞানীরাও দিশেহারা বলা চলে। এখন পর্যন্ত কোনো উপায় বের করা সম্ভব হয়নি। তবে, চেষ্টা থেমে নেই। এমন পরিস্থিতিতে ধর্মহীনরাও আকাশের দিকে ভরসা করে আছেন। মানব সভ্যতার ওপর এত বড় আঘাত অতীতে কখনো এভাবে আসেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরে পর দুনিয়া এমন সঙ্কটে পড়েনি। আক্রান্ত দুনিয়ায় সবাই দিশেহারা। কিন্তু বাংলাদেশে এমন নিদান দিনেও প্রতিদিনই সরকারি রিলিফ চোর ধরার খবর বের হচ্ছে। চুরিতে জড়িতদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা। শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গার মতো এদের হাতেই সরকারি ত্রাণ ব্যবস্থাপনার ভার।
নিজেদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবির পাশাপাশি রফতানির যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা, আগামী বছরকয়েকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার চেয়েও ধনী হওয়ার খোশগল্প শোনানো হলেও দেশের আসল অবস্থা একেবারে প্রকাশ হয়ে পড়েছে করোনা পরিস্থিতিতে। আশপাশের অনেকেই অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত। অনেকে লাজশরমে কারো কাছে হাত পাততে পারছে না। কারো এ দশা চোখে পড়ছে। কারোটা পড়ছে না। অনেকে এই মুহূর্তে অসহায়দের জন্য কমবেশি করছেন। সহযোগিতা করে অনেকেই প্রচারের আলোয় আসতে চান না। আবার অনেকে ত্রাণ-দানের বাহাদুরিতে নেমে পড়েছেন। দিনকে দিন অবস্থা যে দিকে যাচ্ছে তাতে ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থায় আর স্বচ্ছতা আনা যাবে কি না, বলা যাচ্ছে না।
সারা দেশে অনেক ইউপি চেয়ারম্যান-সদস্য চাল চুরি করে ধরা পড়েছে। চুরির সামান্য অংশ ধরা পড়েছে। আবার ত্রাণ চুরির সাথে পথে ত্রাণের মালে গরিব মানুষের হানা দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। এটা চরম অশনি সঙ্কেত। এই চুরি কেবল চেয়ারম্যান-মেম্বররা করছে বললে একতরফা হয়ে যায়। স্থানীয় প্রশাসন না চাইলে কেবল চেয়ারম্যান-মেম্বারদের একার পক্ষে এ চুরি সম্ভব নয়। দলীয় কর্মী আর দলানুগত প্রশাসন দুয়ের মিলিত ব্যবস্থাপনায় ত্রাণ বিতরণের ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। চাল নিয়ে চালবাজি চলছিল গত মাসকয়েক থেকেই। সেটির সাথে যোগ হয়েছে রিলিফের চাল চুরির উৎসব। এ দিকে, বিভিন্ন জায়গায় পোশাক শ্রমিকরা রাস্তায় নামছে। বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেছে। বকেয়া বেতনের পাশাপাশি খাদ্য চায় তারা। এটিও আরেক অশনি সঙ্কেত।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, আইনজীবী ও সাবেক সহকারী অধ্যাপক সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা