মুক্তিযুদ্ধে গোলাপগঞ্জ
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:০৫:১৯,অপরাহ্ন ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ | সংবাদটি ৯৭৬ বার পঠিত
।। আনোয়ার শাহজাহান ।।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী রাতের অন্ধকারে বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ চালালে দেশের প্রতিটি এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। গোলাপগঞ্জের জনগণও পিছিয়ে ছিলেন না। ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ গোলাপগঞ্জে এসে পৌঁছলে শত শত মানুষ রাতভর গোলাপগঞ্জ ও ঢাকাদক্ষিণে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। ২৬ মার্চ ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়িতে হানাদার সেনারা আক্রমণ করে যেমন হাজার হাজার পুলিশসহ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে, তেমনি সিলেট শহরেও হত্যাযজ্ঞ চলে। ফলে সকাল থেকেই সিলেট থেকে প্রচুর লোক প্রাণভয়ে গোলাপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়এসে আশ্রয় নিতে থাকেন। তখন সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শরণার্থীদের মাঝে খিচুড়ি, মুড়ি, চিড়া ও পানি সরবরাহ করা হয়। বিভিন্ন বাড়িতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে গোলাপগঞ্জ উপজেলার রয়েছে বিরল ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধে জানমাল ও মেধা দিয়ে উপজেলার ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেন। যুব ও তরুণ সমাজ দলে দলে যোগ দেন মুক্তিবাহিনীতে। রাজনৈতিক নেতারা সক্রিয় হয়ে ওঠেন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী গোলাপগঞ্জবাসী জনমত গঠন এবং অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।
গোলাপগঞ্জের স্বাধীনতাকামী মানুষেরা যুদ্ধের প্রথম প্রহরেই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। উপজেলার ফুলবাড়ী আজিরিয়া ফাজিল মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছিল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। এলাকার ছাত্র ও যুব সমাজকে অস্ত্র চালনা, শত্র“দের আক্রমণ এবং শত্র“দের ঘায়েল করতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তৎকালীন ইপিআর জওয়ান সুবেদার মতিউর রহমান ও হাবিলদার আবু আহমদ। তখন ফুলবাড়ী থেকে যোগাযোগ করা হতো বিয়ানীবাজারের মেওয়া ক্যাম্পে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করতে স্থানীয়ভাবে কাজ করেন কফিল উদ্দিন চৌধুরী (রণকেলী), ইকবাল আহমদ চৌধুরী (রফিপুর), আব্দুল জব্বার (বারকোট), জয়নাল মহসীন (ভাদেশ্বর), ওজি আহমদ চৌধুরী (ফুলবাড়ী), আমান উদ্দিন (চন্দরপুর), আপ্তার আলী আতাই মিয়া (দাঁড়িপাতন), মোহাম্মদ আব্দুল মতিন (কানিশাইল), মোহাম্মদ ওমর আলী (নগর), সিরাজ উদ্দিন আহমদ (বহরগ্রাম), নোমান আহমদ চৌধুরী (ভাদেশ্বর), আবুল বশর মোহাম্মদ সদরুল উলা চৌধুরী (কানিশাইল), সালেহ আহমদ চৌধুরী (রানাপিং), তৌফিক সিরাজ (ভাদেশ্বর), রইস উদ্দিন (দত্তরাইল), কালিপদ দত্ত চৌধুরী (দত্তরাইল), আব্দুর রহমান (রায়গড়), আব্দুল মঈদ ফটিক মিয়া (নগর), শামসুদ্দিন চৌধুরী বাদশা (রণকেশী), মতছির আলী সারং (লক্ষ্মীপাশা), সৈয়দি আনোয়ার হোসেন, সোনা মিয়া (নগর), আব্দুর রব (চন্দরপুর), এম এ ছালিক (ভাদেশ্বর), শফিক উদ্দিন আহমদ (কানিশাইল), গোলাম নুরানী চৌধুরী হুমায়ুন (রণকেলী), সিরাজুল জব্বার চৌধুরী (রণকেলী), এম এ বাসিত (বরায়া), খয়রুল হুদা চৌধুরী (কানিশাইল), শাহাব উদ্দিন (আছিরগঞ্জ), আব্দুল গফুর (আছিরগঞ্জ), খেতু মিয়া (হেতিমগঞ্জ), মহিদুজ্জামান চৌধুরী (ভাদেশ্বর) প্রমুখ।
জাতীয়ভাবে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন, তাঁরা হলেন অ্যাডভোকেট আব্দুর রহিম (কালিদাসপাড়া, রানাপিং), মসুদ আহমদ চৌধুরী (রণকেলী), আলতাফুর রহমান (ফুলবাড়ী), নাজিম কয়েস চৌধুরী (ভাদেশ্বর), সোয়েব আহমদ চৌধুরী (রণকেলী) প্রমুখ। ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল দেওয়ান ফরিদ গাজীকে সিলেট জেলা প্রশাসক, গোলাপগঞ্জের কৃতীসন্তান মসুদ আহমদ চৌধুরীকে সিলেট মহকুমা প্রশাসক, মোহাম্মদ ইলিয়াসকে মৌলভীবাজার মহকুমা প্রশাসক, মোস্তফা আলীকে হবিগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক এবং আব্দুল হককে সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
গোলাপগঞ্জের মুক্তিকামী জনগণ শুধু গোলাপগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, তাঁরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায়। ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণসহ প্রবাসের বিভিন্ন দেশে গোলাপগঞ্জের যেসব মুক্তিকামী জনগণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত ও মুক্তিযুদ্ধে চাঁদা তুলে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র কিনতে সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে উলে¬খযোগ্য কয়েকজন হলেন তাসাদ্দুক আহমদ (ভাদেশ্বর), ফারুক আহমদ চৌধুরী (ফুলবাড়ী), হাফিজ মজির উদ্দিন (বাগিরঘাট), আতাউর রহমান খান (চন্দনভাগ, গোলাপগঞ্জ), খন্দকার ফরিদ উদ্দিন (চৌঘরী, গোলাপগঞ্জ), মো. আব্দুল ময়ীদ (চন্দরপুর) তারা মিয়া খান (ফাজিলপুর, গোলাপগঞ্জ) প্রমুখ।
৮ এপ্রিল রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সিলেট শহর পুনর্দখল করে নেয়। এ সময় মুক্তিসেনারা কৌশল গ্রহণের জন্য ৩টি গ্র“পে বিভক্ত হয়ে একটি শেরপুর হয়ে মৌলভীবাজারের দিকে, একটি খাদিমনগর জৈন্তা হয়ে তামাবিলের দিকে এবং অপরটি গোলাপগঞ্জ বইটিকর এলাকায় প্রতিরক্ষাব্যূহরচনা করেন।১
১০ এপ্রিল বিয়ানীবাজারের মেওয়া থেকে ফুলবাড়ী মাদ্রাসায় স্থাপিত ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ট্রাকযোগে খাবার নিয়ে আসা হচ্ছিল। ট্রাকটিতে ছিলেন ফুলবাড়ীর লাল মিয়াসহ ৪ জন আনসার। গাড়িচালক ছিলেন জকিগঞ্জের বাসিন্দা এখলাছ হোসেন (ছুতু মিয়া)। খাদ্য বহনকারী ট্রাক ছাড়াও রাস্তায় কয়েকটি ট্রাক ও গাড়ি চলাচল করছিল। হঠাৎ খাদ্যবাহী ট্রাকটিকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে পাকিস্তানি বোমারু বিমান। গোলাপগঞ্জের কাছে, মৌলভীর পুলের নিচে আত্মগোপন করার জন্য গাড়ি থেকে নামার আগেই পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে গাড়িটি আক্রান্ত হয়। মেশিনগানের গুলিতে সাথে সাথে শহীদ হন ফুলবাড়ীর কিশোর মতিউর রহমান, মোহাম্মদপুরের ভেড়াই মিয়া ঠিকাদার, সাইদুর রহমান ও গাড়িচালক জকিগঞ্জ উপজেলার এখলাছ হোসেন (ছুতু মিয়া)। গুলির আঘাতে লাল মিয়ার ডান হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
পাকিস্তানি বাহিনী সিলেট শহরে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে গোলাপগঞ্জের দিকে অগ্রসর হলে ফুলবাড়ীর বইটিকরে ইপিআর ও আনসার মুজাহিদের প্রায় ৩০০ জনের একটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে ২৪ এপ্রিল এক সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়। তাদের সহযোগিতা করে সুতারকান্দি সীমান্ত দিয়ে আসা বিএসএফের প্রায় ৩০০ জনের একটি দল। প্রায় আধঘণ্টা স্থায়ী এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ২৬ এপ্রিল সকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল উপজেলার ঢাকাদক্ষিণে প্রবেশ করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের খুঁজতে থাকে। তারা তখন স্থানীয় ব্যাংক,দোকানপাট লুটপাট করে। শ্রীচৈতন্য দেবের মন্দির ও দত্তরাইল গ্রামের কালিকৃষ্ণ চৌধুরীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে লুটপাট করে এবং বারকোট গ্রামের মনোরঞ্জন চক্রবর্তী নিতাইকে হত্যা করে।২
১২ সেপ্টেম্বর গোলাপগঞ্জের সীমান্তসংলগ্ন হাকালুকি হাওরে চলে দুর্ধর্ষ এক অপারেশন। ৪ নম্বর সেক্টরের কুকিতল সাব-সেক্টরের ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন আবুল খায়ের চৌধুরী, ছাত্র ইউনিয়নের নেতা তজম্মুল আলী ও লুৎফুর রহমান। মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি বড়লেখার ডিমাই গ্রামে অবস্থানের পর ফেঞ্চুগঞ্জ থানার চান্দভাগ চা-বাগানের উদ্দেশে রওনা দিলে গন্তব্যস্থলে পৌঁছার আগেই ভোর হয়ে যায়। এ সময় একটি স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্রাম নিতে গেলে সংবাদ পেয়েই তাঁদের ওপর আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। মুখোমুখি সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর ২৫ জন সেনা নিহত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর ৩ জন জওয়ান শহীদ হন।
সুন্দিশাইলে গণহত্যা :
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর (৪ রমজান) বারপুঞ্জি ক্যাম্প থেকে ৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল উপজেলার পশ্চিম আমুড়া ইউনিয়নের সুন্দিশাইল গ্রামে এসে পৌঁছে। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্রাম নেন। কিন্তু গোপন সূত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের আগমনের সংবাদ পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর এক দোসর সংবাদটি পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়। তখন পাকিস্তানি সেনারা এলাকায় আক্রমণ চালালে মুক্তিযোদ্ধারা নিরীহ এলাকাবাসীর কথা চিন্তা করে পাল্টা আক্রমণ না করে পাশের টিলায় গিয়ে আশ্রয় নেন। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিসেনাদের না পেয়ে তাঁদের আশ্রয়দাতা হিসেবে এলাকার ১৭ জন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে হত্যার জন্য সুন্দিশাইলে হজরত জাহান শাহ মৌলার মাজারসংলগ্ন মোকামটিলায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে তা লক্ষ করছিলেন। একপর্যায়ে সুযোগ বুঝে এবং অনেকটা বাধ্য হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালান। এ সুযোগেআটক হওয়া লোকজন পালিয়ে গিয়ে তাঁদের জীবন রক্ষা করেন। দীর্ঘ সময় ধরে চলা পাল্টাপাল্টি আক্রমণে দুজন শহীদ হন এবং আহত হন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।৩
২৬ অক্টোবর (৫ রমজান) মোকামটিলায় অবস্থিত হজরত জাহান শাহ মৌলার মাজারসংলগ্ন মসজিদে মুসলি¬রা আসরের নামাজ পড়ে বের হচ্ছিলেন। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর স্থানীয় এক দোসরের নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানি সেনা গণহত্যা চালিয়ে একসাথে হত্যা করে ২১ জন রোজাদার সাধারণ মুসলি¬কে। এই ২১ জন শহীদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিবাহিনীর সদস্য না হলেও দেশ স্বাধীনের রণাঙ্গনের সাথে তাঁদের কারো সন্তান বা কারো আত্মীয়স্বজন জড়িত ছিলেন।৪
২৫ ও ২৬ অক্টোবর সুন্দিশাইল মোকামটিলায় আক্রমণ চালিয়ে ২ দিনে ২৩ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। নির্মম এ গণহত্যা ছিল গোলাপগঞ্জ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় গণহত্যা।
সুন্দিশাইল মোকামটিলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে নির্মমভাবে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁরা হলেন ১. শহীদ খুর্শেদ আলী (সুন্দিশাইল), বাবার নাম সরাফত আলী লস্কর, ২. শহীদ আসদ আলী (সুন্দিশাইল), বাবার নাম আব্দুল হামিদ, ৩. শহীদ তুতা মিয়া (সুন্দিশাইল), বাবার নাম আব্দুল মজিদ মাস্টার, ৪. শহীদ চান্দ মিয়া (সুন্দিশাইল), বাবার নাম মছির আলী, ৫. শহীদ মুবেশ্বর আলী (সুন্দিশাইল), বাবার নাম ইদ্রিছ আলী, ৬. শহীদ কুটু চান্দ মিয়া (সুন্দিশাইল), বাবার নাম আইয়ূব আলী, ৭. শহীদ ওয়ারিছ আলী (সুন্দিশাইল), বাবার নাম ওয়াজিদ আলী, ৮. শহীদ মস্তন আলী (সুন্দিশাইল), বাবার নাম মজর আলী, ৯. শহীদ ওহাব আলী (সুন্দিশাইল), বাবার নাম জছির আলী, ১০. শহীদ সুনু মিয়া (সুন্দিশাইল), বাবার নাম রশিদ আলী, ১১. শহীদ সমুজ আলী (সুন্দিশাইল), বাবার নাম ওয়াজিদ আলী, ১২. শহীদ মাতাই মিয়া (সুন্দিশাইল), ১৩. শহীদ আনু মিয়া (সুন্দিশাইল), বাবার নাম আব্দুল গনি, ১৪. শহীদ কুটলা মিয়া, (সুন্দিশাইল), ১৫. শহীদ মুতলিব আলী (কালিডহর, চন্দরপুর), বাবার নাম মিজান আলী, ১৬. শহীদ মানিক মিয়া (সুন্দিশাইল), ১৭. শহীদ চুনু মিয়া (কালিডহর, চন্দরপুর), বাবার নাম জহির আলী, ১৮. শহীদ খালিক মিয়া (সুন্দিশাইল), ১৯. শহীদ লুলু মিয়া (মীরগঞ্জ, ভাদেশ্বর), বাবার নাম মুজম্মিল আলী। শহীদ আশফাক আহমদ (রানাপিং), বাবার নাম মৌলভী আকাদছ আলী। অপর ৩ জন শহীদের নাম ও ঠিকানা এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।৫
নালিউরি যুদ্ধ :
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর মাহবুবুর রহমানের৬ নেতৃত্বে প্রায় ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা সুতারকান্দি-বিয়ানীবাজার হয়ে ভোর হওয়ার কিছুক্ষণ আগে গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের নালিউরি গ্রামে এসে অবস্থান নেন। বীর সন্তানদের উপস্থিতিতে গ্রামবাসী আনন্দিত হয়ে তাঁদের আহার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নালিউরি গ্রাম থেকে মাত্র দেড় মাইল উত্তরে ঢাকাদক্ষিণ বাজারে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের ঘাঁটি ছিল। বিকেলবেলা মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা রেকি করতে পরিকল্পনামতো বেরিয়ে পড়েন। জানা যায়, তখন একটি হিন্দুবাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা আমান উদ্দিন তাঁর অসুস্থতার জন্য বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সে সময় একজন বালক এসে খবর দেয় যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কয়েকজন সেনা নিয়ে একটি বাস ভাদেশ্বরের দিকে যাচ্ছে। এ সংবাদ পাওয়ামাত্র আমান উদ্দিন সেই ছেলেটির সহযোগিতায় একখানা কোদাল নিয়ে রাস্তায় গিয়ে একটি অ্যান্টিট্যাংক মাইন পুঁতে রাখেন। বাসটি ফিরে এসে মাইনের ওপর ওঠামাত্রই তা বিস্ফোরিত হয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় দুজন হানাদার এবং বাকিরা লক্ষণাবন্দ ইউনিয়নের মুকিতলা গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। পরে মুকিতলায় আরেকজন পাকিস্তানি সেনাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। পরের দিন বাকি পাকিস্তানি সেনারা ঢাকাদক্ষিণে এসে অবস্থান গ্রহণ করে।৭ কিন্তু গোলাপগঞ্জের অনেক মুক্তিযোদ্ধার ভাষ্যমতে পাকিস্তানি সেনারা ১২ ডিসেম্বর ঢাকাদক্ষিণ ত্যাগ করে গোলাপগঞ্জে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। একই দিন তারা গোলাপগঞ্জ এলাকা থেকে সিলেট শহরে চলে যায়।
ঢাকাদক্ষিণ মুক্ত দিবস :
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর ঢাকাদক্ষিণ পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয় বলে জনশ্র“তি আছে। সে জন্যই এলাকাবাসী ১১ ডিসেম্বরকেই ঢাকাদক্ষিণ মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।৮
গোলাপগঞ্জ মুক্ত দিবস :
১২ ডিসেম্বর গোলাপগঞ্জ থানা শহর পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ওই দিন দুপুরবেলা পাকিস্তানি সেনাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হন। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে সিলেট শহরে আশ্রয় নেয়। ওই দিন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তখন থানা সদরে স্বাধীনবাংলার লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন। তখন গোলাম নুরানী চৌধুরী হুমায়ুনসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এবং মুক্তিকামী জনতা উপস্থিত ছিলেন।৯ পরবর্তী সময়ে গোলাপগঞ্জ উপজেলার প্রশাসক নিয়োগ করা হয় মুহিবুর রহমান এহিয়াকে।
সারা দেশের মতো এভাবেই পাকিস্তানি বাহিনীমুক্ত হয় গোলাপগঞ্জ। পরাজিত পাকিস্তানি সেনারা অবশেষে পলায়ন করে থানা ছেড়ে সিলেট শহরে আশ্রয় নেয়। সেখানেও তাদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পারেনি। ত্রিমুখী আক্রমণে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। গোলাপগঞ্জ, সিলেট, ঢাকাসহ একের পর এক অঞ্চল পাকিস্তানি বাহিনী থেকে মুক্ত হতে থাকে। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করতে অনেকেই বিসর্জন দিয়েছেন তাঁদের প্রাণ। মা-বোনেরা হারিয়েছেন তাঁদের সম্ভ্রম। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতাযুদ্ধের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন কীর্তিমান অনেক ব্যক্তি।
গোলাপগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা :
বাঘা ইউনিয়ন : সায়েক উদ্দীন চৌধুরী ও জুম্মা মিয়া, বীর বিক্রম।
গোলাপগঞ্জ ইউনিয়ন ও পৌরসভা : শফিকুর রহমান চৌধুরী, বীর উত্তম (রণকেলী), ল্যান্স নায়েক নুরুল হক চৌধুরী (শেরপুর), আতিক আহমদ চৌধুরী (রণকেলী), কর্নেল মুজিবুর রহমান (রণকেলী), লুলু মিয়া (শেরপুর), নুরুল হক চৌধুরী (শেরপুর), নর্মদা চক্রবর্তী (রানাপিং), কাবু মিয়া (গীর্দ্দ) ও মনোয়ারা বেগম (শেরপুর)।
ফুলবাড়ী ইউনিয়ন : আব্দুল মান্নান, ছয়াব আলী, সিপাহি ইসবর আলী ও মতিউর রহমান।
লক্ষ্মীপাশা ইউনিয়ন : মস্তফা কামাল, মুফিজ আলী ও মোক্তদা কামাল।
বুধবারীবাজার ইউনিয়ন : আফতাব আলী (চন্দরপুর), চুনু মিয়া (কালিডহর), সৈয়দ ইয়াছিন আলী (কালিডহর), নামর হোসেন (বাণীগ্রাম), আব্দুল মুতলিব ও লে. কর্নেল আনোয়ার হোসেন।
ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়ন : মনোরঞ্জন চক্রবর্তী (বারকোট), এখলাছ উদ্দিন (ইপিআর) জ্ঞানেন্দ্র চক্রবর্তী (বারকোট), মনির উদ্দিন (দত্তরাইল) ও আনুর আলী।
লক্ষণাবন্দ ইউনিয়ন : সুবেদার মেজর শওকত আলী (ফুলসাইন্দ), আব্দুস শহীদ (ফুলসাইন্দ), সানোয়ার আলী (মুকিতলা), আব্দুর রফিক, তৌহিদ আলী, বীর বিক্রম, এম এ শওকত আলী, ইরফান আলী ও সৈয়দ আমিরুল ইসলাম।
ভাদেশ্বর ইউনিয়ন : ইরফান আলী (ভাদেশ্বর), তুতি মিয়া (ভাদেশ্বর), অ্যাডভোকেট আব্দুল হাফিজ, সইদ আলী (পূর্বভাগ), নায়েক আব্দুল খালিক, আশুক মিয়া, আহমদ লালা, মানিক উদ্দিন, সাজে আলী ও সৈয়দ ওয়াসিক আলী।
আমুড়া ইউনিয়ন : মসকন্দ আলী ও আহমদ আলী।
বাদেপাশা ইউনিয়ন : সমির উদ্দিন (আমকোনা), সোহরাব উদ্দিন তফাদার, হাজী মাতু মিয়া, ছমির উদ্দিন, সোহরাব উদ্দিন ও আব্দুর রাজ্জাক।
এ ছাড়া সুন্দিশাইল এলাকায় আরো ২৩ জন লোক শহীদ হন, যাঁদের তালিকা আগে উল্লেখ করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত গোলাপগঞ্জের কৃতীসন্তান :
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্বের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ধরনের পদক প্রদান করা হয়েছে। এই পদকগুলো কয়েক স্তরে বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে ১. বীরশ্রেষ্ঠ, ২. বীর উত্তম, ৩. বীর বিক্রম, ৪. বীর প্রতীক। বীরশ্রেষ্ঠ বীরত্বের জন্য প্রদত্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক। যুদ্ধক্ষেত্রে সাহস ও আত্মত্যাগের নিদর্শন স্থাপনকারী যোদ্ধাকে স্বীকৃতিস্বরূপ এই পদক দেয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ ৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে এই পদক দেয়া হয়। বীরত্বের জন্য প্রদত্ত বাংলাদেশের অন্যান্য পদক হলো গুরুত্বের ক্রমানুসারে বীর উত্তম (৬৮ জন), বীর বিক্রম (১৭৫ জন), বীর প্রতীক (৪২৬ জন)। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের পরপরই এই পদকগুলো দেয়া হয়। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গেজেট নোটিফিকেশন নম্বর ৮/২৫/ডি-১/৭২-১৩৭৮ প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৬৭৬ জন পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার নাম ঘোষণা করা হয়।১০
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সিলেট অঞ্চলের ৩৩ জন সরকারি পদক পেয়েছেন। এর মধ্যে গোলাপগঞ্জের ছিলেন ১৩ জন।
বীর উত্তম :
১. ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান, বীর উত্তম (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল), রানাপিং গোলাপগঞ্জ।
২. সুবেদার আফতাব আলী, বীর উত্তম ও বীর প্রতীক (পরবর্তী সময়ে সুবেদার মেজর ও অনারারি ক্যাপ্টেন), দক্ষিণভাগ, ভাদেশ্বর।
৩. শহীদ নায়েক শফিক উদ্দিন চৌধুরী, বীর উত্তম, রণকেলী, গোলাপগঞ্জ পৌরসভা।
বীর বিক্রম :
১. লে. শমসের মবিন চৌধুরী, বীর বিক্রম (পরবর্তী সময়ে মেজর), দক্ষিণভাগ, ভাদেশ্বর।
২. সুবেদার ফখর উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, বীর বিক্রম (পরবর্তী সময়ে মেজর), রণকেলী, গোলাপগঞ্জ পৌরসভা।
৩. শহীদ হাবিলদার জুম্মা মিয়া, বীর বিক্রম, হেতিমগঞ্জ, বাঘা।
৪. ইয়ামিন চৌধুরী, বীর বিক্রম, রণকেলী, গোলাপগঞ্জ পৌরসভা।
৫. কনস্টেবল মো. তৌহিদ আলী, বীর বিক্রম, মুকিতলা, লক্ষণাবন্দ।
৬. হাবিলদার তাহের আলী, বীর বিক্রম (পরবর্তী সময়ে অনারারি ক্যাপ্টেন), মাইজভাগ, ফুলবাড়ী।
বীর প্রতীক :
১. জি এন ফখর উদ্দিন চৌধুরী, বীর প্রতীক, ফুলবাড়ী।
২. নায়েক আব্দুল মালিক, বীর প্রতীক, নগর, ঢাকাদক্ষিণ।
৩. মোহাম্মদ আব্দুস সালাম, বীর প্রতীক (পরবর্তী সময়ে কর্নেল), বরায়া উত্তরভাগ, ফুলবাড়ী।
৪. সিপাহি নানু মিয়া, বীর প্রতীক, দাড়িপাতন, গোলাপগঞ্জ।
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক, সম্পাদক: আমাদের প্রতিদিন
————————————————
তথ্য সূত্র :
১. মেজর জেনারেল (অব.) আজিজুর রহমানের (বীর উত্তম) সাথে সাক্ষাৎকার, ১১ জুলাই ২০১৪।
২. গোলাপগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ ও আন্দোলন (প্রবন্ধ) : আনোয়ার শাহজাহান, আমাদের প্রতিদিন, ১২ ডিসেম্বর ২০১৩।
৩. হাজী রফিক উদ্দিন, সুন্দিশাইল গ্রামের শহীদ আসদ আলীর দ্বিতীয় ছেলের সাথে সাক্ষাৎকার, ৬ জুন ২০১৪।
৪. জাহাঙ্গীর মজিদ চৌধুরী, সুন্দিশাইল গ্রামের শহীদ তুতা মিয়ার (আব্দুল মুমিত চৌধুরী) তৃতীয় ছেলের সাথে সাক্ষাৎকার, ৬ জুন ২০১৪।
৫. ‘গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থটি ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশের সময় সুন্দিশাইলে ২৩ জন শহীদের মধ্যে ১৮ জনের নাম সংগ্রহ করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে সুন্দিশাইল গ্রামে শহীদদের স্মরণে গঠিত ‘সুন্দিশাইল ২৩ শহীদ স্মৃতি সংসদ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের প্রতিদিন-এর সিলেট প্রতিনিধি ফয়ছল আলম (ঢাকাদক্ষিণ, কানিশাইল) ও সুন্দিশাইল ২৩ শহীদ স্মৃতি সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এ ওয়াদুদ এমরুলের (আমুড়া) প্রচেষ্টায় ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ভাদেশ্বর শেখপুর গ্রামের শহীদ লুলু মিয়ার পরিচয় সংগ্রহ করা হয়। তাঁর মুক্তিবার্তা নম্বর ০৫০১০৩০০৪৪। পরবর্তী সময়ে শহীদ আশফাক আহমদের পরিচিতি উদ্ধার করা হয়।
৬. মাহবুবুর রহমান, সাবেক মন্ত্রী নুরুর রহমান চৌধুরীর (ফুলবাড়ী) ধর্মপুত্র।
৭. সাপ্তাহিক জনজীবন, লন্ডন, মার্চ ২০১৪।
৮. চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ, সম্পাদনায় কাজল কান্তি দাস, ঢাকাদক্ষিণ ক্রীড়াচক্র, প্রকাশকাল ২০১৩।
৯. গোলাপগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ ও আন্দোলন (প্রবন্ধ) : আনোয়ার শাহজাহান, আমাদের প্রতিদিন, ১২ ডিসেম্বর ২০১৩।
১০. স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা : আনোয়ার শাহজাহান। প্রকাশকাল ২০১৬।