রোদ-বৃষ্টি ডিঙ্গিয়ে ছুটেচলে সাইকেল বালিকারা!
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:৫২:৪২,অপরাহ্ন ২০ জুন ২০১৯ | সংবাদটি ১১৬৫ বার পঠিত
ঠাকুরগাঁও থেকে জুনাইদ কবির : শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে প্রতিদিন কখনো রোদে পুড়ে, কখনো বা বৃষ্টিতে ভিজে সাইকেলে ছুটে চলে ঠাকুরগাঁওয়ের সাইকেল বালিকারা।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই মেয়েরা বাইসাইকেলে করে স্কুলে যাওয়া আসা করে নিয়মিত। তাই এলাকায় এরা সবাই সাইকেল বালিকা নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। তাদের সাইকেল বহর যখন শুরু হয়, পথচারীরা সেই দৃশ্য মনোযোগেই অবলোকন করেন।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু কিংবা শেষ হলে এমন মনোরম দৃশ্য সকলের চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে গিলাবাড়ী, জামালপুর, ভাউলার হাট, সালন্দর, আকঁচা, খোচাবাড়ি, চিলারং, আউলিয়াপুর ইউনিয়ন থেকেও মেয়েরা বাইসাইকেলে করে স্কুল-কলেজে আসে ।
তবে এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পেছনের কাহিনী খুব একটা সুখকর নয়। শুধুমাত্র শিক্ষার আলো পেতে প্রতিদিন বেশ দূরের পথ পাড়ি দিতে হয় তাদের। ওরা কেউই ধনী ঘরের সন্তান নয়। তারা কেউ শ্রমিক, কারো বাবা দিনমজুর কিংবা মা এলাকার সঞ্চয় সমিতি থেকে কিন্তিতে টাকা নিয়ে মেয়েদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে বাইসাইকেল কিনে দিয়েছেন। তবুও শিক্ষার আলো পৌঁছে যাক ঘরে এটাই প্রত্যাশা তাদের।
সদর উপজেলার গিলাবাড়ী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইকেল বালিকা আশরাফি ফাইমদা জানায়, পড়াশোনার অনেক খরচ। তবু তাদের পড়াশোনা করে অনেক বড় হতে হবে তাকে। তাদের এলাকা থেকে স্কুলে আসতে গাড়ি কিংবা রিকশা পাওয়া যায় না। পেলেও আসতে যেতে প্রতিদিন ৪০-৫০ টাকা লাগে। তাই বাইসাকেল কিনে দিয়েছেন তার বাবা-মা।
একই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তার বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, বিদ্যালয়ে আসতে যেতে প্রথম প্রথম বখাটে ছেলেদের উৎপাতসহ ছোট খাটো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতো। বিশেষ করে দীর্ঘ পথ কাঁচা রাসÍা থাকায় বর্ষা মৌসুমে পিচ্ছিল পথে দুর্ঘটনা ঘটতো। এখন সবই সহে গেছে।
নবম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী উর্মী বলেন, আগে বাইসাইকেল চালালে গ্রামে মানুষেরা বিভিন্ন কথা বলতো। এখন আর কেউ কিছু বলে না। কম সময়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করতে পারায় বাকি সময়টা পড়ার টেবিলে দিতে পারি।
এদিকে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের স্থানীয় বে-সরকারি সংস্থা ইকো সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন ইএসডিও ঠাকুরগাঁওয়ে ৫ উপজেলার ২ শতাধিক বাইসাইকেল দেন। এদের সকলই দরিদ্র পরিবারে সদস্য। তাদের পরিবার থেকে সাইকেল কিনে দেওয়ার মতো সামর্থ নাই। তাই পিছিয়ে পড়া এসব শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া যেন থেমে না যায় সেজন্য এই সহযোগিতা বলে জানায় ইএসডিও কর্তৃপক্ষ।
ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক ড.মুহম্মদ মহীদ উজ জামান বলেন, বাইসাইকেল পেয়ে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে পারছে। এখন তাদের লেখাপাড়ায় মনোনিবেশও হয়েছে। উৎসাহ পাওয়ায় কেউ কেউ ভাল রেজাল্টও করছে। আগামীতে এ ধরনের উদ্যোগ আরো বড় পরিসরে করার কথা জানান তিনি।
সদর উপজেলার নারগুন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মো; আব্দুল জলিল বলেন, গ্রামঞ্চলের মেয়েরা আর পিছিয়ে নেই। তারাও এখন শিক্ষায় এগিয়ে গেছে। এখন তারা অনেক দিন থেকে সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে আসে। নানা রকম সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করে।
স্কুল শেষে পবিরারের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করছে এসব মেয়েরা। অনেক দূর থেকে মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে আসে প্রথমে রাস্তায় বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতো, মানুষ হাসাহাসি করত। এখন আর কোন সমস্যা হয়না মেয়েরা যখন দলবদ্ধ হয়ে আসা যাওয়া করে, তখন পথচারিরা সরে দাঁড়ায়।
ঠাকুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, শিক্ষা ক্ষেত্রে এখন বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলের মেয়েরা অনেক এগিয়ে। তারা বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুল কলেজে যাওয়া আসা করছে। এতে শিক্ষার্থীদের সময় নষ্ট হচ্ছে না। পাশাপাশি বখাটেদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। তবে বাইসাইকেল চালক শিক্ষার্থীদের বেশি করে পুষ্টিযুক্ত খাদ্য দিতে হবে, যাতে তাদের পুষ্টির অভাব না হয়।
ঠাকুরগাঁও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাদেক কুরাইশী বলেন, মেয়েরা এখন সামাজিক বাধা অতিক্রম করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। পড়ালেখায় ছেলেদের চেয়ে জেলার মেয়েরা এগিয়ে আছে। এসময় তাদের সার্বিক সহাযোগিতা করাও আশ্বাস দেন তিনি।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ড.কে এম কামরুজ্জামান সেলিম বলেন, এ জেলার মেয়েরা সাইকেল যোগে স্কুলে যাওয়া আসা করে এটা প্রমাণ করে মেয়েছে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের যাত্রায় কোন বাধা কিংবা বিপত্তি হলে আমরা দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। আমরা সব সময় সজাগ আছি।