যে কোন পন্থায় ‘ইউরোপ’ যাত্রায় এগিয়ে সিলেটীরা
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:১৪:২২,অপরাহ্ন ১৯ মে ২০১৯ | সংবাদটি ৮২৭ বার পঠিত
ডেস্ক: ‘ইতালি পৌঁছে দেবো, আগে কোনো টাকা দিতে হবে না।’ এ রকম শতভাগ নিশ্চয়তায় এজেন্সির মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ হন মৌলভীবাজারের বড়লেখার দুই যুবক ছয়দুল ও আলী হোসেন (ছদ্মনাম)। সম্পর্কে তারা মামা-ভাগ্নে। বাংলাদেশ থেকে কয়েক দেশ ঘুরিয়ে তাদের পৌঁছানো হয় লিবিয়ায়। সেখানে দালালের হাতে জিম্মি হয়ে থাকেন দু’মাস। ফোন আসে বাড়িতে, দালালরা তাদের জিম্মি করে রেখেছেন, টাকা না দিলে মেরে ফেলবেন।অসহায় দুই যুবকের পরিবার। মধ্যস্থতাকারীর কাছে রাখা ১৪ লাখ টাকা এনে তুলে দেন এজেন্সির হাতে। ওই টাকা হাতবদল হয় দালালের কাছে। ক’দিন পর আবারও ফোন আসে তাদের বাড়িতে। চারদিন ধরে দালালরা তাদের খেতে দেননি। খাবার বলতে চারদিনে দিয়েছে কেবল একটি রুটি।এবার আরও তিন লাখ টাকা করে দিতে হবে, নয়তো দালালরা তাদের মেরে ফেলবেন। অসহায় দুই পরিবার সময় মতো টাকা দিতে পারেনি। এ জন্য তাদের বিক্রি করা হয় আরেক দালাল চক্রের কাছে। নতুন দালালচক্র তাদের দু’জনের মুক্তিপণ চেয়ে বসে আট লাখ টাকা। ওই টাকা না দিলে আবারও অন্য দালালের কাছে বিক্রি করে দেবে। এ কথা শুনে ঘুম নেই দু’টি পরিবারের মানুষের।শেষপর্যন্ত অনেক কষ্টে টাকা যোগাড় হলো। এজেন্সির মাধ্যমে টাকা চলে যায় দালালদের হাতে। অবশেষে তাদের মুক্তি মিলে, সাগরপথে পাঠানো হয় ইতালিতে। সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করেই ইউরোপ যাওয়ার দুর্বিসহ প্রথম ধাপটি পেরোলেন মামা-ভাগ্নে। ঘটনাটি ২০১৮ সালের।
২০১৭ সালে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের দনারাম এলাকার রাহি(ছদ্মনাম), ওমান থেকে ইউরোপ যাওয়ার উদ্দেশে আট লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হন এজেন্সির কাছে। ফাঁড়িপথে দালালরা তাকে পৌঁছায় ইরানে। সেখানে হবিগঞ্জের এক দালালের হাওলা হন তিনি। কথা ছিল ইতালি পৌঁছে টাকা দেওয়ার। কিন্তু ইরান পৌঁছেই জিম্মি হন দালালের হাতে। পুরো আট লাখ টাকা এখানেই গচ্ছা। ওই টাকা হাতে পেয়ে দালালরা তাকে পৌঁছায় তুরস্কের একটি জঙ্গলে। ইরান থেকে তিন রাত পায়ে হেঁটে পাহাড়, জঙ্গলের পর জঙ্গল পেরিয়ে চোরাই পথ ধরে যেতে গিয়ে মানুষের অনেক কঙ্কালসার পড়ে থাকতে দেখেছেন রাহি। দালালদের নির্মমনির্যাতনে এভাবে পথেই স্বপ্নভঙ্গ কতো পরিবারের।
তুরস্কের জঙ্গলে আটকে রেখে দালালরা আরও তিন লাখ টাকাদাবি করেন। বাড়িতে অসহায় রাহির বাবা ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থায়। সৌদিতে থাকা রাহির চাচার কাছথেকে তিন লাখ টাকা ঋণ করে এজেন্সির হাতে তুলে দেন জিম্মি দশা থেকে ছেলেকে উদ্ধারে।এরপর তুরস্ক থেকে আরও ৭৪ হাজার টাকা দিয়ে পাড়ি জমান সাগরপথে ট্রলারে। ওই যাত্রায় ট্রলারে রাহিসহ বাংলাদেশি পাঁচ যুবক ছিলেন; বাকিরা যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার নাগরিক। এদের মধ্যে নারী-শিশুও ছিলেন। উত্তাল সাগরে প্রায় আধাঘণ্টা চলে ট্রলারটি ডুবে যায়। ভাগ্যিস কোস্ট গার্ডের একটি টহল দল তাদের উদ্ধার করে ফের তুরস্কে নিয়ে আসে। তখন রাহির ভাষ্য ছিল এমন, ‘আমি গরীবের পুয়া (ছেলে), সাগরে মরণের হাত থেকে যখন ফিরছি, তখন ঠিকই ইউরোপ যাইমু (যাবো)।নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আবারও জীবন বাজি রাখেন রাহি। এবার নিজে ট্রলারের মাঝি হয়ে বাহনটি চালিয়ে যান সাগরপথে। বিনিময়ে ২০ হাজার টাকা কম; দালালদের ৫০ হাজার টাকা দিতে হয় তাকে। গ্রিসের একটি দ্বীপে পৌঁছায় তাদের বহনকারী ট্রলার। সেখান থেকে জাহাজে এথেন্স হয়ে ইতালি পৌঁছে ছয় মাসের ওয়ার্ক পারমিট নেন। পরে ইতালি থেকে উজবেকিস্তান হয়ে আরও দুইলাখ ৮০ হাজার টাকা চুক্তিতে ২০১৮ সালের প্রথম দিকে ফ্রান্স পৌঁছান রাহি। তার ভাষ্যমতে, ইরান ও তুরস্কে বাংলাদেশি দালালদের অধিকাংশ সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের।সম্প্রতি লিবিয়া থেকে ৮০ জন অভিবাসী বহনকারী ট্রলার ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়া উপকূলে ভূমধ্যসাগরে ডুবে প্রাণ হারান সিলেট বিভাগের ২৭ যুবক। তিউনিসিয়ার জেলেরা অভিবাসীদের মাত্র ১৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করেন।এভাবে স্বপ্নের ইউরোপ যাত্রায় অনেকের ভাগ্য প্রসন্নহলেও আবার বেশির ভাগেরই সলিল সমাধি হয়েছে সাগরে। এছাড়া টাকা না দিতে পারলে অনেকে নিহত হয়েছেন দালালেরহাতে। তারপরও থেমে নেই ইউরোপযাত্রা। স্বপ্নের ঠিকানা খুঁজতে প্রতিনিয়তই অসংখ্য বাংলাদেশি অবৈধভাবে পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারান। সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনায় টনক নড়েছে সিলেট জেলা প্রশাসনের। সিলেটের জেলা প্রশাসক এম. কাজি এমদাদুল ইসলাম বলেন, অবৈধ এজেন্সির একটি তালিকা অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেলএজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) মাধ্যমে আমাদের হাতে এসেছে। এই তালিকা ধরে অভিযান চলছে। তবে দালালদের কোনো তালিকা আমাদের হাতে নেই।
আটাব সিলেটের সভাপতি আব্দুল জব্বার জলিল বলেন, সিলেটে প্রায় ২০০ বৈধ ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে। এর বাইরে অন্তত ৫০০ এজেন্সি সিলেট বিভাগে রয়েছে। এসব এজেন্সির কোনো অনুমোদন নেই। দালাল মারফতে চোরাই পথে তারা মানুষকে ইউরোপ পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।তাছাড়া সিলেটের মানুষের প্রবণতা, পাশের বাড়ির ছেলে লন্ডন-আমেরিকা, ফ্রান্স থেকে টাকা পাঠাচ্ছে, আমার ছেলে কেনো নয়। এই মানসিকতা থেকে সন্তানদের ভালো করে পড়ালেখা না করিয়ে ইউরোপ পাঠানোর চিন্তায় মেতে উঠেন বাবারা। এ জন্য অনেকে নিঃস্ব হয়েও টাকার যোগান দিচ্ছে। প্রতিফল স্বরূপ, অসফল হলে টাকাও যায়, সন্তানও যায়।এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আব্দুল জব্বার জলিল বলেন, ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায় সন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার চেয়ে এই টাকা দিয়ে দেশে ব্যবসা দিয়ে বসালে বছরে অন্তত লাখ টাকা আয় করতে পারবে।জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সময়ে ১৭ লাখ ৬৬হাজার ১৮৬ জন অভিবাসী ভূমধ্যসাগরে পাড়ি দেন। এভাবে সাগরপথে ইউরোপ যেতে অন্তত ১৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারান।