জীবনের গল্প – ডক্টর রেণু লুৎফা
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:০৯:৩১,অপরাহ্ন ২১ নভেম্বর ২০২২ | সংবাদটি ৩১০৪ বার পঠিত
ড. রেণু লুৎফা: নব্বুই দশকের শুরুর দিক। আমি তখন একটি সাপ্লিমেন্টারী স্কুলের সাথে জড়িত। স্কুলটি ছিল লন্ডনের নটিংহিল গেইটে অবস্থিত বাংলাদেশ সেন্টারের বেইজম্যান্টে। প্রতি রবিবারে স্থানীয় এলাকা ও আশ পাশের এলাকা থেকে বাংলাদেশী ছেলেমেয়েরা এখানে বাংলা পড়তে আসে। এরা সকলেই স্থানীয় প্রাইমারী ও সেকেন্ডারী স্কুলের বাংলাদেশী বংশদ্ভুত ছেলেমেয়ে। স্কুলের দায়িত্বে ছিলেন হল্যান্ড পার্ক স্কুলের বাংলার শিক্ষিক মিসেস রেহানা চৌধুরী, সাথে ছিলেন মিসেস খালিক,রেবা ওয়াহিদ আর আমি। পেশাগত ভাবে মিসেস চৌধুরী এবং আমি সরাসরি শিক্ষকতায় জড়িত ছিলাম । মিসেস চৌধুরী ছিলেন সেকেন্ডারী স্কুলের শিক্ষক, সরাসরি বাংলাদেশী ছেলেমেয়েদের পড়ানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে হল্যান্ড পার্ক সেকেন্ডারী স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। আমার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা এদেশেই। কেনজিংটন ও চেলসী কলেজে শিক্ষকতা করি। রেবা ওয়াহিদ সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়েছে। যারা ইংরাজীতে সহায়তা চান তাদের সাহায্য করে। এদেশেই জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা মেয়ে। ছেলেমেয়েদের সমস্যা সহজেই বুঝতে পারে। মিসেস খালিক কাজ করতেন ফ্রি ল্যান্স ইন্টারপিটার হিসেবে। অংকে ছিল তাঁর যশ।
আমরা শিক্ষকতা করলেও স্কুলের প্রাণ ছিলেন মিষ্টার মতিন। বেইজ ওয়াটার ও লিট্ল ভেনিস বাংলাদেশ এসাসিয়েশনের চেয়ার পারসন আব্দুল মতিন। একজন শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান মানুষ ছিলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে গাড়ি করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসতেন। অভিবাবকরা তাঁকে যেমন শ্রদ্ধা করতেন ছেলেমেয়েরাও তাঁকে শ্রদ্ধা করতো এবং ভালবাসতো। তিনি সকাল ন‘টা থেকে গাড়ি নিয়ে ছেলেমেয়েদের আনতে বেরুতেন এবং ক্লাস শেষে তাদের গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিতেন। দশটার সময় স্কুল শুরু হতো শেষ হতো বারোটার সময়। কিন্তু মিষ্টার মতিন ছেলে মেয়েদের বাড়ি ফিরিয়ে দিতে গিয়ে প্রায় দু‘টো বেজে যেতো। মিষ্টার মতিনের সাথে প্রায় দিনই মিসেস মতিনও থাকতেন। মিষ্টার মতিন তথাকথিত কমিউনিটি লিডার ছিলেন না। কোথাও গিয়ে গলা ছেড়ে বক্তৃতা দেবার কোন আগ্রহ তাঁর ছিল না। সব সময় অভিবাকদের (বাব- মা) এক সাথে আসতে বলতেন। যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গাড়ি করে তাদের নিয়েও আসতেন। দীর্ঘদিন তাঁর সাথে বেইজ ওয়াটার ও লিটল ভেনিস বাংলাদেশ এসোসিয়েশন এর সাথে জড়িত খেকে নানা ধরনের কমিউনিটির সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।
স্কুলে ছেলেমেয়েদের দুইটা গ্রুপ ছিল। বড় ও ছোট গ্রুপ। যারা জিসিএসসি ও এ লেবেল দেবে তাদের একটি গ্রুপ এবং বাকি সকলের একটি গ্রুপ। তখনো লন্ডনের প্রায় সবকয়টি স্কুলে বাংলায় জিসি এস সি ও এ লেবেল বিষয় চালু ছিল। মিসেস চৌধুরী তাঁর স্কুলের মাধ্যমে ছেলেদেয়েদের বাংলায় জি সি এস সি ও এ লেবেল পরীক্ষার ব্যবস্থা করতেন। সাপ্লিমেন্টারী স্কুল হলেও হল্যান্ড পার্ক স্কুল আমাদের ছেলেমেয়েদের তাদের ফী তে পরীক্ষা দেবার সুযোগ দিতো। বেশীর ভাগ ছেলেমেয়েরাই লেব্রোগ্রোভ, ওয়েষ্টবোর্ণ গ্রোব,ওয়েষ্ট বোর্ণ পার্ক, হ্রারো রোড এলাকা থেকে আসতো। বছরে ঘটা করে একবার ফলাফল ঘোষণাও করা হতো। বাবা মা সহ অভিবাবকরা উপস্থিত হতেন। বাংলাদেশ সেন্টারের পক্ষ থেকে তাদের সার্টিফিকেট ইস্যু করা হতো। আমার বড় মেয়েও এখান থেকে বি গ্রেডে জি সি এস সি পাশ করেছে। ছোট মেয়ে স্কুলে গেলেও পরীক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখায় নি। স্কুলটি বলতে গেলে বাংলাদেশীদের জন্য একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। নাচ ও গানের ক্লাসও হতো। নানা জাতীয় দিবসে স্কুলের ছেলেমেয়েরাই গান গাইতো।
একদিন সিড়ি বেয়ে নীচে নামছি, দেখি ৬/৭ জন কিশোর জড়ো হয়ে সিড়ির নীচে কি জানি একটি কাগজ পড়ার চেষ্টা করছে। নীচে নামতে নামতে জানতে চাইলাম, কি হেেচ্ছ? কি পড়ছো?
প্রায় সকলেই একই স¦রে একসাথে বলে উঠলো, বলা যাবে না, এটা প্রাইভেট। আমি আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলাম সোজা ক্লাসে। দলের সকলেই আগামীতে জি সি এস সি ও এ লেভেল পরীক্ষা দিবে বলে বাবা মার ধারনা। এরা স্কুলের ইয়ার ৮ আর নাইনে পড়ছে। বয়স ১৩ থেকে ১৪ বছর হবে।
কিছুক্ষন পর একটি ছেলে আমার কাছে এসে জানতে চাইলো সে কি আমার সাথে একটি প্রাইভেট বিষয় শেয়ার করতে পারে, একটাই শর্ত মিসেস চৌধুরীর সাথে শেয়ার করা যাবে না। বললাম মিসেস চৌধুরী স্কুলের ইনচার্জ , এই প্রাইভেট বিষয়টি যদি ক্ষতিকারক হয় তবে আমাকে অবশ্যই মিসেস চৌধুরীর সাথে শেয়ার করতে হবে। কিছুক্ষন হাঁ হু করে সে চলে গেল।
ক্লাস শেষের দিকে ছেলেটি আবার একটি কাগজে ‘ ধ্রুবারা‘ শব্দটি আগুছালো করে লিখে লুকিয়ে আমার হাতে তুলে দিয়ে জানতে চাইলো এর অর্থ কি? আমি অনেক চেষ্টা করে শব্দটি কি হবে বের করতে পারলাম না। বললাম, তুমি কোথায় পেয়েছো শব্দটি, হয়তো সঠিক করে লিখোনি। আমাকে দেখাও দেখি অর্থ বের করতে পারি কি না। ছেলেটি বললো, দেখানো যাবে না, এটা প্রাইভেট। বললাম ঠিক আছে, আমি না দেখে বলতে পারছি না। তুমি ডিকশনারী খুঁজে তা হলে বের করো বলে তাকে বাংলা টু ইংলিশ ডিকশনারী খানা এগিয়ে দিলাম। নিশ্চিত সে অর্থ বের করতে পারবে না।
স্কুল ছুটির পরে ছেলেটি আবারও আমার কাছে সে জানতে চাইলো সে তার প্রাইভেট বিষয়টি নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে চায় আমি যেন মিসেস চৌধুরীর সাথে শেয়ার না করি। সে নিশ্চিত বিষয়টি কারো জন্য ক্ষতি কারক নয়। ছেলেটি হল্যান্ড পার্ক স্কুলে যায়, মিসেস চৌধুরী তার সরাসরি শিক্ষক তাই সে তার সাথে শেয়ার করতে নারাজ। মিসেস ওয়াহিদও নাকি তাকে বলেছেন আমাকে দেখানোর জন্য। বললাম ঠিক আছে দেখি কোথায়? ছেলেটি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললো না না, এখানে দেখানে যাবে না চলুন উপরে লাইব্রেরী রুমে।
কি আর করা তার সাথে গেলাম উপরে লাইব্রেরী রুমে। ছেলেটি তার পকেট থেকে দুই পাতার একখানি চিঠি আমার হতো তুলে দিল। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে আগত তার এক সহপাঠিনী তাকে চিঠিখানি লিখেছেন। একখানা প্রেম পত্র। মেয়েটিও আমাদের স্কুলে আসে। মিসেস চৌধুরী তাকে নিয়ে খুব আশাবাদি। খুব ভালো রেজাল্ট করবে। এ লেবেল পরীক্ষা দিবে। আমার দিকে চিঠিখানি এগিয়ে দিয়ে ছেলেটি তার খাতা কলম নিয়ে বসলো। জানতে চাইলাম খাতা কলম দিয়ে কি করবে? বললো সে ইংরাজীতে লিখে রাখবে। চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে আমি পড়লাম মহা ফাঁপড়ে। বললাম মেয়েটি যদি জানতে পারে আমি তার চিঠিখানি পড়েছি তখন সে কি মনে করবে? ছেলেটি কিছুক্ষন ভাবলো তারপর বললো, আমি তাহলে তার চিঠিখানি পড়বো কি করে? আরো জানালো তার বন্ধু বান্ধবের প্রায় সকলেই চিঠিখানি মর্ম উদ্ধার করতে পারেন নি। মনে মনে ভাবলাম বলি তুমি মেয়ের কাছে গিয়ে বলো পড়ে দিতে, কিন্তু বললাম না । জানতে চাইলাম তুমি মেয়েটিকে জানো কি করে, বললো তার ক্লাসে পড়ে, আমাদের স্কুলেও আসে কোন কথা না বলেই মেয়েটি তাকে চিঠিখানি দিয়েছে। আমি তাকে চিঠিখানির মমার্থ বলে দিলাম। লিখে রাখতে বিরত করলাম। বললাম বিষয়টি মনের, মনে পুরে রাখো। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমরা যারা ইয়ং ছেলেমেয়েদের সাথে সরাসরি কাজ করার সুযোগ রয়েছে তাদের কিন্তু জানার শেষ নেই। প্রতি নিয়ত এরা নতুন কিছু একটা বের করে আমাদের জানার সুযোগও বাড়িয়ে দেয়।
তার পর অনেক বছর গড়িয়েছে। কালচার নিয়ে কিছু ভাবলেই ছেলেটির কথা আমি ভেবেছি। আমার দু‘ একটা রির্সাসেও তার বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করেছি। বর্তমানে নতুন পেশায় স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে প্রায় সব সময়েই নানা বর্ণেও প্যারেন্টসদের সাথে যোগযোগ হয়। এই যোগাযোগের মাধ্যম আমাকে আবারও নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে বাধ্য করে। নিজের জানার পরিধিও বাড়তে থাকে, জ্ঞান বাড়ে কি না বুঝি না তবে অভিজ্ঞতার ঝুলি যে ভারী হচ্ছে তাতে নিশ্চিত হই। এ ধরনের স্থানীয় প্রশাসনের একটি মিটিং শুরু হবার ঠিক পূর্ব মূহৃর্তে একজন প্যারেন্টস সরাসরি আমার কাছে এসে জনাতে চাইলেন, মিস কেমন আছেন? স্বভাব সূলভ ভঙ্গিতে বললাম ভাল আছি। কিন্তু তিনি সরে গেলেন না, আবারও প্রশ্ন করলেন মিস আমাকে চিনতে পারছেন? আমতা আমতা করে জবাব দেবার পূর্বেই বললেন, মিস আমি –। বাংলাদেশ সেন্টারে আমি আপনার ছাত্র ছিলাম। বললাম তুমি এখানে কি করছো? পাশের লম্বা বোরকা পড়া হিজাবী মহিলাকে দেখিয়ে বললো, আমার স্ত্রী , ১২.৩০ এর মিটিংটি আমাদের সাথে। তার স্ত্রী আস্তে করে আমাকে সালাম করলো। তাকে দেখে তার জাতীয়তা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলাম না। চোখ দু‘টি ছাড়া তার আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সাধারনত চোখ মুখ ঢাকা পেরেন্ট থাকলে আমি তাদের চোখ মুখ খুলতে বলি এবং কেন বলি তাও তাদের বুঝিয়ে বলি। এখন পর্যন্ত কোন মহিলাই চোখ মুখ খুলতে নারাজি হোন নি।
ইতিমধ্যে আমাদের র্ক্লাক মহিলাকে চোখ মুখ খোলার নির্দেশ/ সুপারিশখানা পড়তে দিলে সে বার্মি উচ্চারনে খট খট করে বললো, সে চোখ মুখ খুলতে পারবে না। এটা তার ধর্মীয় নির্দেশ। কোন মতেই সে ধর্মের অমর্যাদা করতে রাজী নয়। আমি ধর্ম নিয়ে তার সাথে যুক্তি তর্ক না করে; ক্লার্ককে মিটিং হবে না জানিয়ে দিতে বললে আমার ছাত্রটি হুড়মুড় করে আমার কাছে এসে বললো, স্যরি মিস, প্লিস মিটিং কেনসেল করবেন না। আমার স্ত্রী কিছু বুঝে না সে ধর্মান্ধ। আমি বললাম, এখানে আমি ধর্ম নিয়ে কথা রাজী নয় তবে আমি তোমার স্ত্রীর চোখ মুখ না দেখে তার সাথে মিটিং করতে পারবো না। ইতিমধ্যে সে তার স্ত্রীকে চোখ মুখের পর্দা খুলতে বলতেই সে আবারও হুংকার ছাঁড়লো। আমার ছাত্রটি জানতে চাইলো আমরা কি কেবল তার সাথে মিটিং করতে রাজী? অবশেষে একা তার সাথেই আমরা মিটিং শেষ করলাম এবং আমাদের পূর্ববতী রায় বহাল রাখলাম। আমার ছাত্রটি যাবার সময় বার বার আমাকে ‘সরি মিস‘ বলে গেলো। পূর্ববর্তী রায় বহাল রাখার বিষয়ে কোন মন্তব্যই করেলো না।
আমার চোখে ভেসে উঠলো ১৩/ ১৪ বছরের কিশোরের মুখখানি। ভালবাসার মর্মার্থ উদ্ধার করার কি প্রয়াস ছিল তাঁর চোখে মুখে; তার জন্য আমার ভীষন মায়া হলো কষ্টও হলো। বিপরীত মেরুতে বাস করা দু‘জন মানুষ কি করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করবে? ১৩/ ৪ বছর বয়সে যে কিশোর প্রেমিকার সম্বোধন ‘ ধ্রুবতাঁরা ‘ শব্দটির অর্থ খুঁজার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল সে এখন আপাদমস্তক ঈঁয়াশমাখে ঢাকা স্ত্রী নিয়ে (তার মতে ধর্মান্ধ) সংসার করে!