সাহেদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতারা আতঙ্কে, অনেকের ফোন বন্ধ!
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:২২:০৮,অপরাহ্ন ১৭ জুলাই ২০২০ | সংবাদটি ৯৭৭ বার পঠিত
আমাদের প্রতিদিন ডেস্ক:: বেরিয়ে আসছে সাহেদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের নাম। একজন মহাপ্রতারক হয়েও কিভাবে টিভি চ্যানেলগুলোতে দাপটের সঙ্গে টক শো করে লাইম লাইটে আসে সেটারও নেপথ্য কাহিনী ফাঁস করছে। দশ দিনের রিমান্ডে থাকা সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদে এ ধরনের চমকপ্রদ তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারীরা। আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের বিষয়ে সাহেদ খোলা মনে সব বলে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন এক কর্মকর্তা। এসব তথ্য যাচাই- বাছাই করার জন্য একজনকে ফোন করা হলে তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন, ফোনই বন্ধ করে দেন। এ ধরনের তথ্যে সাহেদের অন্যান্য আশ্রয়- প্রশ্রয়দাতাদের মাঝেও আতঙ্ক নেমে আসে।
এদিকে প্রতারণার নাটের গুরু ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ রিমান্ডে গিয়েও নানা নাটক সাজাচ্ছে। অসুস্থতার ভান করে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দফায় দফায় প্রতারণা করছে। মূলত তদন্ত কর্মকর্তাদের দূরে রাখতে ইনি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কথা বলছেন। এমনকি নাকের ভেতর টিস্যু পেপার ঢুকিয়ে বারবার হাঁচি দেয়ার চেষ্টা চালান। এবং মাঝে মধ্যে কাশিও দেন। তবে তদন্তকারী কর্মকর্তারা তার নাটক বুঝতে পেরে কৌশলে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দেন। এদিকে, প্রতারক সাহেদ মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন। বিভিন ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করেনি বলে তদন্তকারী সংস্থাগুলো অনেকটা নিশ্চিত হয়েছে।
ডিএমপির (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, সাহেদ খুব চালাক। সে অসুস্থতার ভান করছে বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে। তারপরও তার ব্যাপারে আমরা সতর্ক আছি। তাকেসহ অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সে কৌশলে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। তবে সে বেশিরভাগ প্র্রতারণার কথা স্বীকার করেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, কয়েক বছর ধরে টিভি চ্যানেলগুলোতে ছিল সাহেদের একচেটিয়া দাপট। দেশের আলোচিত ও জনপ্রিয় টক শোর সঞ্চালকরা পর্যন্ত তাকে নিয়ে মেতে উঠতেন, তাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেশের সেরা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মিশন নিয়ে সক্রিয় ছিলেন তারা। এটা কিভাবে সম্ভব হতো জানতে চাইলে, সাহেদ সব বলে দিয়েছে অবলীলায়। দামী গিফট, নিয়মিত ককটেল পার্টি, মদ, নারী ছাড়া জাতীয় উৎসবের দিনগুলোতে টাকার বান্ডিল পাঠিয়ে দেয়া হতো বলে জানায়। উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে এদের জন্য বরাদ্দ রাখা ছিল বিশেষ একটি স্যুট। যেখানে সন্ধ্যায় বসত আড্ডা।
র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, ভিন্ন কৌশলে সে প্রতারণা করত। সরকারী দফতরগুলোতে সাহেদ নিজেকে কখনও অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত এমন নানা পরিচয় দিয়ে বেড়াত। কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তোলেন। আর অপকর্মগুলো করতেই ওই সব ছবি কাজে লাগাত। গ্রেফতারের পর এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে স্বীকার করেছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, গ্রেফতারের পর থেকেই সে নানা নাটক করেছে। সে বারবার আমাদের বলেছে- আমি অসুস্থ। আমার হার্টের সমস্যা আছে। আমি কিন্তু মরে যেতে পারি। আমাকে মারধর কইরেন না। এসব বলে আমাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। সর্বশেষ সে আদালতে পর্যন্ত গিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। দেড় মাস ধরে সে যদি করোনায় আক্রান্ত থাকত তাহলে তার তো বেঁচে থাকার কথা ছিল না। সবই তার নাটক। তদন্তকারী কর্মকর্তারা যাতে তার সামনে যেতে না পারেন সেজন্য সে এই নাটক করছে বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে সাহেদ, মাসুদ পারভেজ ও তারেক শিবলীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। রাতভর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আলাদাভাবে সাহেদকে নানা প্রতারণার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। করোনার পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণা করার কথা স্বীকার করেছে। এতে বেশি দোষ চাপাচ্ছেন রিজেন্ট হাসপাতালের এমডি মাসুদ ও আইটি প্রধান তারেক শিবলীর ওপর। তাদের পরামর্শে এসব অপকর্ম করা হয়েছে। আবার মাসুদ ও শিবলী তারেককে এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে তারা জানায়, চেয়ারম্যানের নির্দেশেই তারা এসব করেছে। চেয়ারম্যান অনেক লোভী। প্রতিটি সেক্টরেই তিনি প্রতারণা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে র্যাব ও পুলিশের দুই কর্মকর্তা বলেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কথা বলে প্রতারক সাহেদ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে মোটা অংকের ঋণ নিয়েছে। কিন্ত দীর্ঘদিনেও সাহেদ টাকা পরিশোধ করেনি। ঋণগুলোও নিয়েছেন প্রতারণা করে। ভুয়া ঠিকানা ও প্রতিষ্ঠান দেখিয়েই সব ঋণ নিয়েছে সাহেদ। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা পাবে এনআরবি ব্যাংক। ব্যাংকটি পাবে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। কিছু ব্যাংক তার নামে মামলা করেছে। ওসব মামলায় সাহেদের বিরুদ্ধে ওয়ারেণ্ট জারি হলে কৌশলে জামিন নিয়ে নিত। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা বা নামী-দামী ব্যক্তিদের কথা বলে ব্যাংক কর্মকর্তাদের শাসাত।
রিজেন্ট হাসপাতালের সাবেক কর্মকর্তা সোহাগ আরেফিন বলেন, এমন কোন অপকর্র্ম নেই যে সাহেদ করেনি। তার হার্টে কখনও সমস্যা নেই। তার করোনা হয়নি। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি এখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গেও প্রতারণা করছে। ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নাম করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। কেউ ঋন না দিলে উপরের মহল থেকে ফোন করে ঋণ আদায় করে নিত।
ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, রিমান্ডে আনার পর সাহেদের নাটকের শেষ নেই। নাকের ভেতর টিস্যু পেপার ঢুকিয়ে বার বার হাঁচি দেয়ার চেষ্টা করে। আবার প্রায়ই জোর করে কাশি মারে। রুমের মধ্যে থুথু নিক্ষেপ করে। জিজ্ঞাসা করতে গেলেই বলতে থাকে আমি কিন্তু করোনা রোগী। আমার কাছে এলে আপনাদেরও করোনা হয়ে যাবে। আসলে এসব হচ্ছে তার পুরোপুরি নাটক। সে সম্পূর্ণ সুস্থ। আমরা যাতে তার কাছে না যাই সেজন্য এসব নাটক করছে। তিনি আরও বলেন, রাতভর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাকে যারা শেল্টার দিয়েছে তাদের নাম বলছে। যাদের কথা বলছে সবাই সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। তার তথ্যগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। একই কথা বলেছেন র্যাবের এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সাতক্ষীরায় গ্রেফতারের পর ঢাকায় আনার পর সাহেদকে কয়েকদফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কাদের শেল্টারে থেকে এসব অপকর্ম করেছে তাদের নাম বলেছে। আমরা নামগুলো যাচাই করছি। প্রমাণ মিললে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, হাসপাতালে অভিযানের পর থেকে সাহেদ আর নিজের বাড়িতে থাকেননি। প্রথম দিন তিনি ঢাকায় একটা হোটেলে ছিলেন। পরদিন তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার (পিএস) নরসিংদীর বাড়িতে চলে যান। সেখান থেকে কুমিল্লা হয়ে কক্সবাজার যান সাহেদ। কুমিল্লা ছাড়ার আগে নানা জনকে ফোন করে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। কক্সবাজার থেকে ঢাকায় এসে একটি গাড়ি ভাড়া করে চলে যান সাতক্ষীরায়।
সাহেদের বিষয়ে যে কোন তথ্য জানাতে এবং যারা সাহেদের প্রতারণার শিকার হয়েছেন তাদের সাহায্য করতে ‘সেবালাইন’ নম্বর চালু করেছে র্যাব। গতকাল শুক্রবার থেকে সাহেদের যে কোন কুকর্মের তথ্য ফোনে, ক্ষুদে বার্তা অথবা ইমেইলের মাধ্যমে জানানো যাবে।
র্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের প্রধান লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, সাহেদের কাছে যারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন তাদের সহায়তা করার জন্য র্যাব একটি সেবা লাইন চালু করেছে। এর মাধ্যমে নানা সময় বিভিন্নভাবে যারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন তাদের আইনগত বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ ছাড়া সাহেদের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মন থেকে ভয় দূর করতে র্যাব কাজ করছেও বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, প্রতারক সাহেদ শুধু করোনা টেস্ট নিয়েই প্রতারণা করেননি। তিনি বালু, পাথর, সিমেন্ট সাপ্লাইয়ের নামে অনেকের সঙ্গে প্রতরণা করেছেন। লাখ লাখ টাকা আটকে মানুষকে হয়রানি করেছেন। সাহেদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে ৫৭টির বেশি মামলা রয়েছে। এছাড়া টঙ্গী, তুরাগ ও উত্তরাতে রিক্সা-ভ্যানের লাইসেন্স দিয়ে মাসিক ও এককালীন টাকা আদায় করতেন তিনি। র্যাব জানিয়েছে, সাহেদের বিভিন্ন অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগ প্রতিনিয়ত আসছে। তার মাধ্যমে আরও যারা প্রতারিত হয়েছেন, তারা যাতে আমাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারে সেজন্য একটি সেবা লাইন নম্বর খোলা হয়েছে। এছাড়া ই-মেইলের মাধ্যমেও র্যাবকে তথ্য দেয়া যাবে। র্যাবের ইনভেস্টিগেশন উইং, র্যাব সদর দফতর। মোবাইল- ০১৭৭৭-৭২০২১১। এছাড়া ইমেইল- rabhq. invest@gmail.com
এদিকে, সাহেদ একাধিক পরিচয়পত্র ব্যবহার করছেন, এমন আলোচনা ওঠায় নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অনুবিভাগ বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর শুরু করেছে।
জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের মহাপরিচালক মোঃ সাইদুল ইসলাম সাংবাদিকদেও বলেন, সাহেদ ২০১৯ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করেন। তাকে এনআইডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদন করার বছরখানেক আগে সাহেদ একটি নতুন পরিচয়পত্র করতে এসেছিলেন। সে সময় তার আঙুলের ছাপ নেয়ার পর দেখা যায়, তার নামে একটি পরিচয়পত্র আছে। তাই আরেকটি পরিচয়পত্র করার সুযোগ পাননি। তবে নাম সংশোধনের জন্য প্রমাণ হিসেবে কেমব্রিজের ও লেভেলের একটি সনদ, জন্ম নিবন্ধন সনদ, নাগরিকত্ব সনদ ও পাসপোর্টের কপি দাখিল করেছিলেন। প্রাথমিক তদন্তে তার দেয়া জন্মনিবন্ধন ও নাগরিকত্ব সনদ যথাযথ পাওয়া গেছে।
অপরদিকে আশুলিয়ায় রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যানের সিল ও স্বাক্ষর করা ৪৮টি চেক বইয়ের পাতাসহ রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজের ভায়রা গিয়াসউদ্দীন জালালীকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১। এসময় তার ব্যবহৃত প্রাইভেটকারসহ চালক মাহমুদুল হাসানকেও আটক করা হয়। তাদের ৫ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়। এর আগে, বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) বিকেল ৫টার দিকে আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে গিয়াস ও তার গাড়ির চালক মাহমুদুল হাসানকে আটক করে র্যাব-১। (জনকন্ঠ)