আইজিপি অফিসের চিঠি ফাঁস: জড়িতদের বদলে সাংবাদিকদের হয়রানি!
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:২২:০৫,অপরাহ্ন ১৭ জুন ২০২০ | সংবাদটি ৪৪৩ বার পঠিত
আমাদের প্রতিদিন ডেস্ক:: পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বরাবর ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের পাঠানো একটি চিঠি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে অন্তত এক ডজন সাংবাদিককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) মো. শাহ আবিদ হোসেন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বিভিন্ন সাংবাদিককে তারিখ উল্লেখ করে ডিএমপি সদর দফতরে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে।
তবে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সাংবাদিক সমাজ। সাংবাদিক নেতারা বলছেন, সংবাদ প্রকাশের জের ধরে পুলিশ এভাবে কোনও সাংবাদিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকতে পারে না। যে দফতর থেকে চিঠিটি ফাঁস হয়েছে সেখানে জড়িতদের খুঁজে বের না করে উল্টো সাংবাদিকদের হয়রানি করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরা জানান, সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম আইজিপি বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছেন, যেখানে তার কার্যালয়ের ইমাম হোসেন নামে একজন যুগ্ম কমিশনারকে তিনি দুর্নীতিবাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এমনকি অধস্তন ওই পুলিশ কর্মকর্তা কমিশনারকে পুলিশের জন্য কেনাকাটায় পার্সেন্টেজ গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণে অধস্তন ওই কর্মকর্তাকে ডিএমপি থেকে বদলি করার আহ্বান জানান কমিশনার।
এই চিঠিটি নিয়ে দেশের একাধিক প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদ প্রকাশিত হয়। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের মধ্যেও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। এ কারণে ডিএমপি থেকে চিঠিটি কীভাবে ফাঁস হলো তা জানার জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রধানের পক্ষ থেকে অন্তত এক ডজন সাংবাদিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধান কমিটির সদস্য ও ডিএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মো. ওয়ালিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের ওপর অর্পিত যে দায়িত্ব তা যথাযথ পালন করতেই আমরা সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চিঠি দিয়েছি। আমরা সাংবাদিকদের আসার জন্য অনুরোধ করেছি। কাউকে বাধ্য করছি না।’
সংবাদ প্রকাশের পর সংবাদকর্মীদের ডেকে পাঠানোর বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা গণমাধ্যমের পেশাগত দায়িত্বে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির শামিল। তথ্য প্রকাশ ও বাক স্বাধীনতার অধিকারের পরিপন্থী। এমন পদক্ষেপ তারা নিতে পারেন না।’
তিনি বলেন, ‘যে পুলিশ কমিশনার নিজেই তার অধীনস্থ কর্মকর্তাকে দুর্নীতিবাজ চিহ্নিত করে কর্তৃপক্ষের কাছে বদলির সুপারিশ করে চিঠি দিয়েছেন, সে কমিশনারের কাছ থেকে এটা স্ববিরোধী আচরণ। এটা কোনোভাবেই তার কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। বরং গণমাধ্যমকে তার সহায়ক শক্তি হিসেবে ভাবা উচিত।’ ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পুলিশ কর্তৃপক্ষের উচিত হবে পুলিশ সদস্যদের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা। দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করা তাদের দায়িত্ব না। এটা এখতিয়ার বহির্ভূত এবং আত্মঘাতী কাজ।’
চিঠি পাওয়া একাধিক সাংবাদিক জানিয়েছেন, ডিএমপি থেকে চিঠি দিয়ে তাদের ডাকার বিষয়টিকে তারা হয়রানি মনে করছেন। এটি ভীতিকর একটি পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে। যার কারণে ভবিষ্যতে স্বাধীন সাংবাদিকতাও বাধাগ্রস্ত হবে। সোর্সরা আর গোপন তথ্য দিতে চাইবেন না। সাংবাদিকদের সংবাদ পাওয়ার অন্যতম একটি উপায় হলো সোর্স মেইনটেইন করা। ফলে সোর্সের বিষয়ে তথ্য জানতে চাওয়ার কারণে সোর্সরাও নিজের পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকবেন। এতে সমাজে অন্যায়-অবিচার, ঘুষ-দুর্নীতি আরও বেড়ে যাবে, যা সার্বিকভাবে দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
ডিএমপির চিঠি পাওয়া সাংবাদিক নেসারুল হক খোকন বলেন, ‘এভাবে তারা ডাকতে পারে না। এই চিঠি কীভাবে আউট হয়েছে সে বিষয়ে তারা সংশ্লিষ্ট দফতরে খোঁজ নিলেই তো পারে। সাংবাদিক হিসেবে আমাদের ডেকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়রানির শামিল। এটা অতীতে কখনও ঘটেনি। আমি তথ্য আমার সোর্সের মাধ্যমে পেয়ে থাকি। এই সোর্স আমি কখনও প্রকাশ করতে পারি না। এই ডাকাডাকি বন্ধ করা উচিত। এতে স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক জানান, ‘সোর্স জানার জন্য কমিটি করে অনুসন্ধান করা প্রথম শুনছি। এটি তারা কোনোভাবেই করতে পারেন না। আমরা সাংবাদিকরা সোর্স বলতে বাধ্য নই। প্রকাশিত সেই চিঠিটি যদি ভুয়া হতো তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু তারা তো তা বলছে না। তারা চিঠিটি আমরা কীভাবে পেলাম তা জানার চেষ্টা করছে। এটা কোনোভাবেই সমীচীন নয়।’
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, ‘যার দুর্নীতির ব্যাপারে রিপোর্টটি প্রকাশ হয়েছে, সেই রিপোর্টটি আমলে নিয়ে তদন্ত হওয়া দরকার ছিল। যদি মনে হয় তিনি দোষী তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আর যদি দোষী না হন, তাহলে তিনি তো প্রতিবাদ পাঠাতে পারতেন। এসব না করে সাংবাদিকদের ডেকে সোর্স জানার চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা তো সমীচীন নয়। সাংবাদিকরা তো সোর্স বলতে বাধ্য না। সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেক্ষেত্রে সাংবাদিকদের কাছে যদি সোর্সের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়, তাহলে এটা স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। এটি আসলে মেনে নেওয়া যায় না। আমার মনে হয় এই বিষয়টি তারা উপলব্ধি করবেন।’
সাইফুল আলম বলেন, ‘অনেক সময় দেখেছি রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনও কোনও পর্যায় থেকে কোনও কোনও রিপোর্টের ব্যাপারে আপত্তি জানানো হয়। উষ্মা বা ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এটি না করে বরং কোনও সাংবাদিকের রিপোর্ট যদি রাষ্ট্র এবং জনগণের পক্ষে যায় তাহলে তাকে পুরস্কৃত করা উচিত। তবে সাংবাদিকতারও কিছু নীতি-নৈতিকতা রয়েছে। নিশ্চয়ই আমরা এমন কিছু লিখবো না যাতে সেটি ভুল প্রমাণিত হয়। ভুল কিংবা মিথ্যা সংবাদ যদি আমরা ছাপি তাহলে তো আমার প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না। আমার পাঠক থাকবে না। সেটি তো কোনও গণমাধ্যমও চায় না।’