রাগিব আলী কি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন?
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:০২:০১,অপরাহ্ন ২২ জানুয়ারি ২০১৭ | সংবাদটি ১৪৩৮ বার পঠিত
ফারুক আহমদ ।।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিখোর রাগিব আলীর অবস্থান নিয়ে এর পক্ষে-বিপক্ষে বেশ কয়েক দিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছিল। আলোচনাটিকে সামনে নিয়ে আসেন যুক্তরাষ্ট্রবাসী কবি ফকির ইলিয়াস, তার একটি লেখার মাধ্যমে। সম্ভবত তার পর থেকেই এ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত। কবি ফকির ইলিয়াস যে কথাগুলো লিখেছেন “যদিও এতে বাড়তি কিছু কথার যোগ ছিল” প্রকৃতপক্ষে এই কথাগুলোই রাগিব আলী ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত তার আত্মজীবনী ‘আমার জীবন আমার স্মৃতি’ গ্রন্থেও দাবি করেছেন। তিনি লিখেছেন: “২৪ প্রেমব্রিজ গার্ডেনে প্রথম বাংলাদেশ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেন্টার পরিচালনার জন্য অর্থ সাহায্য ছাড়াও একটি টাইপরাইটার, একটি টেবিল, চারটি চেয়ার এবং কার্পেট কিনে আমীনূর রশীদ চৌধুরী সাহেবসহ সেখানে গিয়ে জমা দেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিস ক্রয় করার ব্যাপারে সাধ্যমত অর্থ সাহায্য করি। এজন্য তৎকালীন লন্ডন হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার ফারুক চৌধুরী ধন্যবাদজ্ঞাপন করে আমাকে একটি পত্রও দিয়েছিলেন (আমার জীবন আমার স্মৃতি, পৃষ্ঠা, ৯১)”।
তার এ দাবির বিষয়ে লন্ডনে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ আন্দোলনে যোগদানকারী বাঙালি কূটনীতিবিদ মহিউদ্দিন আহমদ ফেইসবুকে আমাদেরকে নিশ্চিত করেছেন এ বিষয়ে তিনি কোনো কিছুই জানেন না। তথ্যটিও আমরা ফেইসবুকে পড়েছি। এছাড়া, অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ মিশনে উপপ্রধান হিসেবে যোগদানকারী কূটনীতিবিদ এম এম রেজাউল করিমের লেখা ‘কূটনীতিকের অভিজ্ঞতা’ গ্রন্থে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নানা তথ্য থাকলেও এ নামটির কোনো সন্ধান আমরা পাইনি। বিলাতে মুক্তিযুদ্ধের সবচে গ্রহণযোগ্য দলিল হচ্ছে, ‘ সাপ্তাহিক জনমত : মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল’। এটিতে অতি সামান্য জিনিষও তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু‘ রাগিব আলীর কোনো দানের কথা উল্লেখ নেই।
রাগিব আলীর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হওয়া বা তার বইয়ের উল্লিখিত দাবির সত্যতা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো প্রশ্ন ওঠেনি, ওঠেছে তিনি ভূমিখোর হিসেবে প্রমাণীত হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে পরে ধরা খেয়ে জেলে যাবার পরে, যখন কবি ফকির ইলিয়াস বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসেন, তখন। অনেকে হয়ত মনে করেছেন ফকির ইলিয়াস বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসে রাগিব আলীকে ফেরেস্তা হিসেবে প্রমাণের পায়তারা করছেন, তাই তারা তাকে একহাত নেন। পাঠকের এ সন্দেহ সঠিক হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। কারণ, কবিরা আত্মভোলা মানুষ। ডিসেম্বর মাস, স্বাধীনতার মাস। মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিখতে গিয়েই হয়ত তিনি তার জানা এ বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। এছাড়া, ফকির ইলিয়াস ও রাগিব আলী একই এলাকার লোক। সে হিসেবে সুসম্পর্ক থাকতেই পারে। না থাকলেও শুধু তিনি কেন, যে কেউ তার ভালো দিক নিয়ে তিনি লিখতে পারেন। কিন্তু লিখেছেন এমন এক সময়ে যখন রাগিব আলী অপরাধী হিসেবে প্রমাণীত, তখন। তিনি যে আসলেই একজন অপরাধী, তা তার নিজের আচরণেও প্রমাণীত। নতুবা তিনি সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আইনি লড়াই করতেন, তস্করের মতো পরিবার-পরিজন নিয়ে গোপনে পালাতেন না।
কবি ফকির ইলিয়াসের পুরো লেখাটি পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমি শুধু ফেইসবুকে লেখাটির কয়েকটি লাইন পড়েছিমাত্র এবং পড়েই আকৃষ্ট হয়েছি মাত্র কয়েকটি শব্দে। ফকির ইলিয়াস লিখেছেন, তিনি কয়েক মাস যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তথ্যসংগ্রহ করেছেন। আকৃষ্ট হবার কারণ, বিগত প্রায় তিন দশক ধরে আমিও যুক্তরাজ্যের বাঙালির জীবন ও জীবিকার ওপর কোনো তথ্য পেলে সংগ্রহ করি, যতন করে রাখি এবং কেউ চাইলে তা সরবরাহ করি। এছাড়া ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধে বিলাতবাসী বাঙালির ভূমিকা নিয়ে একটি বই লেখার পরিকল্পনাও আছে, সেজন্য। আমার কাছে আজকের ভূমিখোর রাগিব আলী আর মুক্তিযুদ্ধের সময়ের রাগিব আলী এক ও অভিন্ন নয়, দুই ভিন্ন সত্তা। একজন মানুষের অধঃপতন হতেই পারে। একজন সিংহ, আরেকজন ডাকু।
ফকির ইলিয়াসের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো পরিচয় নেই। তবে সময় ও সুযোগে আমি তার লেখা পড়ি এবং তার অনেক লেখাই বস্তুনিষ্ঠ বলেই মনে হয়। একইভাবে রাগিব আলী বিষয়ক লেখাটি আমার কাছে আরও দশজনের দাবির মতো মনে হয়নি। রাগিব আলী বিলাতবাসী হবার কারণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকা কোনো বড় কথা নয়। তখনকার হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া সকল বাঙালিই ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষে। সবাই তাদের সাধ্যমত বাংলাদেশ ফান্ডে চাঁদা দিয়েছেন। এককভাবে যিনি সবচে বেশি টাকা দিয়েছেন তিনি শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম। কিন্তু নিজের নামে দেননি, দিয়েছেন ‘সুবিদ আলী’ এই ছদ্মনামে। বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করা যাক। মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হবার সময়ে জহুরুল ইসলাম বাংলাদেশে ছিলেন। পরে তিনি তার এক পাঞ্জাবি বন্ধুর সহায়তায় চিকিৎসার অজুহাতে লন্ডনে আসার অনুমতি পেয়ে দেশত্যাগ করে জুলাই মাসের শেষের দিকে লুইসহ্যাম হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতাল থেকেই তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা ডাক্তার মোশারফ হোসেন জোয়ারদারের মাধ্যমে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানান। বিচারপতি চৌধুরী তখন ডাক্তার জোয়ারদারের গাড়িতে করে হাসপাতালে গিয়ে দেখা করেন। তখন জহুরুল ইসলাম জানান, স্বাধীনতা আন্দোলনে অর্থ সাহায্যের জন্য তিনি মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদের কাছ থেকে অনুরোধ পেয়েছেন। তিনি নিজেও স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহায্য করতে চান। বিচারপতি চৌধুরী তখন তাকে বলেন, প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র কেনা এবং স্টিয়ারিং কমিটির খরচ চালানো ছাড়া এই এই তহবিলের অর্থ অন্য কোনো খাতে ব্যয় করার পক্ষপাতি নন। বর্তমানে লন্ডনে একটি দূতাবাস চালু করার প্রক্রিয়া চলছে এবং সেজন্য প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার পাউন্ড প্রয়োজন পড়বে। জহুরুল ইসলাম যদি এ খরচ চালিয়ে নেন তাহলে তিনি নিশ্চিন্তে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। জহুরুল ইসলাম তখন জানতে চান, বিচারপতি চৌধুরীর এস্টিমেইট অনুযায়ি দুই থেকে তিন বছরের টাকা একসঙ্গে দিয়ে দিলে তিনি সন্তুষ্ট হবেন কি না। কিন্তু বিচারপতি চৌধুরী একসঙ্গে এতো টাকা নিতে রাজী হননি। সিদ্ধান্ত হয় প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি ডাক্তার জোয়ারদারের মাধ্যমে দুই হাজার টাকা করে পাঠাবেন। তবে শর্ত হচ্ছে ঢাকায় মি. জহুরুল ইসলামের পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার খাতিরে এই টাকা অন্য কারো নামে জমা নিতে হবে। এই শর্তানুসারে জহুরুল ইসলাম ও তার পরিবারের নিরাপত্তার খাতিরে ‘সুবিদ আলী’ ছদ্মনামে গ্রহণ করে দূতাবাসের ডাইরেক্টর লুৎফুল মতিন গ্রহণ করে রসিদ দিতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত তিনি লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনের ব্যয় বহন করেন।
এ প্রসঙ্গে আরেকজন মানুষের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি, তিনি সিলেটের অ্যাডভোকেট আব্দুল হাই খান। তার সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশকের গোড়ার দিকে। সিলেট পৌরসভার নির্বাচনে তিনি তখন দরগা মহল্লা ওয়ার্ড থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন। এর আগে আমি রাজার গলিতে মতাহির হোসেন সাহেবের ঘরে লজিং থাকতাম, পরে ঝর্ণার পারে একটি মেসে চলে আসি। মতাহির হোসেন সাহেব আমাকে অনুরোধ করেন অ্যাডভোকেট আব্দুল হাই খানের পক্ষে প্রচারণা অংশ নেয়ার জন্য। ইলেকশনে খান সাহেবের মার্কা ছিল উড়োজাহাজ। আমরা এয়ারপোর্টে গিয়ে উড়োজাহাজের সাউন্ড রেকর্ড করে নিয়ে এসে এটা বাজিয়ে প্রচারাভিযানে নামলাম এবং খান সাহেব জয়ীও হলেন। এই প্রচারাভিযানে সময় একটি প্রচারপত্রে আব্দুল হাই খান উল্লেখ করেছিলেন যে, ১৯৭১ সালে মার্চ মাসে তিনি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও আফরাজ আফগান চৌধুরীর সঙ্গে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে অনশন করেছিলেন। কথাগুলো আমাকে তখন বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু লন্ডনে এসে আব্দুল হাই খান যে অনশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এর পক্ষে কোনো সাক্ষি যোগাড় করতে পারিনি। আফরাজ আফগান চৌধুরী বাড়ির কোথায় তাও জানা ছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর শেখ আব্দুল মান্নান জানালেন তিনি শুনেছেন তার বাড়ি হবিগঞ্জে। বছর তিনেক আগে খবর পাই হবিগঞ্জে তিনি ওকালতি পেশায় নিয়োজিত আছেন। অনেক চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ব্যারিস্টার শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক তখন দেশে বিচারপতি হিসেবে কাজ করছেন। যাক শেষ পর্যন্ত প্রবীন লেখক-সাংবাদিক আব্দুল মতিনের পরামর্শে আমার ‘বিলাতে বাংলার রাজনীতি’ বই থেকে আব্দুল হাই খানের নামটি দিতে হয়। গত বছর সাংবাদিক উজ্জ্বল দাস দেশে গেলে তাকে বলেছিলাম পারলে আফরাজ আফগান চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে আব্দুল হাই খান তাদের সঙ্গে ছিলেন কি না এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে আমাকে জানাতে। তিনি জানালেন আফরাজ আফগান চৌধুরী ঠিক স্মরণ করতে পারেননি, আব্দুল হাই খান তাদের সঙ্গে ছিলেন কি না। বইটির প্রকাশের পরে সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকায় বিচারপতি শফিউদ্দিন মাহমুদ বুলবুলের একটি লেখায় আবিষ্কার করলাম অনশনে আব্দুল হাই খানও ছিলেন। বর্তমানে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক অবসর নিয়ে লন্ডনে আছেন। গত কয়েকদিন আগে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের একটি সাক্ষাৎকার নেবার ব্যাপারে কথা হয় বন্ধু ইসহাক কাজলের সঙ্গে। তিনি কথা দিয়েছিলেন তার সঙ্গে কথা বলে দিন-তারিখ ঠিক করবেন। কিন্তু গত ১৩ জানুয়ারি জুয়েল রাজের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠিত একটি বাংলা টিভিতে প্রচারিত একটি অনুষ্ঠানে বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক নিজেই উচ্চারণ করলেন আব্দুল হাই খানের কথাটি। মোটকথা, এই সত্যটি জানতে আমার আমার সময় লেগেছে প্রায় দেড় দশকের মতো।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই নাম দুটির সঙ্গে আমরা ক’জন পরিচিত? বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে অনেকেই পদক, সম্মাননা পেয়েছেন। আমি জানিনা, তারা কেউ পেয়েছেন কি না। এমনকী তাদেরকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় তেমন কোনো লেখালেখি হয়েছে কি না তাও আমার জানা নেই। হয়ত হয়েছে, হয়ত হয়নি। অনেকের লেখা ইতিহাসেও তাদের নাম নেই। কারো লেখা ইতিহাসে তাদের নাম থাকা বা না থাকা অথবা স্বাধীনতাত্তোর তাদের কোনো বিতর্কিত ভূমিকার জন্য মুক্তিযুদ্ধে শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম এবং আব্দুল হাই খানের অবদানের অবমূল্যান করে তাদেরকে স্বাধীনতা-বিরোধী বলা যাকে কী? তাদের অবদানের কথা না জানা আমাদের ব্যর্থতা, তাদের নয়। তেমনি একজন প্রবাসী বাঙালি হিসেবে রাগিব আলী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, চাঁদা দানকারী, এমনকী তার নিজের অথবা এলাকাবাসীর দৃষ্ঠিকোণ থেকে নিজেকে সংগঠকও দাবি করতেই পারেন; এটা খুব বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, আসলেই মুক্তিযুদ্ধে তার কোনো অবদান ছিল কি না। থাকলে তার অবদানের মূল্যায়ন না হলেও অস্বীকার করা অন্যায়। এমনকী রাগিব আলীর মুক্তিযুদ্ধে জড়িত থাকা না থাকা আদালতের কাছে বিবেচ্য কোনো বিষয় নয়, এবং সেজন্য তিনি পার পাবার কথাও নয়। তাই যারা ইতিহাস চর্চা করেন তাদের উচিৎ, সম্ভব হলে তার দাবির যৌক্তিকতা খুঁেজ দেখা, সত্যতা যাচাই করা। এতো বড় একজন দাতাকে আমরা কোনোভাবেই তার বর্তমান অবস্থানের জন্য তখনকার অবদানকে অস্বীকার বা অবমূল্যায়ন করতে পারি না, করা উচিতও নয়।
কবি ফকির ইলিয়াসের লেখার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে অনেকে কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই দাবি করে লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধে রাগিব আলীর যুক্ত ছিলেন না। কেউ কেউ যুক্তি দেখিয়েছেন, কারো লেখা কোনো ইতিহাসে তার নাম নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও বিশেষ করে দূতাবাসে তার টাইরাইটার, কার্পেট ইত্যাদি দান সম্পর্কে অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোনো তথ্য-প্রমাণ উদ্ধার করতে পারিনি। এছাড়া, ১২৫টিও বেশি অ্যাকশন কমিটির (ভিন্নমতে, ৩৩টি) সঙ্গে শত শত মানুষ সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। সবার কথা লেখা, তাদের কাজের মূল্যায়ন করা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। ইতিহাস একটি চলমান প্রক্রিয়া। এতে বড়জোর ক্ষমা দেয়া যায় কিন্তু পূর্ণচ্ছেদ দেয়া প্রায় অসম্ভব। সেজন্য ফেইসবুকে বিভিন্ন জন যখন কবি ফকির ইলিয়াসকে তুলোধূনো করছিলেন তখন তার কাছে আমার প্রশ্ন ছিল, রাগিব আলী কোন সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে কাজ করেছেন তা জানা থাকলে বলার জন্য। উদ্দেশ্য ছিল এ দাবির বিষয় সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া। কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দেননি।
১৩ জানুয়ারি (২০১৭) জুয়েল রাজের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠিত বাংলা টিভির একটি টকশোর কথা আগেই বলেছি। এ অনুষ্ঠানটি শুনে সুলতান মাহমুদ শরীফের কথার সূত্র ধরে ফোন করলাম কয়েকজন প্রবীনের কাছে। কিন্তু অনেকেই রাগিব আলীকে নিয়ে কথা বলে এই মুহূর্তে কোনো বিতর্কে জড়াতে রাজী নন। শেষ পর্যন্ত তখনকার শীর্ষস্থানীয় একজন ছাত্রনেতা এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানালেন রাগিব আলী তখন দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের স্ট্রেথাম এলাকায় থাকতেন এবং বি এইচ তালুকদারের নেতৃত্বাধীন স্ট্রেথাম অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সভা-সমাবেশেও দু-একবার তিনি ও সোহেল ইবনে আজিজের সঙ্গে রাগিব আলীও একই গাড়িতে করে সভায় গেছেন। কিন্তু কমিটিতে তার নাম ছিল কি না তা স্মরণ করতে পারছেন না এবং বাংলাদেশ সেন্টারে তার দানের বিষয়ে তিনি কোনো কিছু জানেন না। কমিটিতে কারা ছিলেন না ছিলেন দা স্মরণ করতে না পারার কারণ, অ্যাকশন কমিটিগুলো ছিল মূলত আহবায়ক কমিটি। তার পরামর্শ হল এ বিষয়ে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আতাউর রহমান খান ভালো বলতে পারবেন।
অর্থাৎ আমরা জানতে পারলাম তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন এবং সভা-সমাবেশেও অংশগ্রহণ করেছেন এবং সাক্ষিরা এখনো জীবিত এবং সুপরিচিত। যেহেতু স্ট্রেথাম অ্যাকশন কমিটির বড় কর্তাদের সঙ্গে তার চলাফেরা ছিল, তাহলে অবশ্যই তিনি তার সাধ্যমত চাঁদা দান করেছেন। সেজন্য তিনি নিজে বা তার এলাকাবাসী কেউ তাকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এ দাবি করতেই পারেন।
তার আগে বলা আবশ্যক যে, ১৯৭১ সালের ২৭ অগাস্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে, লন্ডনের নটিংহিল এলাকার ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেন্সে ভারতের বাইরে বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস চালু করেন। দূতাবাস পরিচালনার দায়িত্ব নেন ৩জন সাবেক কূটনীতিবিদ এবং ৪জন কর্মকর্তা, তারা যুক্তরাজ্যে ছিলেন এবং অন্যান্য দেশ থেকে এসেছিলেন।
তার এ দাবির বিষয়ে লন্ডনে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ আন্দোলনে যোগদানকারী বাঙালি কূটনীতিবিদ মহিউদ্দিন আহমদ ফেইসবুকে আমাদেরকে নিশ্চিত করেছেন এ বিষয়ে তিনি কোনো কিছুই জানেন না। তথ্যটিও আমরা ফেইসবুকে পড়েছি। কোনো কিছু দান করে থাকলে অবশ্যই তার জানার কথা। এছাড়া, অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ মিশনে উপপ্রধান হিসেবে যোগদানকারী কূটনীতিবিদ এম এম রেজাউল করিমের লেখা ‘কূটনীতিকের অভিজ্ঞতা’ গ্রন্থে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নানা তথ্য থাকলেও এ নামটির কোনো সন্ধান আমরা পাইনি। বিলাতে মুক্তিযুদ্ধের সবচে গ্রহণযোগ্য দলিল হচ্ছে সাপ্তাহিক জনমত। এ পত্রিকায় অতি সামান্য জিনিষও তুলে ধরা হয়েছে। এ পরেও বলব বিষয়টি গবেষক-ঐতিহাসিকদের অনুসন্ধানের দাবি রাখে।