পাঠ প্রতিক্রিয়া: সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:২৩:০২,অপরাহ্ন ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ | সংবাদটি ৭১০ বার পঠিত
।। নন্দলাল শর্মা ।।
বিশ্বের মধ্যে আমরা একমাত্র জাতি যারা সশস্ত্র সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমাদের স্বাধীনতা কারো দান নয়, কোনো চুক্তিনামায় সম্পাদিত নয়। দীর্ঘ নয় মাস মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এই যুদ্ধে দেশের ত্রিশলক্ষ নরনারী শহিদ হয়েছেন, অগণিত মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ও দেশপ্রেমী মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে।
স্বাধীনতা লাভের পর এ বিষয়ে নানা ইতিহাস ও স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কেবল দেশের লেখক নয়, বিদেশের অনেকের লেখক, সাংবাদিক বা যোদ্ধা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নানা গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর পরেও নানা বিষয়ে লেখা বাকি আছে। আগামী দিনেও অসংখ্য গ্রন্থ এ বিষয়ে রচিত হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ইতিহাস বা সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থের ভাণ্ডারে সংযোজিত হল একটি নতুন গ্রন্থ। গ্রন্থের নাম ‘সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ’। গ্রন্থের লেখক প্রবাসী দেশপ্রেমিক আনোয়ার শাহজাহান। তিনি মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন নি, তাঁর জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে। কিন্তু আমাদের স্থানীয় ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর অপার মমতা ও আগ্রহ। এ বিষয়ে তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তাঁর দীর্ঘদিনের কঠোর সাধনা, ধৈর্য, মমতা ও পরিশ্রমের ফসল ‘সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ’।
সিলেট বিভাগের চারটি জেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বহু স্থান আছে। সীমান্তবর্তী অঞ্চল বলে সিলেট বিভাগ মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে স্বীকৃত ছিল। তাই এই অঞ্চলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সশস্ত্র গুপ্ত ও প্রকাশ্য বহু যুদ্ধ হয়েছে। এই যুদ্ধে বহু মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছেন বা আহত হয়েছেন। আবার অনেক নিরস্ত্র সাধারণ মানুষও বিনাকারণে বর্বরতার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন বা মরতে মরতে প্রাণে বেঁচে গেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থানে স্মৃতিসৌধ সযন্তে লালিত হচ্ছে, আবার অনেক স্মৃতিসৌধ অযন্ত-অবহেলায় পড়ে আছে। স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থান অচিহ্নিত রয়ে গেছে, কোনও কোনও স্থানে অন্য স্থাপনা গড়ে ওঠায় মুক্তিযুদ্ধের চিহ্ন অবলুপ্ত হয়ে গেছে। চিহ্নিত অনেক স্থানেও স্মৃতিসৌধ গড়ে ওঠেনি।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আনোয়ার শাহজাহান সমগ্র সিলেট বিভাগ ঘুরে ঘুরে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও স্মৃতিসৌধ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে তা পরম মমতায় লিপিবদ্ধ করে এই গ্রন্থটি সাজিয়েছেন। তাঁর দেখার বাইরেও মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান থাকতে পারে। কারণ ব্যক্তি বিশেষের পক্ষে এই কাজ একা একা সম্পন্ন করা দুরূহ কর্ম এবং একপ্রকার অসম্ভব এবং দুঃসাধ্য। তবু তিনি বহু শ্রম, সময় ও অর্থ ব্যয় করে দেশকে ভালবাসার টানে এ কাজে ব্রতী হয়েছেন এবং বলাবাহুল্য সাফল্য অর্জন করেছেন।
গ্রন্থের শুরুতে আছে প্রসঙ্গ কথা। এই অংশে আনোয়ার শাহজাহান সিলেট বিভাগের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি প্রদান করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে সিলেট বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ও অবদানের কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থের অপূর্ণতার কথাও তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন। মূল গ্রন্থটি চারটি অধ্যায়ে বিভিক্ত। সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ সম্পর্কে তিনি ক্রমান্বয়ে চারটি অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন। প্রতিটি অধ্যায়ে উপ-অধ্যায়ের সংখ্যা যথাক্রমে ৪৫, ৮, ৮ এবং ১৫, মোট ৭৬টি।
আনোয়ার শাহজাহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধের বিবরণ দিতে গিয়ে সেই স্থানে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের বিশদ বর্ণনাও দিয়েছেন। এটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নির্মোহ গবেষকের দৃষ্টিতে নির্লিপ্ত ও নিরাসক্তভাবে তিনি ইতিহাসের সঠিক পাঠ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। এবং এ কাজে তার সাফল্য প্রশ্নাতীত। দেশের প্রতিটি অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ সম্পর্কে গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার জন্য এটা অপরিহার্য। আমি জানি না, হয়তো কোনও কোনও অঞ্চলে এ ধরনের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে থাকতে পারে। যে সব অঞ্চলের গ্রন্থ প্রকাশিত হয় নি, সে সব অঞ্চলের গ্রন্থও প্রকাশিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
লেখক আনোয়ার শাহজাহানের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লেখা ও অন্যান্য বই:-
‘সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ’ গ্রন্থটি রচনা করে আনোয়ার শাহজাহান সিলেটবাসীকে একটি দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করেছেন। তাঁর গ্রন্থটিতে যে অপূর্ণতা আছে তা পূরণ করতে কোনও গবেষক হয়তো এগিয়ে আসবেন। কারণ ইতিহাস রচনা বা গবেষণায় শেষকথা বলতে কিছু নেই। তবে সিলেটে এ ধরনের গ্রন্থ এটিই প্রথম আর এর পথনির্দেশক হিসেবে আনোয়ার শাহাজাহান মহান মুক্তিযুদ্ধের এবং আমাদের গবেষণা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে রইবেন। এ ‘গ্রন্থটিকে গ্রহণযোগ্য ও নির্ভুল করতে নানা রকম পরামর্শ দিয়েছেন’ আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রফেসর ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী। তাই এ গ্রন্থটির ভূমিকা লেখা আমার জন্য যুগপৎ ধৃষ্টতা ও গৌরবের। আমি স্যারকে প্রণতি জানাই। আর গবেষক আনোয়ার শাহজাহানকে এ গ্রন্থটি রচনার জন্য অভিনন্দিত করছি। আশা করি গ্রন্থটি পাঠক সমাজে নন্দিত হবে।
সিলেট
নন্দলাল শর্মা
মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি।