সিলেট বিমান্দরের ঘটনায়ই মূলত ছাত্রলীগ সভাপতির উপর ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী!
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:১৯:০৮,অপরাহ্ন ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | সংবাদটি ২০১০ বার পঠিত
আমাদের প্রতিদিন ডেস্ক:: আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বিরক্ত। এমনকি দলের নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সভায় ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের প্রসঙ্গ উঠলে প্রধানমন্ত্রী সংগঠনের কমিটি ভেঙে দেওয়ার কথা বলেন বলে খবর চাওড় আছে।
প্রধানমন্ত্রীর এই বিরক্তি মূলত সংগঠনটির শীর্ষ দুই নেতার ব্যর্থতা আর অনিয়মের কারণে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। বিশেষ করে সভাপতি রেদওয়ানুল হক শোভনকে নিয়ে বিতর্ক সবচেয়ে বেশি।
কমিটিতে বিবাহিত ও শিবির-ছাত্রদলের লোকজনকে স্থান দেয়া এমনকি নিজেও বিবাহিত, ক্ষমতার অপব্যবহার, কমিটিতে আর্থিক লেনদেন, মাদক সেবন, টেন্ডার ও তদবির-বাণিজ্য, দলীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা-মন্ত্রীকে অনুষ্ঠানে বসিয়ে রেখে নিজে দেরিতে আসা এমন নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
সর্বশেষ বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে পড়েন সিলেটের এম এ জি ওসমানী বিমানবন্দরে তাকে নেতাকর্মীদের বিদায় জানানো নিয়ে। তিন দিনের সাংগঠনিক সফরে ছাত্রলীগের সভাপতি মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা করেন।
গত বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) রাতে তিনি সিলেট থেকে ঢাকায় ফেরার পথে বিপুল নেতাকর্মী নিয়ে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে ঢোকেন। নেতাকর্মীরা তাদের সভাপতিকে বিদায় জানাতে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা তোয়াক্কা না করে টারমাকে এমনকি বিমানের সিঁড়ি পর্যন্ত চলে যান। সেখানে তারা সেলফি তোলেন, স্লোগান দেন।
একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ ধরনের ঘটনায় বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে কর্মকর্তারা বলছেন। আর ছাত্রলীগের সভাপতি শোভন কোনোভাবেই ভিআইপি মর্যাদার কেউ নন। এ ছাড়া বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে অনুমোদিত ব্যক্তির সঙ্গে দু-তিনজনের বেশি কাউকে ঢুকতে দেওয়ার নিয়ম নেই। সেখানে শোভনের সঙ্গে ভিআইপি লাউঞ্জে ঢোকেন কয়েক’শ নেতাকর্মী- এমনই খবর প্রচার আছে।
মূলত সিলেট বিমানবন্দরের ঘটনা জানার পর প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। গত শনিবার শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী গণভবনে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে নয় জানতে পেরে ফিরে আসেন তারা।
কমিটিতে বিবাহিত ও শিবির-ছাত্রদল: ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিবাহিতদের কমিটিতে জায়গা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বিবাহিত অনেককে কমিটিতে জায়গা দিয়েছেন শোভন। তিনি নিজেও বিবাহিত বলে অভিযোগ রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার স্ত্রীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছবি প্রকাশ পায়।
কেন্দ্রীয়সহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিতে শিবির ও ছাত্রদলের নেতাকর্মী ঠাঁই পেয়েছেন বলে নানা সময়ে সংগঠনের কর্মীরা অভিযোগ করেছেন। শিবির-ছাত্রদলের কর্মীদের কমিটিতে নিতে লেনদেন হয়েছে টাকার।
ছোট ভাই রাকিনুল হক চৌধুরী ছোটনকে ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক করেছেন শোভন। ছোটন আবার তার বেশ কয়েকজন বন্ধুকে, যারা সংগঠনে কখনো ছিল না, কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন। বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়ও ছোটন ও তার বন্ধুরা বিকল্প গ্রুপ তৈরি করে নানা অপকর্মে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। তাদের বেশিরভাগই বিএনপি-জামায়াত পরিবারের, অছাত্র কিংবা ব্যবসায়ী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে ‘ডেমকেয়ার’: মন্ত্রী-নেতাদের একরকম ডেমকেয়ার করে চলেন ছাত্রলীগের সভাপতি শোভন। গত ২০ জুলাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি দুপুর সাড়ে ১২টায় এলেও শোভন আসেন বেলা দুইটা ২০ মিনিটে। ততক্ষণ পর্যন্ত মন্ত্রী ক্যাম্পাসেই অবস্থান করেন। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে সকাল থেকে নেতাকর্মীরা সম্মেলন স্থলে অবস্থান করায় বশে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়ে। হিটস্ট্রোকে মারা যান সুলতান মোহাম্মদ ওয়াসী নামে একজন কর্মী। এ ঘটনায় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের গাফিলতিকেই দায়ী করা হয় সংবাদমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
একই রকম বিলম্বের ঘটনা ঘটে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ছাত্রলীগের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নেতাদের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির মতবিনিময় অনুষ্ঠানে। ওই অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী উপস্থিত হওয়ার অনেক পরে আসেন সভাপতি শোভন।
ছাত্রলীগের সভাপতি শোভনের ‘ডেমকেয়ার’ থেকে বাদ যাননি আওয়ামী লীগের অন্যতম জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ। একটি অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের সভাপতি উপস্থিত হন তোফায়েল আহমেদ আসার অনেক পরে।
ঘুম থেকে ওঠেন দুপুরে: সংগঠনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের সভাপতির বিলম্বে হাজির হওয়ার পেছনে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার কথা বলছেন অনেক নেতাকর্মী। দুপুরের আগে তিনি ঘুম থেকে ওঠেন না বলে জানা যায়। তৃণমূলের নেতারা ঢাকায় এলে তার সাক্ষাৎ তেমন একটা পান না।
ঢাবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জানান, ছাত্রলীগের রাজনীতির বড় কেন্দ্র মধুর ক্যান্টিনেও অনিয়মিত শোভন। কখনো এলেও দুপুরের পর এসে কিছুক্ষণ থেকে চলে যান।
মাদক-সংশ্লিষ্টতা: শোভনের এভাবে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার পেছনে মাদকের প্রভাবের কথা বলছেন তার বিরোধী পক্ষের অনেকে। আর তার বিরুদ্ধে মাদক সেবনের গুরুতর অভিযোগ নতুন নয়। কয়েক বছর আগে পুলিশ তাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে গাঁজাসহ আটক করার খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। দলীয় কার্যালয়েও দরজা আটকে মাদক সেবনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিষয়টি জানতে পেরে দলীয় কার্যালয়ে শোভন-রাব্বানীর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা এমন খবরও জানা যায়।
টেন্ডার-বাণিজ্য: ছাত্রলীগের সভাপতির বিরুদ্ধে রাজধানীতে টেন্ডার-বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। আছে জেলা ইউনিটের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অনৈতিক আচরণের প্রচার।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দেওয়ার পেছনে কোটি কোটি টাকার টেন্ডার-বাণিজ্যের কথা প্রচার পায় সংবাদমাধ্যমে। পরে সম্মেলন হলেও এখনো কমিটি ঘোষণা করতে পারেননি। একই অবস্থা ইডেন মহিলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রলীগের।
কেন্দ্রীয় সম্মেলনের এক বছর পর গত ১৩ মে ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়ে সংগঠনের একাংশের হামলায় আহত হন নতুন কমিটিতে পদবঞ্চিত ১০-১২ জন নেতাকর্মী। রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী দিশার কপালে ১৮টি সেলাই পড়ে। এ হামলায় জড়িত ছিলেন শোভন-রাব্বানীর অনুসারীরা। এরপর থেকে বিতর্কিতদের তালিকা করে তাদের বাদ দেয়ার দাবিতে আন্দোলন ও অনশন করেন ছাত্রলীগের বিদ্রোহী অংশটি।
জানা যায়, ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটির বিতর্কিত ১০৭ জনের মধ্যে ২৫ জন বিবাহিত, ১৯ জনের পরিবার সরাসরি বিএনপি কিংবা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, ১১ জন মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, ৮ জন বিভিন্ন মামলার আসামি, ৬ জন ব্যবসায়ী, ৩ জন বিভিন্ন অভিযোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত, ২ জন ছাত্রলীগ থেকে আগে বহিষ্কৃত, ৬ জন ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা, ৬ জন চাকরিজীবী বা সরকারি চাকরির জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত, ৭ জন দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়।
এসব ব্যাপারে জানতে ছাত্রলীগ সভাপতি শোভনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এছাড়া মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।