গণতন্ত্রের নামে একদলীয় শাসন চলছে – ফখরুল
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:৫০:৪৭,অপরাহ্ন ১৫ অক্টোবর ২০২২ | সংবাদটি ২২৯৮ বার পঠিত
ময়মনসিংহে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ ও আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সমাবেশকে ঘিরে শনিবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মী সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া, পাল্টাধাওয়া, সংঘর্ষ ও পুলিশের কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মীরা রেললাইন থেকে পরস্পরের দিকে পাথর নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশসহ অন্তত চার জন আহত হয়েছেন।
শনিবার বিকেলে রেলস্টেশন এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সমাবেশস্থলের কাছে সংঘর্ষের সময় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। তবে সন্ধ্যার দিকে নগরীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। নগরীর বিভিন্ন মোড়ে পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানিয়েছেন ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামাল হোসেন।
নগরীর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রাবাস মাঠে শনিবার দুপুরে বিএনপি আয়োজিত ময়মনসিংহ বিভাগীয় গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বিএনপির কেন্দ্রীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, গণতন্ত্রের নামে বর্তমান সরকার একদলীয় শাসন চালাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মুখে উন্নয়নের কথা বলে দেশে লুটপাট চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
মির্জা ফখরুল এ সময় বলেন, সন্ত্রাস আর চুরি হচ্ছে আওয়ামী লীগের মজ্জাগত অভ্যাস। তিনি ২৫ মিনিটের বক্তৃতা জুড়ে সরকারের কড়া সমালোচনা করে আরও বলেন, আওয়ামী লীগ বলেছিল ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়াবে। এখন চাল খেতে হচ্ছে ৯০ টাকায়। বলেছিল বিনামূল্যে সার দেবে কৃষকদের। এখন চড়া দামে সার কিনতে হচ্ছে। ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার কথা বললেও এখন আওয়ামী লীগের সুপারিশ আর ঘুষ না দিলে চাকরি মিলছে না বলে অভিযোগ করেন মির্জা ফখুরুল।
গণসমাবেশে ফখরুল বলেন, দেশকে গণতন্ত্রের পথে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চাইলে শেখ হাসিনার সরকারকে বিদায় করে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন ও শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ দাবি করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সকল ভেদাভেদ ভুলে দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
শনিবারের গণসমাবেশে ময়মনসিংহ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক শফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, সাবেক মন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, শ্রমিক নেতা নজরুল ইসলাম খান, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ডা. জাহিদ হোসেন ও মশিউর রহমান, যুবদল নেতা সুলতান সালাহ উদ্দিন টুকু, আফরোজা আব্বাস, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, অ্যাডভোকেটন কায়সার কামাল, শিমুল বিশ্বাস, নেত্রকোনা বিএনপি নেতা ডা. আনোয়ারুল হক, কিশোরগঞ্জের শরীফুল আলম, ফজলুর রহমান ও আব্দুস সালাম, জামালপুর বিএনপি নেতা ওয়ারেছ আলী মামুন, ময়মনসিংহের আবু ওয়াহাব আকন্দ, অধ্যাপক শেখ আমজাত আলী, ফখর উদ্দিন বাচ্চু, জাকির হোসেন বাবলু, ডা. মাহবুবুর রহমান লিটন, মোতাহার হোসেন তালুকদার প্রমুখ। এ সময় মঞ্চে বিএনপির নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহের সাবেক এমপিসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশে মির্জা ফখরুল পথে পথে নেতাকর্মী সমর্থকদের বাধা দেয়ার অভিযোগ করে বলেন, ঢাকা থেকে বের হয়ে গাজীপুর টঙ্গী পার হওয়ার সময় মনে হয়েছে সরকারের হরতাল কার্ফু চলছে। গাড়ি ঘোড়া সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নেতাকর্মীরা যাতে সমাবেশে আসতে না পারে। ছোট ছোট ট্রাকে পিকআপে করে নেতাকর্মীরা সভায় এসেছে। তারপরও সোনার ছেলেরা পথে পথে লাঠিসোঁটা নিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু আমাদের কর্মীদের ধাওয়ায় তারা পালিয়ে গেছে। তিনি বলেন আজকের এই সমাবেশ প্রমাণ করে দেশের মানুষ, আমাদের কর্মীরা সরকারের কোনো বাধাই আর মানবে না। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে দেশে দুর্ভিক্ষ এসেছিল। তার মেয়ে শেখ হাসিনাও এখন দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন। ওই সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘আমার চারপাশে চাটার দল। এত কম্বল আনলাম অথচ আমার কম্বল নেই’। আসলে এটা আওয়ামী লীগের মজ্জাগত অভ্যাস বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ভয় পায় বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন দিতে চায় না। তিনি আরও বলেন, গণসমাবেশ বানচাল করতে রাস্তাঘাট ও গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কর্মীদের ওপর গুলি ও হামলা চালান হয়েছে। পথে পথে বাধা বিঘ্ন করা হয়েছে।
তারপরও শত বাধা বিঘœ ও হামলা উপক্ষো করে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা বহু কষ্ট করে সমাবেশস্থলে আসায় তাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। শনিবার ময়মনসিংহে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের গণজোয়ার প্রমাণ করে এই সরকারকে আর কেউ চায় না। তিনি আরও বলেন, ক’দিন আগে চট্টগ্রামের গণসমাবেশে মানুষের জোয়ার দেখে সরকারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
শনিবার ময়মনসিংহের গণসমাবেশ ও গণজোয়ার দেখে, কর্মীদের দেশপ্রেম দেখে তাদের মাথা আরও খারাপ হয়ে যাবে। মির্জা আব্বাস বলেন, এভাবে সারাদেশে একের পর এক গণসমাবেশ করে আওয়ামী লীগের মাথা আরও খারাপ করে ছেড়ে দেব। তিনি বলেন সরকার কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের নামে লুটপাট করেছে। ফলে এখন আর বিদ্যুত যায় না। বিদ্যুত মাঝে মধ্যে আসে। তিনি বলেন বিএনপি যতবার নির্বাচনে গিয়েছে ভোটের মাধ্যমেই গিয়েছে। আগামীতে ভোটের মাধ্যমেই বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। তিনি বলেন এই সরকারের অধীন আমরা আর কোন নির্বাচনে যাব না।
রেলস্টেশন এলাকায় সংঘর্ষ ॥ দেশজুড়ে বিএনপির সন্ত্রাস নৈরাজ্যের প্রতিবাদ ও জনগণের জানমাল রক্ষায় শনিবার বিকেলে স্থানীয় রেলওয়ে স্টেশনের কৃষ্ণচূড়া চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রতিবাদ সমাবেশ কর্মসূচি ছিল ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের। বিকেল ৫টার দিকে সমাবেশ শেষ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা স্টেশন এলাকা ছাড়ছিল।
একই সময়ে বিএনপির গণসমাবেশ শেষে ট্রেনে যাওয়ার জন্য দলের নেতাকর্মীরা ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে যাচ্ছিলেন। এ সময় ধর ধর বলে হৈচৈ শুরু হলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মীদের মধ্যে স্টেশন এলাকায় ইটপাটকেল ও পাথর নিক্ষেপসহ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ বেধে যায়। এ সময় নগরীর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মামুন ও পুলিশের এক সদস্যসহ অন্তত চারজন আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পুলিশ এ সময় কয়েক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে।
পথে বাধা-বিঘেœর অভিযোগ ॥ বিএনপির ময়মনসিংহ বিভাগীয় গণসমাবেশে যোগ দিতে আসা নেতাকর্মী ও সমর্থকদের পথে পথে বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির নেতৃবৃন্দ। অভিযোগ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে ময়মনসিংহ আসার পথে তাদের বাধাবিঘ্ন ঘটায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এর আগে শুক্রবার রাতে নগরীর হোটেল মোস্তাফিজে অবস্থানরত বিএনপির নেতাদের লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে বিএনপি।
গণপরিবহন বন্ধ ॥ বিএনপির ময়মনসিংহ বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে শুক্রবার রাত থেকেই বৃহত্তর ময়মনসিংহের শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে ময়মনসিংহগামী সবধরনের গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়ারও অভিযোগ করে বিএনপি নেতৃবৃন্দ।
সমাবেশে আসতে বাধার মুখে পড়া নেতাকর্মী ও সমর্থকরা পথের বিকল্প নদীপথে, সড়কের ইজিবাইক, সিএনজি, ছোট ট্রাক ও পিকআপ ভ্যান যোগে সমাবেশস্থলে পৌঁছায়। গণপরিবহন বন্ধ প্রশ্নে ময়মনসিংহ জেলা মোটর মালিক সমিতির সভাপতি মমতাজ উদ্দিন মন্তা জানান, বিএনপির আগুন সন্ত্রাসের সময় দগ্ধ আহত পরিবহন শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় শুক্রবার রাতে ও শনিবার সবধরনের গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়। দলের নেতাকর্মীদের বাইরে এ সময় ভোগান্তির কবলে পড়েন কর্মজীবী ও শ্রমজীবীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
বিএনপির আগাম পরিকল্পনা ॥ বিএনপির ময়মনসিংহ বিভাগীয় গণসমাবেশ সফল করতে দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ একাধিক বৈঠক করেন। সরকার ও আওয়ামী লীগসহ পরিবহন মালিক ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন সমাবেশ ঠেকাতে নানা কৌশল নিতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই তাদের বাড়তি কৌশল ও সতর্কতা ছিল।
সমাবেশে যোগ দিতে অনেক নেতাকর্মী ও সমর্থক শুক্রবার দিনভর ও রাতে নানা উপায়ে ময়মনসিংহ পৌঁছায়। নগরীর মোস্তাফিজসহ বিভিন্ন হোটেল ও চরপাড়া এলাকার আলবারাকা সেন্টার এবং বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে দলের কর্মী-সমর্থকদের জায়গা করে দেওয়া হয়। এর বাইরে আত্মীয়-স্বজনদের বাসা বাড়িতেও রাখা হয় অনেক কর্মীকে।
এ ছাড়া ময়মনসিংহ নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ড ও উপজেলা থেকে কর্মীদের সমাবেশস্থলে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় সকল আয়োজন ও প্রস্তুতি নিয়ে রাখে বিএনপি। আর এভাবেই সব চোখ ফাঁকি দিয়ে সফল করা হয় বিএনপির গণসমাবেশ।
ছিল প্রতিরোধের প্রস্তুতিও ॥ যেকোনো ধরনের হামলা মোকাবিলায় প্রতিরোধেরও প্রস্তুতি ছিল বিএনপির। সকাল থেকে নগরীর পলিটেকনিক মাঠের সমাবেশস্থলে আসা নেতাকর্মী ও সমর্থকদের হাতে হাতে ছিল জাতীয় পতাকার সঙ্গে বাঁশের লাঠি। শনিবার সকালে সমাবেশ শুরুর আগে পলিটেকনিক মোড়ে কেবল কাঁচা বাঁশের লাঠি হাতে দলের তরুণ তুর্কী কর্মীদের প্রকাশ্যে মিছিল করতে দেখা গেছে।