মসজিদের পাশে ‘ফুলবাগানে’ চিরনিদ্রায় হবিগঞ্জী হজুর
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৩৯:২৫,অপরাহ্ন ০৬ জানুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ১২২৩ বার পঠিত
ইমরান আহমদ, হবিগঞ্জ থেকে ফিরে:: দেশের শীর্ষ আলেম, প্রখ্যাত শায়খুল হাদিস আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী (রহ.)’র শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী নিজ মাদরাসা মসজিদের পাশের ফুলবাগানে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন।
সোমবার (৬ জানুয়ারী) সকাল ১০ টা ১৫ মিনিটে মাদরাসারে সম্মুখের মাঠে দেশের শীর্ষ স্থানীয় ওলামা-মাশায়েখসহ লাখো তৌহিদি জনতার অংশগ্রহণে জানাযা শেষে এখানেই শায়িত করা হয় হাজার হাজার আলেমের ওস্তাদ শায়খুল হাদিস আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জীকে।
জানাযা নামাজের ইমামতি করেন জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া উমেদনগর মাদরাসার পরবর্তী মুহতামিম, হযরতের বড় ছাহেবজাদা মাওলানা মাসরুরুল হক। জানাযা শুরু হলে অংশগ্রহণকারী লাখো জনতার গুণ গুণ কান্নার আওয়াজ উমেদনগরের আকাশ বাতাস কম্পিত হয়ে উঠে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় এ হযরতকে শেষবারের মতো দেখতে রাত থেকেই অনেকে ভীড় করেন উমেদনগর মাদরাসায়। আর জানাযায় শরিক হতে ভোর থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জনতা জড়ো হতে থাকেন জানাযার জন্য নির্ধারিত মাদরাসার সম্মুখের মাঠে। জানাযার সময় যত নিকটবর্তী হতে থাকে ততো লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে মাদরাসার সম্মুখের মাঠ, মাদরাসা মাঠ, মাদরাসার বিল্ডিং, এলাকার আশপাশের বিল্ডিং, দু’পাশের রাস্তা ও রাস্তার পাশের খালি জমি গুলোও।
বিভিন্ন স্থান থেকে আগত মুসল্লিদের বহরে সকাল থেকেই রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জানাযার শুরুর আগ মুহুর্তে আগতদের ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার পায়ে হেটে যেতে হয়েছে।
জানাযা শেষে মাদরাসার সম্মুখের মাঠ থেকে মাদরাসা মসজিদ প্রাঙ্গনে হযরতের লাশ নিয়ে যেতে হিমশিম খেতে হয়। শেষ পর্যায়ে এসে যারা হযরতকে শেষ দেখা দেখতে পারেননি, একনজর হযরতের বহনকারী লাশের খাটটি (করাল) ছুঁয়ার বা দেখার চেষ্টা করেন। স্বেচ্ছাসেবক ও উপস্থিত আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর প্রচেষ্টায় প্রায় ১০-১৫ মিনিট পর মাদরাসা প্রাঙ্গনে লাশ যাওয়া হয়। এসময় মাদরাসা মাঠেও উৎসুক তৌহিদী জনতার তিল ধারণের ঠাই ছিলো না। হযরতের কবরে একমুটু মাটি দেয়ার জন্য অধির আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন তারা।
জানাযার পূর্বে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি মাওলানা আব্দুল মোমিন শায়খে ইমামবাড়ি ঘোষণা দেন শায়খুল হাদিস আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জীর চার পুত্র, ভাগিনা, নাতি হাফিজে কোরআন। তাই একমাত্র উনারাই (হাফিজে কোরআনরা) লাশের খাট বহনকরবেন এবং লাশ কবরে শায়িত করবেন। অন্য কেউ যেন চেষ্টা না করেন। তবে এতো জনসমুদ্রে আর হযরতের ভালবাসায় অনেকে লাশের খাট বহন করতে দেখা গেছে।
উল্লেখ্য, রবিবার (৫ জানুয়ারী) বিকেল ৪ টা ৩৫ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সিলেটে হাসপাতাল নেয়ার পথে তিনি ইন্তেকাল করেন। এর আগেও বেশকিছু দিন রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতাল এবং সিলেট মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সহ-সভাপতি, জামেয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া উমেদনগর টাইটেল মাদ্রাসা, হবিগঞ্জ তেতৈয়া মাদানীনগর মহিলা টাইটেল মাদ্রাসা, নুরুল হেরা জামে মসজিদসহ বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জীর মৃত্যুতে সিলেটসহ দেশ/বিদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে।
তার মৃত্যুর খবর প্রচার হলে তাৎক্ষণিক সিলেট ও আশপাশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রশাসনসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজন তাকে দেখতে উমেদনগর মাদরাসা ও শহরের চৌধুরী বাজারস্থ তাঁর নিজ বাসভবনে ছুঁটে যান।
পরিচিতি :
হাফিজুল কুরআন ও হাফিজে হাদিস আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী ১৯৪৪ সালে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার কাটাখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা আব্দুন নুর ছিলেন উচু মর্যাদার একজন আলেম ছিলেন।
৫ ভাইয়ের মধ্যে তাফাজ্জুল হক সবার বড়। ২য় ভাই লন্ডন প্রবাসী ইমদাদুল হক একজন শায়খুল হাদিস। ৩য় ভাই হাফেজ শামসুল হক সাদী একজন প্রখ্যাত মাওলানা। শামসুল হক সাদীর ২ ছেলে কোরআনে হাফেজ। ৪র্থ ভাই ডাক্তার সিরাজুল হক, আমেরিকা প্রবাসী, ৫ম ভাই হাফেজ মাওলানা আহমদুল হক ওআইসি ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর।
পারিবারিক জীবণ:
শায়খুল হাদিস তাফাজ্জুল হক বিয়ে করেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ এর বড় হুজুর হিসাবে খ্যাত বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রবক্তা এবং বৃটিশদের কালো পতাকা প্রদর্শনকারী মাওলানা আরিফে রাব্বানীর কন্যাকে। তাঁর শ্যালক খালেদ সাইফুল্লাহ এখন ময়মনসিংহের জনপ্রিয় আলেম।
ছেলে-মেয়ে:
তাফাজ্জুল হকের ৫ ছেলের মধ্যে ৫ জনই প্রখ্যাত মাওলানা। তাদের মাঝে ৪ জন কোরআানে হাফেজ। ৪ কন্যার মধ্যে সবাই টাইটেল পাশ আলেমা। নাতী নাতনীদের প্রায় সবাই কোরআনে হাফেজ ও মাওলানা। বড় ছেলে-হাফেজ মাসরুরুল হক উমেদনগর মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক। ২য় ছেলে-হাফেজ তাসনিমুল হক মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের পরিচালক, ৩য় ছেলে- হাফেজ তাফহিমুল হক একজন মুহাদ্দিস, ৪র্থ ছেলে মাওলানা মামনুনুল হক মহিলা মাদ্রাসার পরিচালক, ৫ ম ছেলে মাবরুরুল হক একজন মাওলানা। ৪ কন্যার সবাই মাদ্রাসার শিক্ষিকা।
শিক্ষাজীবণ:
লেখাপড়ার শুরুটা বাবার হাত ধরেই। তারপর রায়ধর মাদ্রাসা। ইসলামের মৌলিক শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায়। বাংলাদেশের প্রখ্যাত পীর ও আলেমে দ্বীন চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক শায়খুল হাদীস আল্লামা আহমদ শফি আল্লামা তাফাজ্জুল হকের শিক্ষক।
চট্টগ্রাম থেকে আল্লামা তাফাজ্জুল হক চলে যান পাকিস্তানে। পাকিস্তানের লাহোর জামেয়া আশরাফিয়া মাদ্রাসায় তিনি লেখাপড়া করেন। সেখানকার তার উস্তাদ শায়খুল হাদিস আল্লামা রসুল খান ছিলেন পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় আলেমে দ্বীন।
লাহোর থেকে জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে আল্লামা তাফাজ্জুল হক চলে যান ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায়। সেখানে তিনি উস্তাদ শায়খুল হাদিস ফখরুদ্দিন (র) এর সান্নিধ্য লাভ করেন। আল্লামা ফখরুদ্দিন (র) ছিলেন একাধারে পীর ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা। ভারত পাকিস্তানের বিভিন্ন ঐতিহাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জ্ঞান আহরনের পর তিনি চলে আসেন বাংলাদেশে।
শিক্ষকতা:
শিক্ষকতার পেশা দিয়ে তার জ্ঞান বিতরণ কার্যক্রম শুরু। শিক্ষা গ্রহণটা যেহেতু বাড়ি থেকে শুরু, শিক্ষা প্রদানটাও প্রায় একই স্থান থেকেই শুরু। রায়ধর মাদ্রাসার মুহাদ্দিস হিসাবে তিনি প্রথম শিক্ষকতার পেশা শুরু করেন। একবছর তিনি সেখানে ছিলেন। পরে চলে যান কুমিল্লার বরুরায়। সেখানেও তিনি শিক্ষকতা করেন।
ময়মনসিংহের জামেয়া আশরাফুল উলুম মাদ্রাসাসহ ময়মনসিংহ জেলায় তিনি বেশ কয়েক বছর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। স্বাধীনতার পর পর তার উস্তাদরা তাকে পাঠিয়ে দেন নিজ জেলা হবিগঞ্জে। প্রথমে তাকে মুহাদ্দিস হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় উমেদনগর মাদ্রাসায়।
১৯৫৭ সালে শায়খুল হাদিস মিছবাহুজ্জামানের প্রতিষ্ঠিত উমেদনগর মাদ্রাসায় তখনও দাওরায়ে হাদিস বিভাগ ছিল না। আল্লামা তাফাজ্জুল হক এসে দাওরায়ে হাদিস বিভাগ চালু করেন। এরপর নিরন্তরভাবে হাদিস শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন তিনি।
৭১ থেকে ২০২০ সাল। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি হাদিসের দারস দিয়ে কয়েক হাজার মুহাদ্দিস তৈরী করেন। যারা এখন দেশ বিদেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। শুধুই কি পুরুষরা হাদিস শিক্ষা অর্জন করবে? মহিলারা বাদ যাবে কেন? শুধু এই চিন্তায় তিনি ১৯৯৭ সালে হবিগঞ্জের তেতৈয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন মাদানী নগর মহিলা মাদ্রাসা। এই পর্যন্ত মহিলা মাদ্রাসা থেকে ২২৫ জনেরও বেশি মহিলা মুহাদ্দিস সনদ নিয়ে বের হয়েছেন। তারা এখন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ প্রতিটি পরিবারে হাদিস শিক্ষা প্রদান করছেন।
বিশ্ব সফর:
বিভিন্ন প্রয়োজনে আল্লামা তাফাজ্জুল হক লন্ডন আমেরিকা কানাডাসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সফর করেন। তিনি জীবনে ৩৮ বার পবিত্র হজ্জব্রত পালন করেন।
শাগেরদ বা ছাত্র:
তাঁর উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি নুর হোসাইন কাসেমী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, মাওলানা নেজাম উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন আলেম দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
দ্বীনের খেদমত ও সমাজসেবা :
নুরুল হেরা জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠাসহ একাধিক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। গরীব দুঃখীদের সাহায্যার্থে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন খুদ্দামুদ্দিন সমিতি। এই সমিতি থেকে বিভিন্ন প্রকাশনাও বের করা হয়। তার ওয়াজ শুনার জন্য হাজার হাজার মানুষ এখনও নির্ঘুম রাত কাটান। জুমার খুৎবা শুনতে নুরুল হেরা মসজিদে প্রতি জুমাবারই প্রচুর মুসল্লীর সমাগম ঘটে। দেশে বিদেশে লক্ষাধিক ভক্তের এক বিশাল পরিবার নিয়ে তার সংসার। সপেদ লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী, টুপি-ই তার প্রিয় পোষাক। সাধারণ মানুষের মতো চলতে ভালবাসেন আল্লামা তাফাজ্জুল হক।