স্মৃতিচারণে মনীষীরা : শায়খুল হাদিস আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী রহ.
প্রকাশিত হয়েছে : ২:১৫:৪৮,অপরাহ্ন ০৫ জানুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ১১৭০ বার পঠিত
।। মুফতি আবদুল্লাহ মাসুম ।।
হযরত মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী রহ. এক বৈচিত্রপূর্ণ অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আশি-উর্দ্ধ একজন প্রবীণ আলেমেদ্বীন। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের আকাবির উলামা মাশায়েখের সাথে তাঁর উঠাবসার সুযোগ হয়েছে। তাঁদের বিভিন্ন ঘটনা ও স্মৃতি আজো তাঁর স্পষ্ট মনে আছে। তিনি এক জীবন্ত ইতিহাস। আর ইতিহাস এমন এক সম্পদ, যা পূর্বসূরীর নিকট থেকে উত্তরসূরীর পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁর নিকট বিনীত দরখাস্ত করেছিলাম, আপনার মাশায়েখ ও আপনার সময়ের উলামা-মাশায়েখের আলোচনা করুন। তিনি তা মঞ্জুর করেছেন এবং সময় ও মনোযোগ দিয়ে তাঁর সময়ের মাশায়েখদের স্মৃতিচারণ করেছেন।
অধম তাঁর অনুমতিক্রমে সেই আলোচনা রেকর্ড করেছি এরপর হুবহু লিখে তাঁকে দেখিয়েছি। তিনি গুরুত্বের সাথে সেই কপি সম্পাদনা করেছেন এবং ছাপানোর অনুমতিও দিয়েছেন। সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে পাঠকদের জন্য আলোচনাটি সুবিন্যস্ত করে উপস্থাপন করার। আল্লাহ তাআলা তাঁকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
মূলত এটি এমন একটি স্মৃতিচারণ, যাতে উঠে এসেছে তাঁর সময়ের বরেণ্য উলামায়ে কেরামের কথা। তাঁদের ইলম ও আমলের কথা, তাঁদের তাকওয়া-খোদাভীরুতা, বাতিলের বিরুদ্ধে পাহাড়সম দৃঢ়তা, তাঁদের উচ্চ চিন্তা-চেতনা, সিরাতে মুস্তাকিমের উপর অবিচলতা, সূলূকের কথা ইত্যাদি। এ স্মৃতিচারণে এমন গুমনাম বুযুর্গদের কথাও উঠে এসেছে, যাদের আলোচনা কোনো গ্রন্থে পাওয়া দুষ্কর। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ আলোচনা থেকে পূর্ণরূপে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন।-অনুলেখক
………………………………………………………………………………………………
আল্লাহর ফযল ও করমে জীবনে অনেক বুর্যুগানে দ্বীনের সোহবত পেয়েছি। তবে নিজের অযোগ্যতা, দুর্বলতা, অলসতা ইত্যাদি কারণে তাঁদের সোহবত থেকে যেভাবে উপকৃত হওয়া দরকার ছিল সেভাবে উপকৃত হতে পারিনি। তাঁদের এক অযোগ্য ছাত্র আমি। তাদের কী আলোচনা আমি করবো! তবু তুমি যেহেতু অনুরোধ করেছ এবং আমিও ভেবে দেখেছি যে, এ আলোচনা কল্যাণকর হবে ইনশাআল্লাহ, তাই আল্লাহর উপর ভরসা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেসব বুযুর্গ-মনীষীদেরকে কাছ থেকে দেখেছি তাঁদের কিছু আলোচনা করব। এতে বর্তমান প্রজন্মের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় থাকবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের এ আলোচনার মজলিস কবুল করুন এবং একে উপকারী বানিয়ে দিন। আমীন।
শিক্ষাজীবনের বিবরণ
আমার পড়ালেখা শুরু হয় জামিয়া ছাদীয়া রায়ধর মাদরাসা থেকে। ‘রায়ধর’ হবিগঞ্জ জেলা শহরের অদূরে ধুলিয়াখাল গ্রামের নিকটবর্তী একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম। প্রথমে এটি একটি খানকাহ ছিল। তেরশ বাংলা সনের এক প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা শাহ ছা’দ উরফে আছাদুল্লাহ রাহ. (১২৮২/৮৩-১৩৫২ বঙ্গাব্দ) এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রথমে সিলেট ফুলবাড়িয়া মাদরাসায়, এরপর ভারতের আমরুহাতে দ্বীনী উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। সুন্নতে নববী ও সমাজ সংস্কারের এক মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। এখানে খানকাহভিত্তিক তালিম, তরবিয়ত দেয়ার পাশাপাশি শিরক-বিদআতসহ নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে ইসলামী আন্দোলন পরিচালনা করতেন। (তাঁর সম্পর্কে আরো আলোচনা ‘সিলেট বিভাগীয় আলেমদের স্মৃতিচারণ’ শিরোনামে করা হবে ইনশাআল্লাহ)। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁরই সুযোগ্য ভ্রাতুষ্পুত্র মাওলানা আব্দুল লতিফ রাহ. (মৃত্যু : ১৩৮২ বঙ্গাব্দ) এ খানকাহ পরিচালনার দায়িত্ব পান। খানকার কার্যক্রমকে আরো বেগবান করার লক্ষ্যে তিনি একে মাদরাসায় রূপ দেন। এটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন মাদরাসা। এখানে মুখতাসার জামাত পর্যন্ত পড়েছি। সে সময়ে এ মাদরাসায় যাদেরকে পেয়েছি তাদের অন্যতম হলেন পূর্বোক্ত মাওলানা আব্দুল লতিফ ছাহেব। তিনি সম্পর্কে আমার মামা। আমাকে অনেক আদর করতেন। তাঁর বাড়িতে জায়গীর থাকতাম। তিনি ছাড়াও সেখানে ছিলেন ক্বারী মাওলানা মেছবাহুজ্জামান কদুপুরী ছাহেব। মাওলানা আব্দুল কদ্দুস ছাহেব, মাওলানা আশরাফ আলী ছাহেব। রায়ধর মাদরাসার (মাওলানা আব্দুল লতিফ রাহ. কর্তৃক খানকাহ যখন মাদরাসায় রূপান্তর হয়) প্রথম শিক্ষক হন মুফতী আব্দুল গফুর দরিয়াপুরী রাহ. (মৃত্যু : ১৯৯৮ ঈ.)। তাকে হবিগঞ্জের মুফতী আযম বলা হত। ভারতে মাযাহেরুল উলূম সাহারানপূরে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছেন। মাওলানা শরফুদ্দীন (শায়খে বেড়াখালী)। তিনি মাদানী রাহ.-এর শাগরিদ। এ অঞ্চলে তিনি এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ ছিলেন। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ছিল অতুলনীয়। আরেকজন মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা মুখলিছুর রহমান ছাহেব। রায়ধর মাদরাসার প্রথম ছাত্র। তিনিও মাদানী রাহ.-এর শাগরিদ। সেই বিখ্যাত আলেম শাহ আছাদুল্লাহ রাহ.-এর সুযোগ্য পুত্র। বাতিলের বিরুদ্ধে এক অকুতোভয় আলেম হিসেবে তিনি পরিচিত।
হাটহাজারী মাদরাসায় গমন
৫৭-৫৮ ঈ. সনে হাটহাজারী মাদরাসায় যাই। সেখানে ৪ বছর ছিলাম। ওই যামানায় হাটহাজারী মাদরাসায় যেসব আকাবির হযরতদের পেয়েছি তাঁরা হলেন, হাদীসের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘মিশকাতুল মাসাবিহ’-এর উর্দূ শরাহ ‘তানযীমুল আশতাত’-এর লেখক মাওলানা আবুল হাসান রাহ., মাওলানা মোহাম্মদ আলী ছাহেব, যিনি শরহে আকাইদের টীকা লিখেছেন। মুফতি আহমদুল হক ছাহেব, মাওলানা হামিদ ছাহেব, মাওলানা শাহ আব্দুল ওয়াহহাব মুহতামিম ছাহেব।
মাওলানা আহমদ শফী ছাহেব দা.বা. তখন নতুন উস্তায। দেওবন্দ থেকে এসে সরাসরি হাটহাজারী মাদরাসায় খেদমত শুরু করেন। ‘মাইবুযী’ পড়েছি তাঁর কাছে। সবচেয়ে বেশি কিতাব যাদের কাছে পড়েছি তাঁরা হলেন শাইখুল হাদীস মাওলানা আব্দুল আযীয মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর, মাওলানা আবুল হাসান ছাহেব, মাওলানা মোহাম্মদ আলী ছাহেব, মুফতী আযম ফয়যুল্লাহ ছাহেব রাহিমাহুমুল্লাহ। তাঁদের সান্নিধ্য বেশি পেয়েছি। কিতাবের সংখ্যা হিসাব করলে দেখা যায় উপরোক্ত মাশায়েখদের মধ্যে মুফতী আযম রাহ.-এর নিকট বেশি কিতাব পড়া হয়েছে। তাঁর বাড়িতে গিয়েও পড়েছি। এ সুবাদে মুফতী ছাহেব রাহ.-এর সাথে আমার বিশেষ সম্পর্ক তৈরী হয়। জালালাইন-এর বছর হুযুরের কাছে বাইআত হই। তিনি আমাকে অনেক সেণহ করতেন। তাঁর সুপারিশেই মেশকাত, দাওরা একসাথে হাটহাজারীতে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। বিষয়টা হল, সকল ফুনূনাতের কিতাব যখন পড়া শেষ হয়ে গেল , দেখা গেল শুধু মেশকাত কিতাবটি বাকী আছে। তখন আমি ও মাওলানা আব্দুল হান্নান দিনারপুরী ইচ্ছা করলাম, যেহেতু মেশকাতের সাথে আর কোনো কিতাব নেই তাই এ বছর মেশকাতের সাথে দাওরার কিতাবগুলিও পড়ে নিব। এরপর আগামী বছর দেওবন্দ যাব ইনশাআল্লাহ। আমরা এ মর্মে একটি দরখাস্ত লিখে মুফতী ছাহেব হুজুরের নিকট পেশ করলাম। হুজুর তাতে আমাদের জন্য সুপারিশ করে দস্তখত করেন। নাযীমে তালীমাত শাইখুল হাদীস মাওলানা আব্দুল কাইয়্যুম ছাহেব দরখাস্ত মঞ্জুর করে নিলেন। এতে একসাথে মেশকাত, দাওরা পড়ার সুযোগ হয়। এটি হাটহাজারী মাদরাসার এক বিরল ঘটনা। এরকম সাধারণত হয় না।
মুফতী আযম রাহ.-এর বিশেষ ইজাযত
সহীহ বুখারী পড়াতেন মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম ছাহেব রাহ.। তিনি হাদীস পড়েছেন মাদানী রাহ.-এর কাছে। ইলম ও আমলে এক অনন্য ব্যক্তি ছিলেন। সবাই তাকে মাদারযাদ ওলী বলত। তখন মুহতামিম ছিলেন মাওলানা শাহ আব্দুল ওয়াহহাব ছাহেব। তিনি মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম ছাহেবেরও উস্তায। তিনি চাইতেন তাঁর পরে মুহতামিম হবেন মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম ছাহেব। কিন্তু মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম ছাহেব তা চাইতেন না। তিনি দুআ করতেন আল্লাহ তাআলা যেন তাকে এ দায়িত্ব না দেন। আল্লাহ তাআলা সম্ভবত তাঁর দুআ কবুল করেছিলেন। এজন্য মাওলানা শাহ আব্দুল ওয়াহাব ছাহেবের আগেই তাঁর ইন্তেকাল হয়।
ওই বছর আমরা কয়েকজন ইরাদা করলাম, মুফতী ছাহেব হুজুরের কাছ থেকেও হাদীসের সনদ নিব। এ উদ্দেশে তাঁর কাছে কুতুবে সিত্তাহ পড়ার আবেদন করলাম। হযরত প্রথমে রাজি না হলেও পরে আমাদের পীড়াপীড়িতে আবেদন মঞ্জুর করে নেন। আমরা কিতাব নিয়ে হযরতের বাড়িতে যেতাম। আমাদেরকে দেখে আরো অনেকেই যাওয়া শুরু করল। এদের মধ্যে ছিলেন, হাটহাজারী মাদরাসার দুজন হাদীসের উস্তায মাওলানা মুফতী আহমদুল হক ছাহেব ও মাওলানা হামিদ ছাহেব। দুজনই মুফতী ছাহেবের খলীফা। তাঁরাও দরসে উপস্থিত হতেন। সপ্তাহে একদিন শুধু শুক্রবার দরস হত। হযরত আরবী, ফার্সী ও উর্দূ তিন ভাষায় তাকরীর করতেন। তবে ফার্সী বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। সহীহ বুখারী দিয়ে দরস শুরু হল। হযরত এই কিতাবের সনদের ইজাযত দিলেন। এরপর আমরা আবেদন করলাম, হাদীসের বাকী কিতাবগুলোও কিছু পড়িয়ে সনদের ইজাযত দিয়ে দিন। হযরত রাজি হলেন। এভাবে আমরা হযরতের কাছে শামায়েলে তিরমিযী ছাড়া কুতুবে সিত্তার সবগুলো কিতাবের সনদের ইজাযত লাভ করি। শামায়েলে তিরমিযী মাদরাসায় পড়াতেন। এর সনদের ইজাযত মাদরাসা থেকেই পেয়েছি। মুফতী ছাহেব হাদীস পড়েছেন হযরত কাশ্মীরী রহ.-এর কাছে।
মুফতী আযম রাহ. : কিছু স্মৃতিচারণ
মুফতী আযম রাহ.-এর পীর ও উস্তায ছিলেন সন্দীপের বড় আলেম, শাইখুল হাদীস হযরত সাইদ আহমদ রাহ.। তিনি হযরত শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান রাহ.-এর ছাত্র ও খলীফা ছিলেন। আমার জানামতে বাংলাদেশে একমাত্র তিনিই শাইখুল হিন্দের খলীফা ছিলেন। তাঁর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, বাংলাদেশের তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিসে শুরার সদস্য ছিলেন। শাইখুল হিন্দের বড় বড় শাগরিদদের তিনি একজন। মাঝেমধ্যে তিনি এত উচ্চাঙ্গের ইলমী আলোচনা করতেন যা সকলের পক্ষে বুঝা সম্ভব হত না।
মুফতী ছাহেবের আরেকজন উস্তায হলেন বহুমুখী আত্মিক ও বাহ্যিক গুণের অধিকারী কুতুবুল আলম শাহ সূফী মাওলানা যমীরুদ্দীন নানুপুরী রাহ. (মৃত্যু : ১৪৩২ হি.)। তিনি ফকীহুন নফস রশীদ আহমদ গঙ্গোহী রাহ.-এর খলীফা ছিলেন। মুফতী ছাহেব ছিলেন শাইখুল হাদীস হযরত সাইদ আহমদ রাহ.-এর খলীফা। দারুল উলুম দেওবন্দে মুফতী ছাহেবের উস্তাযগণের মাঝে অন্যতম হলেন আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ.। তিনি কাশ্মীরী রাহ.-এর যৌবন কালের শাগরিদ ছিলেন।
হযরত ইব্রাহীম বলীয়াভী রাহ. এর সাথে মুফতী ছাহেবের অনেক বেশি তাআল্লুক ছিল। এর এক কারণ তো এই যে, বলিয়াভী রাহ.ও শাইখুল হিন্দের খলীফা ছিলেন। সুতরাং তিনি মুফতী ছাহেবের পীরের পীর ভাই। তখন দেওবন্দে মাওলানা ইজাজ আলী রাহ., মুফতী শফী রাহ., ক্বারী তৈয়ব ছাহেব রাহ., মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী রাহ. প্রমুখ আকাবিরে দেওবন্দ ছিলেন। মুফতী ছাহেব দেওবন্দে দুই বছর ছিলেন। এরপর হাটহাজারী মাদরাসায় এসে খেদমত শুরু করেন। তখন হাটহাজারী মাদরাসার শাইখুল হাদীস ছিলেন শাইখুল হাদীস সাইদ আহমদ রাহ.। তিদি সহীহ বুখারী পড়াতেন। আর মুফতী ছাহেব জামে তিরমিযী পড়াতেন। সাথে ইফতার দায়িত্ব পালন করতেন।
মুফতী আযম রাহ. বহুমুখী গুণের অধিকারী ছিলেন। দুনিয়াবিমুখতা তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি বলতেন, আমি হজ্বে আল্লাহর কাছে ওয়াদা করেছি, দেশে এসে দুনিয়াবী কোনো বিষয়ের সাথে জড়াব না। আল্লাহ তাআলা তাঁর এই ওয়াদা এত বেশি কবুল করেছেন যে, জমিদার বংশের সন্তান হয়েও সম্পদের প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। গুমনাম-প্রচারবিমুখ ব্যক্তি ছিলেন। চিটাগাং থেকেও চিটাগাং শহরে আমার জানামতে মাত্র দুইবার গিয়েছেন। তাঁর হায়াতেই একথা মাশহুর ছিল যে, তিনি মাদারযাত ওলী।
তিনি প্রায়ই বলতেন, ফরয-ওয়াজিব নয়, আমাকে তোমরা মুস্তাহাব পরিপন্থী কোনো কাজও কি করতে দেখেছ? মুফতী ছাহেব জীবনে মাত্র একবার হজ্ব করেছেন। এর কারণ হযরত নিজেই বলতেন, ফটো তোলা হারাম। নফল হজ্বের জন্য আমি ফটো তুলতে পারব না। তিনি জরুরত/রুখসত নয়; বরং সর্বোচ্চ তাকওয়া ও সতর্কতার উপর চলতেন।
চিটাগাং-এর এক দ্বীনদার ধনাঢ্য ব্যক্তি আদালত খাঁ জানতেন, হযরত ফটো তুলে হজ্বে যাবেন না। তাই তিনি সৌদি হজ্ব কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে হযরতের জন্য দুজন জামিন হয়ে ফটো না তুলেই হজ্বে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই একবারই হযরত হজ্ব আদায় করলেন। ফটো তুলতে হয় এজন্য জীবনে আর নফল, বদলি কোনো হজ্ব করেননি।
একসময় মুফতী ছাহেবের পীর ও উস্তায আল্লামা সায়ীদ আহমদ রাহ. হাটহাজারী মাদরাসা থেকে অব্যাহতি নেন। তখন মুফতী ছাহেবও অব্যাহতি নিয়ে নিজ বাড়ির কাছে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্ররা নিজের খরচে পড়ত। কোনো চাঁদা-কালেকশন করা হত না। কেউ দান করতে চাইলে হযরত বলতেন, আমাদের প্রয়োজন নেই। হাটহাজারী মাদরাসায় নিয়ে যান।
হযরত যখন শুতেন তখন ডান দিকে ফিরে হাটু ভেঙ্গে জড়োসড়ো হয়ে শুতেন। হযরতের প্রথম যিন্দেগী ছিল অনেক কষ্টের। হযরত নিজেই বলতেন, বিবিসাব যখন বাজারের ব্যাগ হাতে তুলে দিতেন তো মাঝেমধ্যে এরকম হত যে, বাজার করার মতো টাকা পয়সা হাতে থাকত না। তখন গ্রামের সবজী ব্যবসায়ীরা সবজী নেয়ার সময় রাস্তায় যা ফেলে দিত তা তুলে নিতাম। পরবর্তীতে যখন সচ্ছলতা এসেছে তখন আর খাওয়ার সামর্থ্য বাকি থাকেনি। মুফতী ছাহেব সাধারণত থানভী রাহ.-এর ফাতাওয়াকে গুরুত্ব দিতেন। ফাতেমা জিন্নাহ ও আইয়ুব খানের প্রেসিডেন্সি ইলেকশনের সময় মুফতী ছাহেব হুযুর এক ঐতিহাসিক ফতোয়া দিলেন যে, ‘ফাতেমা জিন্নাহ না-আহাল হায়, আওর আইয়ুব খান ফাসেক হায়’। অর্থাৎ ফাতেমা জিন্নাহ অযোগ্য আর আইয়ুব খান ফাসেক হলেও যোগ্য। এই ফতোয়ার এত প্রভাব ছিল যে, শেষ পর্যন্ত ফাতেমা জিন্নাহ নির্বাচনে হেরে গেল। জমিয়ত এই ফতোয়া পেয়ে পোস্টার করে দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়ে দিয়েছে। এটি হযরত নিছক দ্বীনের খাতিরে করেছেন, রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্যে নয়।
আমি মাঝেমধ্যে ফতোয়া লিখে মুফতী ছাহেবকে দেখাতাম। একবার এক মাসআলা নিয়ে এক ছাত্র ভাইয়ের সাথে মতবিরোধ হল। মাসআলাটি হল, সূরা হজ্বের দ্বিতীয় তিলাওয়াতে সেজদা নিয়ে আমাদের সাথে অন্যান্য ইমামদের যে ইখতিলাফ তা ওয়াজিব নিয়ে নাকি ইস্তিহবাব নিয়ে। আমার তাহকীক ছিল, এ ইখতিলাফ ওয়াজিব নিয়ে; ইস্তিহবাব নিয়ে নয়। তাই সূরা হজ্বের দ্বিতীয় সেজদা ওয়াজিব না হলেও তা আদায় করা মুস্তাহাব। মুফতী ছাহেবের নিকট আমরা উভয়ে ফতোয়া লিখে দেখালে মুফতী ছাহেব আমারটা দস্তখত করেন। এজন্য আমি সূরা হজ্বের দ্বিতীয় তেলাওয়াতে সেজদা আদায় করি।
মাদরাসার নায়েবে মুফতী ছিলেন মুফতী আহমদুল হক ছাহেব। তিনি ফতোয়া লিখে মুফতী ছাহেবকে দেখাতেন। মুফতী শফী রাহ. ও মাওলানা আতহার আলী রাহ. যে বছর ইন্তেকাল করেন মুফতী ছাহেবও ওই বছর ইন্তেকাল করেন। (অর্থাৎ ১৩৯৪ হি.) এটি ছিল ওই বছরের এক বড় হাদেছা। একই বছর বড় বড় তিনজনের পরলোকগমন। খতীবে বাঙাল মাওলানা সিদ্দীক আহমদ রাহ. মুফতী ছাহেবের ছাত্র ও খলীফা ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘মাকুলাত বিষয়ে মুফতী ছাহেবের অগাধ জ্ঞান ছিল। হযরত মাদরাসা থেকে বাড়িতে যাওয়ার পথে হযরতের কাছে মাকুলাতের কঠিন কঠিন কিতাব পড়েছি। আমি একটু বলতাম, এরপর হযরত তাকরীর শুরু করতেন।’ কিতাবাদির ব্যপারে হযরতের এত বেশি ধারণা ছিল যে, কিতাব না দেখেই পৃষ্ঠা নাম্বার এমনকি পৃষ্ঠার ডান-বাম পর্যন্ত বলে দিতে পারতেন। এ হল মোটামুটি হাটহাজারী মাদরাসার মাশায়েখদের আলোচনা। আরো অনেক কিছুই বলার ছিল। কিন্তু বয়সের ভারে এখন সবকিছু মনেও নেই।
দুই.
সিলেট বিভাগের আলেমদের কথা
সিলেটকে বলা হয় আধ্যাত্মিক জগতের রাজধানী। এটি ছিল অবিভক্ত ভারতে আসাম প্রদেশের অন্যতম জেলা। এর অধীনে ছিল হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট সদর এই চারটি মহকুমা। এর মধ্যে হবিগঞ্জ অন্যতম। বর্তমানে এটি একটি স্বতন্ত্র জেলা। এ অঞ্চলে তৎকালীন হাক্কানী এক পীর ছিলেন আল্লামা শাহ আসাদুল্লাহ রাহ.। তাঁর কিছু আলোচনা পূর্বে ‘শিক্ষাজীবনের বিবরণ’ শিরোনামে করা হয়েছে। এখানে আরো কিছু তথ্য তুলে ধরা হল। তিনি ১২৮২/৮৩ বাংলায় জন্মগ্রহণ করেন। সম্পর্কে তিনি আমার নানা। নিজ গ্রাম রায়ধরে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার পর চুনারুঘাট উপজেলার ফান্দাইল গ্রামে, ফান্দাইল মাদরাসায় ওলীয়ে কামেল শাহ সুফি মাওলানা মোহাম্মদ সায়্যিদ উরফে কনু মিয়া রাহ.-এর কাছে দ্বীনী ইলম ও মারেফতের জ্ঞান হাসিল করেন। এরপর তৎকালীন ত্রিপুরা জেলা (বর্তমান কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত) হরিতলা গ্রামের মাওলানা হাসান আলী ছাহেবের খিদমতে দু বছর পর্যন্ত ফিক্হ, হাদীস ও তাফসীরসহ অন্যান্য বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। এরপর আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের জন্য পূর্বোক্ত শাহ সুফি কনু মিয়ার খেদমতে প্রায় ২০ বছর অতিবাহিত করেন। এরপর কনু মিয়া ছাহেব তাঁর পীর ও মুর্শিদ আল্লামা আব্দুল হক মুহাজিরে মক্কী রাহ.-এর খেদমতে তাকে পাঠান। এ উদ্দেশ্যে তিনি মক্কায় গমন করেন। সেখানে কয়েক বছর অবস্থান করে তাঁর কাছ থেকে খিলাফত লাভ করেন। খিলাফতের আলামতস্বরূপ আব্দুল হক ছাহেব তাকে একটি তরবারী হাদিয়া দিয়েছিলেন। নানাজী এটি সবসময় সাথে রাখতেন। আমরা সে তরবারিটি দেখেছি, এখনো সেটি আছে।
ফকীহুন নফস রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ. ও হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর সান্নিধ্যে তাঁর যাওয়ার সুযোগ না হলেও তাঁদের সাথে চিঠি আদান-প্রদান করতেন। এরপর দেশে প্রত্যাবর্তন করে দ্বীনি শিক্ষা, সমাজ সংস্কার ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রদানের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। প্রথমে হবিগঞ্জ শহরের জামে মসজিদকে কেন্দ্র করে দ্বীনি শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজ শুরু করেন।
দ্বীনী কাজ করতে গিয়ে এখানে সুলতানশী এলাকার লোকদের সাথে তাঁর বিরোধ হয়। তারা বিদআত, কবরপূজা, তাজিয়া-মর্সীয়া ইত্যাদি অনৈসলামিক কাজ করত। তিনি এসবের তীব্র প্রতিবাদ করেন। এরপর একসময় নিজ গ্রাম রায়ধরে চলে যান। সেখানে খানকাহ ভিত্তিক তালীম, তরবিয়ত ও সমাজ সংস্কারমূলক কাজ আরম্ভ করেন। তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। এছাড়া নাচ, গানসহ ষাঁড়ের লড়াই, বর্ষাকালের নৌকা-বাইচ, মহররমের তাজিয়া, নবজাতক সন্তানের নাড়িকাটা[1], ধুতি পরা ইত্যাদি প্রায় পনেরটি বিদআতি ও মানবতাবিরোধী কুপ্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং শেষ পর্যন্ত আশানুরূপ সফলকাম হন। এসব কাজের জন্য তাঁর মুজাহিদ বাহিনী ছিল। এসময় তাকে ‘জুমআ লা-জুমআ’ ফেৎনারও মুকাবেলা করতে হয়। আলেমদের মধ্যে জুমা নামায বিষয়ে তখন দুটি মত দেখা যায়। কেউ গ্রামে জুমা পড়ার পক্ষে ছিলেন কেউ বিপক্ষে। অনেক বহছ-মুবাহাছা হয়েছে এ মাসআলা নিয়ে। এ বিষয়ে তখন বহু ইস্তেফতা ভারতের আলেমদের নিকট পাঠানো হয়। ধীরে ধীরে ফেতনাটি নির্মূল হয়ে যায়।
আকাইদ ও ফেকাহ শাস্ত্রে তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল। ‘শরীয়ত নামা’ ও ‘মারেফত নামা’ কিতাব দুটি তাঁর অমূল্য অবদান। এ এলাকায় তাঁর একজন পীর ভাই ছিলেন। শায়েস্তাগঞ্জ থানার দাউদ নগর নিবাসী মৌলবী সৈয়দ শাহ আহমাদুল্লাহ ছাহেব। তিনি একজন কামেল বুযুর্গ ছিলেন। তাঁর কবর ওখানেই আছে। আমি সময় পেলে এই বুযুর্গের কবর যিয়ারত করতে যাই।
সে সময়ে মাওলানা মীর ওয়াজেদ আলী রাহ. নামে একজন আলেম ছিলেন। চুনারম্নঘাটের জিকুয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। তিনিও সমাজ-সংস্কারমূলক কাজ করতেন। আসাদুলস্নাহ মারহুমের সাথে তাঁর এ ব্যাপারে মতবিনিময় হত। একসময় মীর ওয়াজেদ আলী ছাহেব হিজরত করে ‘ছেবরী’ নামক স্থানে চলে যান। ‘ছেবরী’ ত্রিপুরায় পাহাড়বেষ্টিত একটি এলাকার নাম। বালস্না সীমামত্ম থেকে কয়েক মাইল দূরে । বর্তমানে এটি ভারতের অধীন । তিনি সেখানে একটি মুসলিম জনপদ গড়ে তোলেন। অবশ্য দেশ বিভাগের পর সে জনপদটি আর বাকি থাকেনি। তিনি ‘ছেবরীর মীর ছাহেব’ হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন।
এদিকে হবিগঞ্জের বাহুবল থানায় ছিলেন বড় আলেম দৌলতপুর নিবাসী মাওলানা আব্দুল্লাহ রাহ.। তাকে আমি পাইনি। তিনি আসাদুল্লাহ মারহুমের মুজাহিদ বাহিনীর একজন সদস্য ছিলেন।
হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে অনেক আলেম ছিলেন। এটি এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় গ্রাম। এখানে একবার শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. অসুস্থতার কারণে এক মাস ছিলেন। তাঁর বরকতে বানিয়াচং থেকে তখন সব ধরনের শিরক-বিদআত দূর হয়। এজন্য তাঁকে এ অঞ্চলে ‘দ্বিতীয় শাহজালাল’ বলা হয়। এ গ্রামের মানুষকে তিনি অনেক মহববত করতেন। একবার তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে শুধু ঈদের নামাযের (ঈদুল আযহা) ইমামতির জন্য সুদূর দেওবন্দ থেকে বানিয়াচং-এ এসেছিলেন।
মাদানী রাহ. সিলেট এলে প্রায়ই এ গ্রামে আসতেন। মাদানী ছাহেব যখন সিলেট নয়াসড়কে আসতেন তখন বানিয়াচংয়ের আলেমরাও তাঁর সান্নিধ্যে যেতেন। এ গ্রামে মাদানী রাহ.-এর অনেক খলীফা ছিলেন। তৎকালীন সময়ে এ গ্রামের উল্লেযোগ্য আলেম হলেন মাওলানা বুরহানুদ্দীন, মাদানী রাহ.-এর শাগরেদ ও খলীফা মাওলানা মুযাফ্ফার হাসান গেদু মিয়া; তিনি তাসাওউফের অনেক বড় আলেম ছিলেন। মাদানী রাহ. তাঁর জন্য জুববা পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন তিন ভাই। ভাইদের মধ্যে তিনিই বড় । বাকী দুই ভাই হলেন, মাওলানা মুয়াজ্জাম হাসান, অনেক বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। মাওলানা মুফাজ্জল হাসান চনু মিয়া। তিনি বরুনার পীর ছাহেব মাওলানা লুৎফুর রহমান বর্ণবী রাহ.-এর খলীফা ছিলেন। ২
এ গ্রামের আলিয়া মাদরাসাটি প্রথমে কওমী মাদরাসা ছিল। এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন মাদানী রাহ.-এর এক খাছ শাগরেদ মাওলানা ইউনুছ ছাহেব। তাকে মাদানী রাহ. বাংলাদেশে কাদিয়ানী ফেৎনা মোকাবেলার জন্য বিশেষভাবে পাঠিয়েছিলেন। বি.বাড়িয়ায় এ ফেতনা বেশি ছিল। তাই তিনি এ উদ্দেশ্যে সেখানে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে জামেয়া ইউনুসিয়া নামে মশহুর। এ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল কাদিয়ানী ফেৎনা মোকাবেলা করা। এছাড়া বি.বাড়িয়ার সায়দাবাদেও তিনি একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। জীবনের শেষ দিকে অসুস্থতার কারণে তিনি নিজ বাড়িতে (সম্ভবত বিহার) চলে যান। আর ফিরে আসা হয়নি। সেখানেই তাঁর কবর।
প্রকাশ থাকে যে, মাওলানা ইউনুস নামে হবিগঞ্জ শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম আলমপুরেও একজন বড় আলেম ছিলেন। তাঁর নিজস্ব কুতুবখানা ছিল। একসময় তিনি হবিগঞ্জ শহরের জামে মসজিদে দরস দিতেন। এখানেই তাঁর কাছে পড়েছেন আল্লামা শরফুদ্দীন শায়খে বেড়াখালী রাহ.। বেশ কয়েক বছর বানিয়াচংয়ের আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছেন। হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী উমেদনগর মাদরাসায়ও শিক্ষকতা করেছেন।
ওই সময় হবিগঞ্জ শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম হাফীজপুরে একজন পীর সাহেব ছিলেন। তাঁর বাড়িতে মাদানী রাহ., বরুনার পীর ছাহেব এসেছিলেন। আমিও গিয়েছি। হবিগঞ্জ শহরের চৌধুরী বাজারের পাশে নোয়াবাদ এলাকায় তাঁর মুরীদান ছিল। চৌধুরী বাজার জামে মসজিদে (তৎকালীন সময়ে এটি ‘বাজার মসজিদ’ নামে পরিচিত ছিল) একসময় বরুনার পীর ছাহেব ইতেকাফ করেছিলেন। আমি সাত বছর এ মসজিদে তাফসীর করেছি।
শায়েস্তাগঞ্জের করীমপুর গ্রামে মাওলানা মুযাফ্ফর হুসাইন নামে এক আলেম ছিলেন। তখনকার সময়ে তিনি দারম্নল উলূম দেওবন্দে দাওরায়ে হাদীসের নাম্বারে আওয়াল ছাত্র ছিলেন। হযরত আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ.-এর শাগরিদ। অনেক বড় আলেম ছিলেন। আরবীতে তাঁর রচিত কিছু চমৎকার রিসালা আছে।
মৌলভীবাজারে এক বড় আলেম ছিলেন হাবীবুর রহমান রায়পুরী। মাজযূব প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি মাওলানা নুরুদ্দীন গহরপুরী রাহ.-কে খেলাফত দিয়েছেন। হাটহাজারীর মুফতী আহমদুল হক ছাহেব হুযুর তাঁর খুবই ভক্ত ছিলেন। তাঁর আসল বাড়ী নোয়াখালীর রায়পুরে। ওখান থেকে মৌলভীবাজারে আসেন। এখানেও গ্রামের নাম রায়পুর। মাদানী রাহ.-এর খলীফা ছিলেন।
আরেক রায়পুর হল হিন্দুস্তানের রায়পুর। সেখানের প্রসিদ্ধ বুযুর্গের নাম আব্দুল কাদের রায়পুরী রাহ.।
মৌলভীবাজারের রাজনগর থানার ইন্দেসরের আলেম, মাওলানা আব্দুন নূর। তিনিও মাদানী রাহ.-এর শাগরেদ। সিলেট সরকারি আলিয়ায় ছাত্রাবস্থায়ই তিনি ফার্সীতে কাফিয়ার শরাহ ‘নাজাতুন্নুহাত’ লিখেছেন। তাঁর বাবাও বড় আলেম ছিলেন।
মৌলভীবাজারের মারকুনার এক আলেম ছিলেন হাফেজ মাওলানা আব্দুল খালেক। তাকে আমি পেয়েছি। একসাথে আমরা বিভিন্ন জায়গায় ওয়ায করেছি।
আরেকজন ছিলেন সাখাওয়াতুল আম্বিয়া। তিনি শমশের নগর, বানুরগাছী নিবাসী। ওখানে পূর্ব বাংলায় আসাম প্রদেশের মধ্যে জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের প্রথম কনফারেন্স হয়।
আরেকজন হলেন, মাওলানা আব্দুর্ রায্যাক ছাহেব। তিনি ‘দরবেশ সাহেব’ নামে মাশহুর ছিলেন। আমাদের বাড়িতেও এসেছিলেন। তাঁর বাড়িতেও গিয়েছি। শায়েস্তাগঞ্জের বার্ষিক তাফসীর মাহফিলে আসতেন। বড় আলেম হিসাবেই তাকে জানি। স্বপ্নেও তাঁকে বহুবার দেখেছি। তাঁকে হাদীসও শুনিয়েছি। তাঁর সাথে আমার চিঠি আদান-প্রদান হত। একসময় সিলেট আলিয়ায় খেদমত করেছেন। তাঁর আজীব ইতিহাস হল, ইন্তেকালের পর তাঁর কবর থেকে মেশকের মতো সুঘ্রাণ বের হত। আমি নিজেও এর সাক্ষী। কৌড়িয়ার শেখ ছাহেব মাওলানা আব্দুল করীম ছাহেবের সাথে তাঁর কবর যিয়ারত করতে গিয়ে এ ঘ্রাণ পেয়েছি।
আরেকজন হলেন শায়খে বাঘা মাওলানা বশীরুদ্দীন ছাহেব। আশেকে মাদানী হিসাবে মাশহুর। তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় অনেকবার গিয়েছেন। মাদানী ছাহেবের প্রধান খলীফাদের মাঝে তিনি একজন। শাইখে বাঘা কুরআনের আশেক ছিলেন। ওয়াযে বেশির ভাগ কুরআন তেলাওয়াত করতেন। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন।
আরেক জন হলেন শাইখে কৌড়িয়া মাওলানা আব্দুল করীম ছাহেব। তাঁর সাথে বহুবার বিভিন্ন জায়গায় সফর করেছি। মাদানী রহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা ছিলেন। তাঁর ভাই ও বাবা নামের আগে ‘সৈয়দ’ শব্দ যোগ করলেও তিনি তা করতেন না। তিনি বলতেন, ‘কোনো আওলাদে রাসুলের সাথে আমার বংশ সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপারে আমার কাছে কোনো সনদ নেই। সুতরাং এই নিসবত আমি ব্যবহার করতে পারি না’।
‘সৈয়দ’ শব্দটি আরবী ‘সায়্যিদ’ থেকে। এর এক অর্থ, জনাব। সম্মান বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। আরবে এর ব্যবহার রয়েছে। আরেক হল নিজেকে নবীর বংশের একজন সদস্য মনে করে এ শব্দ ব্যবহার করা। এর জন্য প্রমাণ থাকতে হবে। প্রমাণ ছাড়া এ উদ্দেশ্যে উক্ত নিসবত ব্যবহার করা যাবে না। আমাদের দেশে সাধারণত নিসবত বুঝানোর জন্য যারা এ শব্দ ব্যবহার করে তাদের কাছে এ ব্যাপারে না আছে কোনো সনদ, না আছে তাদের বংশ তালিকা সংরক্ষিত। যাই হোক, মূল আলোচনায় ফিরে আসি। আরেকজন হলেন আমার পীর ও মুর্শীদ শায়খে রেংগা মাওলানা বদরুল আলম ছাহেব। তিনি বলেন, প্রথমে মুফতী আযম রাহ.-এর কাছে বাইয়াত হয়েছিলাম। মুফতী ছাহেবের ইন্তেকালের সময় আমি ছিলাম হজ্বে। সেখানে থাকাবস্থায় ইস্তেখারা করে ঠিক করলাম শায়খে রেংগার কাছে বাইআত হব। এরপর হজ্ব থেকে এসে শায়খে রেংগা ছাহেবের কাছে বাইআত হই। তিনি মুফতী আযম রাহ.-এর মতো খুব সাদাসিধা মানুষ ছিলেন। বেলা-তাকাল্লুফ তথা লৌকিকতা মুক্ত। বেড়াখালের শেখ ছাহেব (মাওলানা শরফুদ্দীন রাহ.,মাদানী রাহ.-এর বিশিষ্ট শাগরেদ) বলতেন, ‘লোকটার গায়ে জুববা-পাগড়ী না থাকলেও চেহারার দিকে তাকালেই বুঝা যায় তিনি আল্লাহওয়ালা মানুষ।’
তিন.
সিলেটের আরেকজন হলেন হযরত শাহজালাল রাহ.-এর দরগাহ মসজিদের ইমাম ছাহেব মরহুম মাওলানা আকবর আলী রাহ.। আমাকে তিনি অনেক মহববত করতেন। তিনি ক্বারী তৈয়ব ছাহেব রাহ.-এর খলীফা ছিলেন। এখানে তিনি একটি মাদরাসা করেন, যা ‘কাসিমুল উলূম দরগাহ মাদরাসা’ নামে মশহুর। মুফতী শফী রাহ. তাকে মহববত করতেন। মাদরাসার নামটি তিনিই তাকে চিঠির মাধ্যমে দিয়েছেন।
সিলেটের আরেক আলেম, শায়েখ তাজাম্মুল আলী ছাহেব। তিনি ছিলেন মাদানী রাহ.-এর খলীফা। তাঁর কর্মজীবন কেটেছে যশোরে। তিনি মরহুম মাওলানা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ ছাহেবের উস্তায ও পীর। তাঁর থেকেই কাজী ছাহেব খেলাফত লাভ করেন। তিনি মুফতী ওয়াক্কাস ছাহেবেরও উস্তায ও পীর। তাঁর থেকে তিনিও খেলাফত লাভ করেন।
আরেকজন মাওলানা বশীরুদ্দীন (কুলাউড়া) ছাহেব। সিলেট গোলাপগঞ্জ থানার রানাপিং মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন মাদানী ছাহেবের ভক্ত ও মুরীদ। অনেক বড় ওয়ায়েজ ছিলেন। খেলাফত পেয়েছেন শাইখে কৌড়িয়া মাওলানা আবদুল করীম ছাহেব থেকে।
শাইখে কাতিয়া মাওলানা আমীনুদ্দীন ছাহেব (মৃত্যু : ১৪৩১ হি., ৩০ রমযান) মাদানী রাহ.-এর ছাত্র ও মুরীদ। তবে খেলাফত পেয়েছেন মাদানী রাহ.-এর খলীফা শাইখে কামারগাঁও ডা. আলী আকবর নূরী ছাহেব থেকে। শাইখে কাতিয়ার সাথে বহুবার বিভিন্ন সফরে সঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। কাতিয়া হল সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানার একটি গ্রাম। আশেকে মাদানী হিসাবে তিনিও মাশহুর। তৎকালীন সময়ে দারুল উলূম দেওবন্দে মাদানী ছাহেব যেখানে বসে পড়াতেন সেখানে বসার কোন গদি ছিল না। তখন শাইখে কাতিয়া নিজের একটি কম্বল তিন টুকরো করে একটি মাদানী ছাহেব বসার জন্য দিলেন। আরেকটি মাওলানা এজাজ আলী ছাহেবকে। আরেকটি ইবরাহীম বলিয়াভী ছাহেবকে। তখন মুহতামিম ছিলেন ক্বারী তৈয়ব ছাহেব।
আরেকজন হলেন, মাওলানা নুরুদ্দীন গহরপুরী রাহ.। শাইখে কাতিয়ার আত্মীয়। একসাথে তাঁরা দেওবন্দে পড়ালেখা করেছেন। গহরপুরী রাহ. দারুল উলূম দেওবন্দে দাওরায়ে হাদীসের নাম্বারে আউয়াল ছাত্র ছিলেন। তিনি ঢাকা বায়তুল মুকার্রম মসজিদের মারহুম খতীব ছাহেব মাওলানা উবায়দুল হক ছাহেবেরও সাথী ছিলেন। খতীব ছাহেব বলতেন, ‘তিনি আমার ক্লাসমেট’। গহরপুরী রাহ. ছিলেন মাদানী রাহ.-এর শিষ্য ও মুরীদ । তবে খেলাফত পেয়েছেন পূর্বোক্ত মাওলানা হাবীবুর রহমান রায়পুরী রাহ. থেকে।
আরেকজন হলেন, মাওলানা সিরাজুল হক রাহ. মৌলভিবাজারী। তিনি মাদানী রাহ.-এর খলীফা ছিলেন। হবিগঞ্জ শহরের নবীগঞ্জ থানাধীন পুরানগাঁও-এ তাঁর জন্ম। এ গ্রামে মাদানী রাহ.-এর আরেকজন খলীফা আছেন, মাওলানা আব্দুল মুমীন ছাহেব দা. বা.। তিনি এখনো জীবিত।
গুনই গ্রামে (হবিগঞ্জের পার্শবর্তী একটি গ্রাম) আছেন মাওলানা আব্দুল মান্নান ছাহেব দা. বা.। মাদানী রাহ.-এর খলীফা। তিনিও জীবিত আছেন। বানিয়াচং থানাধীন ধুলিয়াঘাটুয়া গ্রামে মাদানী রাহ.-এর একজন খলীফা ছিলেন, মাওলানা আব্দুর রহমান শাইখে ধুলিয়াঘাটুয়া। এ নামে চুনারুঘাটের শাহপুরে মাদানী রহ.-এর আরেকজন খলীফা ছিলেন। গুমনাম পীর ছাহেব। অনেকেই তাকে জানত না। এদিকে সফরে আসলে আমার কাছেই আসতেন। অন্য কোথাও যেতেন না।
মাদানী রাহ.-এর উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় সিলেটের বাশকান্দীতে ‘দারুল উলূম বাশকান্দী’ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে তিনি একসাথে ৪০ জনকে খেলাফত দিয়েছেন। এর মধ্যে সিলেটের অনেকেই আছেন। যেমন, শায়খে গাজীনগরী মাওলানা আব্দুল হক, শায়খ আব্দুল মুমীন ছাহেব (পুরানগাঁও, হবিগঞ্জ), মাওলানা সিরাজুল হক মৌলভিবাজারী, মাওলানা মুহাম্মাদ আলী বলরামপুরী প্রমুখ আলেম।
ফুলবাড়ির শায়েখ মাওলানা আব্দুল মতীন চৌধুরী। মাদানী রাহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা। জমিদার বংশের ছিলেন। বিয়ে করেছেন পূর্বোক্ত গেদু মিয়া ছাহেবের বোনকে। মাদানী রাহ.-এর নিকট দুইবার সহীহ বুখারী পড়েছেন। প্রথমবার পড়ার পর তাসাওউফের মেহনতের জন্য মাদানী রাহ. তাকে মদীনায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে বেশ কিছুদিন ছিলেন। সেখান থেকে আসার পর আবার সহীহ বুখারীর দরসে শরীক হন।
মাওলানা আতহার আলী রাহ.। কর্মজীবন কেটেছে কিশোরগঞ্জে, তবে জন্ম সিলেট বিয়ানী বাজার এর গুইংগাদি গ্রামে। তিনি ছিলেন থানভী রাহ.-এর খলীফা। (তাঁর আরো আলোচনা আগামীতে বলার ইচ্ছা রইল)
শ্রীমংগল থানাধীন বরুনার পীর ছাহেব মাওলানা লুৎফুর রহমান বর্ণবী রাহ.। ছোটবেলা থেকেই ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল ছিলেন। তখনি চেহারা-নমুনায় বুযুর্গির ছাপ পরিলক্ষিত হত। সিলেট সুরমা নদীর পাড়ে গাছবাড়ী মাদরাসায় পড়ালেখা করেছেন। যে বাড়িতে জায়গীর থাকতেন ওই বাড়ির লোকেরা তখনি তাকে পীরের মতো সম্মান করত। অল্প বয়সে মাদানী রাহ. থেকে খেলাফত লাভ করেন। অনেকে তা বিশ্বাস করত না। একবার সিলেটে নয়া সড়কে ইতেকাফে থাকাবস্থায় মাদানী রাহ.-কে কেউ জিজ্ঞাসা করল, ‘কিয়া আপ নে লুৎফুর রহমান বর্ণবীকো ইজাযত দী? মাদানী ছাহেব বললেন, ‘কিয়া তোমকো শুবাহ হায়? আগার তোমকো শুবাহ হায় তো ফের ছুনলো, মায় উছকো ইজাযত দেতা হু’।
উল্লেখ্য, সিলেট অঞ্চলে মাদানী রাহ.-এর অনেক খলীফা ছিলেন তবে সিলেট বিভাগে মাদানী রাহ.-এর প্রথম খলীফা হলেন ডা. আলী আকবর নূরী (কামারগাঁও)। খুব সুন্দর চেহারার অধিকারী ছিলেন।
এ হল মোটামুটি আমার সময়ের সিলেটের আলেমদের আলোচনা। আরো অনেকেই আছেন। তবে বয়সের কারণে এখন সবার কথা মনে পড়ছে না।
অনুলেখক: উস্তাযুল ফিকহ. মালিবাগ জামিয়া. ঢাকা, [সৌজন্য: মাসিক আল কাউসার ও ইসলামী টাইমস]