শিক্ষা খাতে নতুন বছরে প্রত্যাশা
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৫১:২৮,অপরাহ্ন ০৪ জানুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ৩৫৯ বার পঠিত
।। মো. সাখাওয়াত হোসেন ।।
মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে শিক্ষা। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য শিক্ষার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা। শিক্ষা বলতে মূলত গুণগত শিক্ষাকে বোঝানো হয়-আমরা আমাদের সন্তানদের কতটুকু গুণগত শিক্ষা প্রদান করতে পেরেছি-নতুন বছরে সেটি অবশ্যই প্রশ্নের উদ্রেক করে থাকে। গৎবাঁধা ও মুখস্থ পড়াশোনার ছবক পাকিয়ে নতুনভাবে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে শিক্ষা সেক্টরকে সকলের জন্য মঙ্গলজনক ও অর্থবহ করে তুলতে হবে। শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাশ এবং সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া যে পড়াশোনার একমাত্র উদ্দেশ্য নয় সে বোধটুকু সবার মধ্যে জাগ্রত করা প্রয়োজন। অন্যথায় গুণগত ও অর্থবহ শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা অসম্ভব হবে।
গুণগত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকল্পে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সরকারের সদিচ্ছার সম্মিলন প্রয়োজন। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যায়, অভিভাবকেরা জোর জবরদস্তি করে শিশুদের উপর এক ধরনের অত্যাচারই করে থাকে। নিয়মমাফিক স্কুলের পরে কোচিং সেন্টার ও বাসায় গৃহশিক্ষক রেখে সারাক্ষণ ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার মধ্যে রাখা হয়। যেখানে একটি শিশু সু্স্থ পরিবেশে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠার অবকাশ পায় না। এহেন পরিস্থিতিতে শিশুটির শারীরিক, মানবিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।
মায়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোন এক টার্ম পরীক্ষায় বন্ধুদের তুলনায় সামান্য মার্কস কম পেলে শিশুটির উপর শারীরিক নির্যাতন করতেও উদ্ধত হয়ে পড়ে।এ সকল অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ও চিন্তা ধারাকে ব্যাহত করে। তৎসাপেক্ষে কিন্ডারগার্ডেন ও কোচিং সেন্টারের উপর অতিমাত্রায় আসক্ততা প্রাথমিক শিক্ষার স্তরকে কোথায় নিয়ে এসেছে সেটি নতুন করে ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্ডারগার্টেন ও কোচিং সেন্টার বেসরকারি সেক্টরে থাকায় তেমন জবাবদিহিতার সুযোগ থাকে না।
এ কথা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে, গ্রাম কিংবা শহরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায় না। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ কিন্ডারগার্টেন ও কোচিং সেন্টার নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। কাজেই কোচিং সেন্টার বন্ধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কেননা কোচিং সেন্টার ও কিন্ডারগার্টেনে শিশুর মানবিক ও মানসিক বিকাশের সুযোগ কম থাকে। পক্ষান্তরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত শরীরচর্চা, পিটি-প্যারেড, স্কুলের মাঠে ধারাবাহিকভাবে খেলাধূলার আয়োজন, সবার সঙ্গে সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সাথে উঠাবসা ও আন্তরিকতার মেলবন্ধনে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে থাকে।
কোচিং দৌরাত্ন্যের কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের উপস্থিতির হার অনেকাংশে কমে যাওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষার পরিবেশ শিশুদের জন্য মানানসই হচ্ছে না। কারণ হিসেবে বলা যায়, কোচিং সেন্টারগুলো মুখস্থ বিদ্যাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে বিশেষ করে সেখানে বেশি নম্বর পাওয়া না পাওয়ার উপর ভিত্তি করে ভাল-মন্দ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সুতরাং বয়স পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে ছাত্রদের উপর যে পরিমাণে অমানসিক চাপ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে সেটি স্বাভাবিক ও সুষ্ঠু শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বাধাস্বরূপ।
প্রাথমিক শিক্ষা-বিশেষ নিয়োগবিশেষজ্ঞগণ ইত্যবসরে মতামত দিয়েছেন পিএসসি পরীক্ষা তুলে দেবার জন্য কেননা ইদানিং পত্রিকার পাতায় খবরে দেখা যায় পিএসসি পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না পাওয়ায় আত্নহত্যার পথ বেছে নিয়েছে কয়েকজন। পরীক্ষার ভয়, ভাল করার তাগাদা, প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ ইত্যাদি কারণে ছেলেমেয়েদের মধ্যে অছাত্রত্বসুলভ মনোবৃত্তির বিকাশ ঘটে থাকে। কাজেই প্রাথমিক শিক্ষার কারিকুলাম নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা; কোচিং বাণিজ্যে বন্ধে সর্বাত্নক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা সর্বোপরী স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে অভিভাবকদের নিয়মিত আলোচনা উদ্ভূত পরিস্থিতির সংকট কাটিয়ে প্রাথমিক লেভেলে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে।
মাধ্যমিক এবং উচ্চ-মাধ্যমিক লেভেলে ছেলেমেয়েরা সঙ্গ দোষে অনেকেই নষ্ট হয়ে যায়। মাদকের সহজলভ্যতা, দামে সস্তা, বিভিন্ন উপায়ে টাকা উপার্জনের সুযোগ থাকায় গ্রামে- গঞ্জে অনেক ছেলেরাই শিক্ষা জীবনের মারত্নক ক্ষতি সাধন করছে। শিক্ষকদের দায় রয়েছে অনেকাংশে এ ক্ষেত্রে। শিক্ষার্থীদের বিপথে গমন প্রতিরোধে শিক্ষকদের অব্যাহত প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় না তেমন। শিক্ষকদের মূল কাজই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দিয়ে ভাল কাজের দিকে মনোনিবেশ করানো যার প্রেক্ষিতে ছেলে-মেয়েরা একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি নৈতিকভাবে বলীয়ান হয়ে সমাজ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক লেভেলে অর্জিত শিক্ষার ভিত্তি দিয়েই একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে থাকে এবং শিক্ষাজীবন শেষে চাকুরি জীবনে প্রবেশ করে। এই অবস্থায় যদি কোন শিক্ষার্থীকে সুস্থ ধারায় রাখা যায় সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীটির ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দর ও স্বাভাবিক হবে এমনটাই প্রত্যাশা করা যায়। আর যদি কোন ভাবে এ অবস্থায় নষ্ট হয়ে যায় তাহলে ভবিষ্যতে ভাল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়। কাজেই সরকার সহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট অনুরোধ থাকবে প্রত্যেকে যেন স্ব স্ব জায়গায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষ জোর প্রদান করে আহূত সমস্যাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
মানোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন রকমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা যেতে পারে। তবে জোরের সঙ্গে বলছি, নতুন করে কোন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংকট ও সমস্যা নিরুপণ করে সমাধানে ব্রতী হয়ে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজই হচ্ছে গবেষণা করা, কাজেই গবেষণার জন্য যথার্থ বরাদ্দ প্রদান করা প্রয়োজন। গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল সরকার তাদের গৃহীত পলিসিতে প্রণয়ন করে জনগণের জীবনমান বৃদ্ধির পাশাপাশি নিরাপদ ও মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সার্থক হবে। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরূপে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি নিয়োগ প্রক্রিয়া যথাযথ ও আধুনিক করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় ঢেলে সাজানোর জন্য স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী নানা রকমের পদক্ষেপ নিয়ে যাচাই বাছাই করা উচিত।
শিক্ষাজীবন শেষে চাকুরিতে প্রবেশের জন্য সকল শিক্ষার্থীকে একই ধরনের প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে মূল্যায়নের প্রক্রিয়ায় যোগ্য/অযোগ্য হিসেবে নির্ধারণের পদ্ধতি পরিবর্তন সময়ের দাবি বলে মনে করি। যেমন: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স, মাস্টার্স সম্পন্ন করা একজন শিক্ষার্থী যদি ব্যাংকার হিসেবে চাকুরি জীবন শুরু করে সেখানে তার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর লেভেলে অর্জিত জ্ঞান কতটুকু কাজে লাগানো যায় এবং আর কিভাবে কাজে লাগানো হয় সেটা কিন্তু আমাদের কারোর অগোচর নয়। কতই না ভাল হতো, যদি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীকে সংশ্লিষ্ট সেক্টরে চাকুরি প্রদান করা যেত। পেশাগত বৈচিত্র্যতা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে যদিও কেউ এই দাবিতে এখনো সোচ্চার নয়। সরকারের নিকট অনুরোধ থাকবে একাডেমিক যোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি চাকুরিতে নিয়োগ দেওয়া উচিত।
উদাহরণস্বরূপ বললে আরো বলা যায়, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ হতে পাশ করা শিক্ষার্থীদের যদি বাংলাদেশ পুলিশ, প্রিজনস, সমাজ সেবা অধিদফতর, নিরাপত্তা দপ্তর, কাউন্সেলিং সহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ সম্পন্ন করা যায় তাহলে খুবই ইতিবাচক ও যথার্থ ফলাফল পাওয়া যাবে। কেননা, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মানে অর্জিত তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞানের সমন্বয়ের মাধ্যমে খুব সহজেই এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের সুরক্ষা ও সুষ্ঠু আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে পারবে। যেখানে অন্য ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থীদের তুলনায় এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের সফলতার হার ঈর্ষনীয় হবে।
সর্বোপরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জমজমাট রাখা, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা, মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক লেভেলে শিক্ষার্থীদের মাদকের ভয়াল থাবা থেকে দূরে রাখা ও অপ:সংস্কৃতি চর্চা বন্ধে উদ্যোগী ভূমিকা পালন; বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধিসহ শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি ও পেশাগত বৈচিত্র্যতা প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে। নতুন বছরে শিক্ষা খাতে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন হোক এমনটাই প্রত্যাশা করছি।