পুলিশ নেয়নি অভিযোগ, ক্ষোভে শরীর পুড়িয়ে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা!
প্রকাশিত হয়েছে : ২:১৯:৫৪,অপরাহ্ন ০২ অক্টোবর ২০১৯ | সংবাদটি ৭২৩ বার পঠিত
আমাদের প্রতিদিন ডেস্ক:: স্বামীর নির্যাতনের অভিযোগ পুলিশ না নেয়ায় রাজশাহীর শাহ মখদুম থানা থেকে বের হয়েই নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করা কলেজ ছাত্রী লিজা রহমান (১৯) মারা গেছেন।
বুধবার (২ অক্টোবর) সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
শনিবার (২৮ অক্টোবর) ওই ছাত্রী স্বামীর নির্যাতনের বিষয়ে পুলিশ অভিযোগ না নেয়ায় ক্ষোভে শাহ মাখদুম থানার সামনেই গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মাহুতি দেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। টানা চার দিন শরীর পোড়া যন্ত্রণা ভোগ করে মৃত্যুর কাছে হার মানলো রাজশাহী মহিলা কলেজের বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী লিজা রহমান।
লিজা গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার প্রধানপাড়া এলাকার আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের পালিত মেয়ে। নগরীর পবাপাড়া এলাকার একটি মেসে ভাড়া থাকতেন লিজা।
তার স্বামী সাখাওয়াৎ হোসেন (২০) চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার খানদুরা গ্রামের খোকন আলীর ছেলে ও রাজশাহী সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। সাখাওয়াতও রাজশাহীতে একটি ছাত্রাবাসে থাকেন। কিন্তু পরিবারকে না জানিয়েই লিজাকে তার গোবিন্দগঞ্জের বাড়িতে গিয়ে বিয়ে করেন সাখাওয়াৎ।
লিজার আত্মহত্যার কারণ জানতে মাঠে নেমেছে দুটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি। যার মধ্যে একটি মানিবাধিকার কমিশন এবং অপরটি পুলিশের।
রাজশাহী মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকতাকে তদন্তভার দেয়ার পাশাপাশি আজকের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পুলিশের পাশাপাশি ঘটনাটির সঠিক কারণ জানতে পৃথকভাবে তদন্ত করছে মানবাধিকার কমিশনও। আর এমন ঘটনায় সঠিত তদন্ত শেষে কলেজছাত্রী লিজাকে কেউ আত্মহত্যার প্ররোচনা দিয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, পরিবারের কাছে গোপন রেখে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি রাজশাহী সিটি কলেজের ছাত্র সমবয়সী সাখাওয়াত হোসেনকে বিয়ে করেন লিজা। জুলাই মাসে ঘটনা জানাজানির পর ছেলের পরিবার মেনে না নিলে শুরু হয় সংসার জীবনে কলহ। এক পর্যায়ে কোনও উপায় না দেখে লিজা ছুটেছিলেন থানা পর্যন্ত।
রাজশাহী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দা নিলুফার ফেরদৌস বলেন, মেধাবী ছাত্র লিজা রহমান কিছুদিন যাবৎ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। সে কলেজেও অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিল। স্বামীর সঙ্গে ঝামেলার কারণে তার এ অবস্থা হয়েছে। তাই লিজা স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে থানায় গিয়েছিল।
সেখানে এমন কী হলো যে, থানা থেকে বের হয়েই গায়ে আগুন দিল? এর সঙ্গে যদি কেউ জড়িত থাকে তার শাস্তির দাবি জানান এই অধ্যক্ষ।
এদিকে, কেন সে আত্মহ্যার চেষ্টা চালালো? -এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মাঠে নেমেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের অভিযোগ ও তদন্ত বিভাগের পরিচালককে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে কমিটির সদস্যরা।
বুধবার মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং সিটি কলেজের লিজার স্বামীর সহপাঠিসহ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে মহানগর পুলিশ।
মানবাধিকার কমিশন কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক আল মাহমুদ ফাইজুল কবীর বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান তদন্ত কমিটি করে আমাদের রাজশাহী পাঠিয়েছেন। আমারা বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলছি। জানার চেষ্টা করছি থানা থেকে বের হয়েই কেন মেয়েটি আত্মহত্যার চেষ্টা চালালো।
তদন্ত শেষে তারা কমিশনের কাছে প্রতিবেদন দেবেন বলেও জানান তিনি।
মানবাধিকার কমিশনের পাশাপাশি এ ঘটনাটি খতিয়ে দেখছে নগর পুলিশও। এতে পুলিশের কোন গাফিলতি পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানালেন রাজশাহী নগর পুলিশ প্রধান হুমায়ূন কবির।
তিনি বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে লিজার সঙ্গে অসহযোগিতামূলক আচারণ খতিয়ে দেখতে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। বুধবার তাদের প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে। তদন্তে লিজাকে অসহযোগিতার প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ ঘটনায় এখনও কোন মামলা দায়ের করা হয়নি জানিয়ে হুমায়ূন কবির বলেন, লিজার পরিবারের সদস্যদের মামলা করতে ডাকা হয়েছে। তারা যদি মামলা না করে তবে পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করবে। আর তদন্তে যদি লিজার স্বামীসহ তার পরিবারের সদস্যদের আত্মহত্যার প্ররোচনার প্রমাণ মিলে তবে তাদের আইনের আওতায় নেয়া হবে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত জুনে স্ত্রী লিজার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে গ্রামের বাড়ি গিয়ে থাকতো সাখাওয়াৎ। জুলাইয়ের প্রথম দিকে লিজা সাখাওয়াতের খোঁজে ছুটে যান নাচোলে। স্বামীর বাড়ি খুঁজে বের করেন। লিজাকে দেখে সাখাওয়াৎ বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। এ নিয়ে লিজা নাচোল থানা পুলিশে অভিযোগ করেন। পুলিশ সাখাওয়াৎ ও তার বাবাকে থানায় ডেকে এনে তাদের সঙ্গে লিজাকে পাঠিয়ে দেন। এরপর কয়েকদিন একসঙ্গে থাকলেও রাজশাহীতে ফিরে আবারও স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন সাখাওয়াৎ।
সূত্রটি আরও জানায়, কয়েকদিন আগে লিজার সঙ্গে দেখা করেন সাখাওয়াতের এক ভগ্নিপতি। ওই সময় সাখাওয়াৎও সঙ্গে ছিলেন। তারা লিজাকে মারধর করেন। সেই থেকে লিজা অভিযোগ দেয়ার জন্য নগরীর শাহমখদুম থানায় ঘুরছিলেন। সর্বশেষ শনিবার দুপুরে আবারও শাহমখদুম থানায় যান লিজা। সেখানে ডিউটি অফিসারকে তার অভিযোগ রেকর্ড করার জন্য অনেকবার অনুরোধ করেন। ডিউটি অফিসার তা না করায় ওসির সঙ্গেও দেখা করেন লিজা। কিন্তু ওসি তাকে পাগল বলে পাত্তা না দিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে গিয়ে অভিযোগ দিতে বলেন ওসি নিজেই। পরে শাহ মাখদুম থানা চত্বরে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে জান লিজা। এরপর থানা থেকে বের হয়েই ১০০ গজ দূরে মহিলা কারাগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের গেটের সামনে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেন লিজা।
নাম প্রকাশ না করে স্থানীয় এক চা বিক্রেতা জানান, মুহূর্তেই লিজার শরীরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় লোকজন গিয়ে আগুন নিভিয়ে একটি অটোরিকশা করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সে সময় সেখানে পুলিশও ছিল।
শাহমাখদুম থানার ওসি মাসুদ পারভেজ বলেন, লিজার অভিযোগ শোনা হয়েছিল। তার অভিযোগ মামলা আকারে রেকর্ডের নির্দেশও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে হঠাৎ করেই থানা থেকে বের হয়ে গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। কি কারণে লিজা এতটা মানসিক যন্ত্রণায় ছিল তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তবে পাগল বলে পাত্তা না দিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার অভিযোগ অস্বীকার করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
পুলিশের তদন্ত কমিটির প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার সালমা বেগম বলেন, তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বুধবার তার শেষ দিন। তদন্ত শেষ পর্যায়ে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। তবে তদন্তে কি ধরণের তথ্য পাওয়া গেছে তা জানাতে অস্বীকার করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
তবে পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে, লিজার পালিত বাবা রাজনৈতিক মামলায় কারাগারে আছেন। এ অবস্থায় তার টাকা-পয়সার সংকটও চলছিল অনেকদিন ধরে। লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়েছিল। অন্যদিকে স্বামীও তার দায়িত্ব নিতে চাইছিল না। ফলে দু’জনের দেখা হলেই ঝগড়া হতো। সম্প্রতি স্বামী তাকে নির্যাতন করেন। এসব কারণে মেয়েটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। পুলিশের কাছে অভিযোগ দিতে ব্যর্থ হয়েই সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।