সেতু না থাকায় বাঁশের সাঁকো ও খেয়া নৌকাই ভরসা!
প্রকাশিত হয়েছে : ১:২৫:৩৫,অপরাহ্ন ২২ জুন ২০১৯ | সংবাদটি ৯৫৫ বার পঠিত
জকিগঞ্জ থেকে রহমত আলী হেলালী: জকিগঞ্জের আটগ্রাম ও কানাইঘাটের কাড়াবাল্লা এলাকায় সুরমা নদীর উপর সেতু না থাকায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন দুই উপজেলার কয়েক লক্ষাধিক মানুষ।
এখানে সেতু নির্মাণ হলে সিলেটের জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলার মধ্যে সরাসরি ‘সেতু বন্ধন’ এর দ্বার উন্মোচিত হবে। এ সেতু নির্মাণ করা হলে জকিগঞ্জ উপজেলা ও কানাইঘাট উপজেলার মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন একধাপ এগিয়ে যাবে। সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন সিলেট জেলা শহরের সাথে সরাসরি আসা-যাওয়া করতে পারবেন। ফলে সহজতর হয়ে উঠবে শিক্ষা, কৃষি, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুবিধা ভোগ করার।
গুরুত্বপূর্ণ এ স্থানে সেতু না থাকায় শত শত শিক্ষার্থীসহ লক্ষাধিক মানুষের ভরসা বাঁশের সাঁকো ও খেয়া নৌকা।
সরেজমিনে দেখা যায়, সুরমা নদীর উত্তর পারে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলা এবং দক্ষিণ পারে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অবস্থান রয়েছে। কানাইঘাট উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলের কাড়াবাল্লা, কান্দিগ্রাম, বড়চাতল, মাজরগ্রাম, ফাটাউরা, এরালিগুল, ডনা বাজার, সুরমা বাজার, বাকুড়ি, রাতাছড়া, খাশিয়া পুঞ্জি, রতনেরগুল, বালিছড়া, নগুড়ি, হিলাইন, লুহাজুরি, মাঝরকান্দি, বড়খেওড়, মমতাজগঞ্জ ও লোভাছড়া এলাকা সহ ১নং লক্ষিপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের বাসিন্দারা সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে জকিগঞ্জের আটগ্রাম এলাকা হয়ে বিভাগীয় শহর আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। অপরদিকে জকিগঞ্জ উপজেলার লোকজন সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়া পাথর কোয়ারী, খাশিয়াপুঞ্জি থেকে পান সংগ্রহ, পাহাড়ী এলাকা থেকে কলা, কমলা, কাঁঠাল, লটকন ও পেয়ারা সহ নানা ফলমূল ক্রয় করতে যান। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের পর্যটকরা খাশিয়াপুঞ্জি সহ পাহাড়ি এলাকা ঘুরতে পুরো বছর জুড়েই আটগ্রাম-কাড়াবাল্লা হয়ে খাশিয়াপুঞ্জিতে ঘুরতে যান। সেখানকার নদী-নালা, খাল-বিল, সমতলের সবুজ গ্রাম, পাহাড়-টিলা ও পাহাড়ী ঝরনা আগতদের প্রচুর আকৃষ্ট করে। এছাড়া প্রতিবেশী এলাকা হওয়ায় আত্মীয়তা ছাড়াও প্রতিনিয়ত জকিগঞ্জ উপজেলার ৩নং কাজলসার ইউনিয়নের আটগ্রাম, চারিগ্রাম, বড়বন্দ, নওয়াগ্রাম, মাদাননগর, রায়গ্রাম, মরিচা, নগরী, কাজিরপাতন, লক্ষিপুর, জালালবাদ, বড় বাড়িগ্রাম, চানপুর, গোটারগ্রাম, বালাউট, মঙ্গলশাহ, পলাশপুর, নিলাম্বরপুর, জামুরাইল ও কামালপুর সহ সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে অবস্থিত কানাইঘাট উপজেলার রাজপুর, কঠালপুর, ব্রাম্মণগ্রাম, ছত্রনগর, দর্পনগর, কুওরের মাটি, করছটি ও আগছটি গ্রাম সহ প্রচুর গ্রামের মানুষের ওপারের লোকজনের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই কানাইঘাটের লোকজন জকিগঞ্জ উপজেলার আটগ্রাম বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে আসছেন। শুধু তাই নয় শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকায় কানাইঘাটের দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও সেই অতিত কাল থেকে জকিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখা পড়া করে আসছে। বর্ষা মৌসুমে সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে প্রবল ¯্রােতের মধ্যে লোকজন ঝুঁকি নিয়ে খেয়া নৌকায় নদী পার হয়ে থাকেন। তাছাড়া নৌকা ডুবির ঘটনা তো হরহামেশাই হচ্ছে। ইত্যাদি নানা কারণে সুরমা নদীর উপর সেতু নির্মাণ এলাকাবাসীর যোক্তিক দাবি। এলাকাবাসীর দাবির কারণে সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ্ব সেলিম উদ্দিন তাঁর মেয়াদের শেষ সময়ে এখানে একটি সেতু নির্মাণের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পরাজিত হওয়ায় সেই প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবায়নের দিকে আগায়নি।
স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কানাইঘাট উপজেলার ১নং লক্ষিপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়ন প্রচুর সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। এ অঞ্চলের লোভা ছড়া পাথর কোয়ারি থেকে সরকার বছরে কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করছে। লোভানদী থেকে সিলেট সহ দেশ জুড়ে উন্নত পাথরের যোগান হচ্ছে। লোভার বালুর প্রতি মানুষের চাহিদা অনেক। যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধাজনক না হওয়ায় প্রচুর সম্ভাবনাময় বড়চাতল এলাকার পরিত্যক্ত পেট্রোল বাংলাটি কারো নজরে আসছেনা। অদৃশ্য কারণে আটকে থাকা সম্ভাবনাময় পেট্রোল বাংলাটি চালু হলে দেশের অর্থনীতির চাকা আরেকধাপ এগিয়ে যাবে। পান উৎপন্নকারী খাসিয়াপুঞ্জি সহ পহাড় ও ঝর্ণা পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করলেও এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সুবিধাজনক না হওয়ায় পর্যটকরা আসতে চাননা। পহাড়ি অঞ্চলে প্রচুর ফলমূল ফলন হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা না থাকায় ক্রেতা-বিক্রেতা সকলেই বিপাকে রয়েছেন। স্থানীয়রা সংশ্লিষ্টদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের জনপ্রতিনিধি সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল সুরমা নদীতে সেতু নির্মাণে কেন কাল ক্ষেপণ করছেন তা আমারা বুঝতে পারছি না। কেন দুই উপজেলার সেতুবন্ধনে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। অথচ সুরমা নদীতে একটি ব্রিজ নির্মাণ হলে আটগ্রাম বড়চাতলস্থ তৈল কুপ থেকে পুনরায় তৈল উত্তোলন করে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি সম্ভব। পূর্ব কাড়াবাল্লার ভারতীয় সীমান্তের সাথে কাস্টম বা করিডোর স্থাপন করে ভারত-বাংলাদেশ ব্যবসায়ীক সম্পর্ক উন্নয়ন সম্ভব। কাড়াবাল্লা টু ছতিপুর রাস্তার কাজ তরান্বিত করতে কাড়াবাল্লা টু লোভাছড়া টু কানাইঘাট হয়ে জেলা শহরের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন সম্ভব। উন্নয়নমূখী এমন অসংখ্য কারণ থাকার পরও সুরমা নদীতে সেতু না করাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত এমন প্রশ্ন এলাকাবাসীর।
আটগ্রাম বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ঘাট দিয়ে ছোট-ছোট নৌকায় লোকজন সুরামা নদী পার হচ্ছেন। শিক্ষার্থী, মহিলা ও শিশু সহ ১৫-২০ জন লোককে তুলে একেকটি নৌকা বোঝাই দিয়ে নৌকা ‘ডুবুডুবু’ অবস্থায় নদী পার করা হচ্ছে। এমনকি নৌকা দিয়ে মোটরসাইকেলও পার করতে দেখা যায়। ঘাট এলাকার ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ নৌকা দিয়ে নদী পারপার করে থাকেন। সুরমা নদীর এ পারে জকিগঞ্জ এলাকায় গাড়িচলাচল করলেও ওপারে কানাইঘাট এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় ভাড়া করে মোটর সাইকেলে মানুষ যাতায়াত করছে।
৩নং কাজলসার ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এম.এ.রশীদ বাহাদুর জানান, সেতু নির্মাণের দাবিতে সময়ে সময়ে স্থানীয়রা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন। এ দাবি আদায়ে সম্প্রতি এলাকাবাসী সভা করে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, সুরমা নদীতে সেতু নির্মাণ হলে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন সাধিত হবে। তিনি এ যুক্তিক দাবি পূরণে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান।
এ ব্যাপারে কানাইঘাট উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মোমিন চৌধুরী বলেন, কানাইঘাট উপজেলার একটি বিশাল অংশের দাবী পূরণে সুরমা নদীতে একটি সেতু নির্মাণ সময়ের দাবী। এলাকাবাসীর এ দাবী পূরণে আমার আপ্রাণ চেষ্ঠা রয়েছে।
জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান লোকমান উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আটগ্রামে সুরমা নদীতে সেতু নির্মাণ এটা সময় সাপেক্ষ বিষয়। সভা-সমাবেশ আর আন্দোলন করে এসব দাবী আদায় করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ ফাইলপত্র তৈরী করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দপ্তরে যোগাযোগ রাখা। এই মুহুর্তে আটগ্রাম-কাড়াবাল্লা এলাকায় সেতু নির্মাণ করা আমাদের পরিকল্পনায় নেই।
সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ-কানাইঘাট) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব হাফিজ আহমদ মজুমদার বলেন, দেশের অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে আটগ্রাম-কাড়াবাল্লা এলাকায় সুরমা নদীতে সেতু করা অসম্ভব। এই মুহুর্তে এখানে কোন সেতু করার পরিকল্পনা আমার হাতে নেই। তবে খুব শীঘ্রই আমরা লোভা নদীতে একটি সেতু নির্মাণ করার চিন্তা রয়েছে।