গ্রন্থ সমালোচনা : ব্রিটেনের রূপসী বাংলা ও আমাদের জীবনকথা
প্রকাশিত হয়েছে : ১:২৪:৪৩,অপরাহ্ন ০১ অক্টোবর ২০১৬ | সংবাদটি ১১৫৪ বার পঠিত
ফারুক আহমদ : বইটি ২০১৫ সালে একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল। আমার কাছে ডাকযোগে আসে, ১০ই এপ্রিল। প্রেরক আমার অত্যন্ত আপনজন, যাকে, পরিচয় হবার পর থেকেই ‘আপা’ বলে ডাকি এবং তিনিও আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করেন, সেই রায়হানা মাহবুব। বইটি সকালে এসেছিল। তাই নাস্তার টেবিলে বসে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে দিয়ে যখন ২১ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়ে ফেলেছি, ঠিক তখনই পাশে রাখা মোবাইল ফোনটি বেসরিকের মতো বেজে ওঠে। ছেদপড়ে পাঠে। ওপারে রায়হানা আপার কণ্ঠ। জানালেন, রূপসী বাংলাকে নিয়ে বই লিখেছেন। আমার জন্য একটি কপি পাঠিয়েছেন। আমি বইটির প্রাপ্তি স্বীকার করে, একুশ পৃষ্ঠাপর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়ার পাঠপ্রতিক্রিয়াও জানালাম। বললেন এ নিয়ে সম্ভব হলে লিখতে। তিনি কখনো কোনো এ ধরণের লেখার কথা বলেন না। তাই লিখব বলে কথা দিলাম। তারপর ২০১৫ সালটি কেটে গিয়ে এখন ২০১৬ সালের আরেক ফেব্রুয়ারি। এর মধ্যে রূপসী বাংলাও বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ বইটি সম্পর্কে এখনো কিছইি লেখা হয়নি। আসলে এতোদিন আমার নিজের একটি বইয়ের কাজে ব্যস্ত ছিলাম করছিলাম।
ইংরেজি নববর্ষের সময় কিছুটা অবসর পাওয়ায় বইটি আবারও প্রথম থেকে পড়তে শুরু করি। এ যেন রায়হানা মাহবুবেরই জীবনকথা নয়, আমার-আপনার অতি চেনাজানা কোনো অতি আপনজনের জীবনকথা। ব্যতিক্রম হচ্ছে, রায়হানা আপার অভিজ্ঞতার ভা-ার যেমন বিশাল, তেমনি তিনি ভাগ্যবান ও জীবনযুদ্ধে জয়ী। আমার-আপনার দেখা জীবনযুদ্ধের নায়িকারা বেশীর ভাগই নিয়তির কাছে পরাজিত। মিল শুধু জীবনসংগ্রাম আর অনিশ্চয়তার। আবার তিনি যখন আনমতে তার মায়ের ছবিটি কালির আচঁড়ে কথায়মালা আঁকতে থাকেন তখন আমিও আমার মাকে অবিকল খুঁজে পাই। অনেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মনেপড়া’ কবিতাটির মতো: “মা বুঝি গান গাইত আমার/ দোলনা ঠেলে ঠেলে/ মা গিয়েছে, যেতে যেতে/ গানটি গেছে ফেলে”।
এই কবিতাটি যখনই পড়েছি, মনে হয়েছে এবং এখনো একই বিভ্রম হয়, মা বুঝি এসে দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক আমার পেছনে। আর আমি তাঁর সেই ছোট্ট শিশুটি। তিনি দোলনাটি ঠেলছেন, আমি পেছন ফিরলেই তাঁকে দেখতে পারি, হাত বাড়ালেই তার স্নেহময় স্পর্শ অনুভব করতে পারি। কিন্তু ফিরে তাকাতে পারছি না, ধরতে পারছি না। কারণ, আমিতো তাঁর সেই ছোট্ট শিশুটি। কবিতাটি যতবার পড়েছি, নিজের অজান্তেই ফিরে গেছি সেই শৈশবে। এই কবিতার মতো যিনি কথার যাদু দিয়ে মানুষকে জীবনের বাঁকে বাঁকে নিয়ে যেতে পারেন, নাড়ি ধরে টান দিতে পারেন, তিনিই কথাশিল্পী। রায়হানা মাহবুব সেইঅর্থে হয়ত কথাশিল্পী নন, কিন্তু অতি অবশ্যই একজন শিল্পী। এই গ্রন্থটিই তার উজ্জ্বল প্রমাণ। তিনি তাঁর স্বামী, মা, চাচা-চাচী, এই সকল সরল-সহজ মানুষগুলোর সাধামাটা জীবনের ছোট ছোট ঘটনাগুলোকে অসামান্য করে এঁকেছেন তাঁর এই আত্মজৈবনিক গ্রন্থটিতে। তাঁর রচনার গঠনশৈলী, ভাষাগত সারল্য, প্রয়োগের যুক্তিনির্ভর চমৎকারিত্য ও নাটকীয়তা পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ না করে পারে না। এই বইয়ের নায়ক-নায়িকা ও অন্যান্য পাত্রপাত্রী, স্থান ও কাল কোনোটাই আমার খুব বেশী পরিচিত নয়। কিন্তু বইটি পড়তে গিয়ে তাঁর লেখার সারল্য স্থান-কাল-পাত্রের গ-ি অতিক্রম করে বইটি কখন যে আমার অভিজ্ঞতার আঙিনায় চলে এসেছে বুঝতে পারিনি।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলেছিলেন, “দৈনন্দিন অস্তিত্ব জীবনের পরিচয় নয়, জীবন হল সেই স্মৃতি যা আমরা এমনভাবে মনে রাখি যাতে অন্যদের শোনাতে পারি।”
রায়হানা মাহবুব এই বইটির মাধ্যমে তাঁর জীবনের স্বার্থক চিত্র অঙ্কন করে আমাদের শুনিয়েছেন। আমরাও মুগ্ধ হয়ে তা শুনেছি। কিন্তু বইটির ৪৭ পৃষ্ঠায় গিয়ে এই মুগ্ধতায় ছেদ আসে। যখন সমাজ বিজ্ঞানের এই কৃতিছাত্রী লেখেন: “পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে ছিল একটি বহু বছরের বঞ্চনার অভিযোগ, বহু বছরের সংগ্রাম ও সাধনা। কিন্তু বাংলাদেশ হয়েছে একটা আদর্শহীন, পরিকল্পনাহীন, তাৎক্ষণিক হৃদয়াবেগের জোয়ারের ফল। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে ‘ইট ওয়াজ লাইক এ কুইক কনসিভ অ্যান্ড আর্লি ডেলিবারি’। আমাদের আদর্শ দানা বাঁদতে আর একটু সময়ের প্রয়োজন ছিল। সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি ঘটে গেছে। সেজন্য রক্তহানি হয়েছে প্রচুর, সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, আর শুধু তাই নয় পাকিস্তান থেকে আমাদের প্রাপ্য সব কিছুর অর্ধেক থেকেও আমরা বঞ্চিত হয়েছি।”
এই কথাগুলো পড়ার পরে বাধ্য হয়েই থামতে হয়। ভাবতে ভাবতে বাধ্য হই আসলেই তিনি কে? অর্থাৎ তাঁর আদর্শগত অবস্থান, দেশপ্রেম ইত্যাদি বিষয়ে একজন পাঠক হিসেবে সন্দিহান না হয়ে পারি না। তারপর আবরও হোচঠ খেতে হয় তিনি যখন তার স্বামী, ‘ড. মাহবুব আহমদের প্রবাসজীবনের নেপথ্যকথা’ শিরোনামে লেখেন: “১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের কতিপয় শিক্ষকের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পড়েন তিনি। ওই সময় দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতাকে অনেকেই স্বার্থসিদ্ধি ও দলাদলির জন্য ব্যবহার করেছেন, যার সঙ্গে বাংলাদেশের বা স্বাধীনতার কোনো সম্পর্ক ছিল না। একপর্যায়ে তাঁর জীবননাশের পর্যন্ত চেষ্টা করা হয়।
১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ছিলেন ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী। তিনি মাহবুব আহমদকে ছুটিতে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেন এবং কারণ হিসেবে বলেন যে, তিনি তার নিরাপত্তা প্রদান করতে পারবেন না […]”। ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন আবারও মনে প্রশ্ন জাগে, এমন কি যাঁরা ড. মাহবুবু আহমদকে জানেন না তাঁদের মনেও প্রশ্ন জাগতে বাধ্য যে, তাঁর বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ ছিল। কেনইবা ড. মাহবুবকে এ ধরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল? কারা অভিযুক্ত করেছিলেন? এ ব্যাপারে লেখক অবশ্য কিছু উদাহরণ দিয়েছেন। কিন্তু তা পড়ে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। বরং তাঁকে নিয়ে আলো-আধারীর মতো নানা প্রশ্ন মনে দেখা দেয়। ঠিক একইভাবে ‘আত্মপরিচয়ের সন্ধানে কিছু কথা ও আমার ভাবনা’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত লেখকের মূল্যায়ন পর্বটিও পাঠককে ভাবাবে বলেই ধারণা করি। এখানেও লেখক তথ্যসূত্রসহ অনেক উদাহরণ টেনে কোনো কারণ ছাড়াই অনেকটা গায়ে পড়ে নিজের ও তাঁর স্বামীর অবস্থান পরিষ্কার করতে চান। কিন্তু কেন এই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা? ড. এাহবুব আহমদ একজন শিক্ষক। জ্ঞান ও সত্যেক সাধক, অন্তত লেখকের ভাষায়। তাই যদি হয়, তা হলে, যিনি সাধক তাঁর কানে মোল্লা-পুরুতের ফতোয়াবাজী, কুৎসার বিষবাষ্প গিয়ে পৌছাবে কেন?
এই দুটো অধ্যায়ে গ্রন্থটির সাধারণ গতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলেই আমার মনে হয়েছে। তারপর ‘প্রবাস জীবনের শুরু’, ‘লন্ডনে রূপসী বাংলার স্বপ্ন’, ‘মিশরপর্ব’, ‘আবার রূপসী বাংলা’ শিরোনামে লেখকের জীবনকথা শুধু সুখপাঠ্যই নয় নানা ঐতিহাসিক তথ্যে সমৃদ্ধ। বিশেষ করে বিলাতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় রূপসী বাংলা এবং এর কর্ণধার ড. মাহবুবউদ্দিন আহমদ ও মিসেস রায়হানা মাহবুবের তুলনা শুধু তারাই। পরিশেষে রয়েছে মাহবুব আহমদের লেখা, ‘ডাক্তার ইব্রাহীমের উপদেষ্টা হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা’ এবং তাঁর একটি সাক্ষাৎকার। বইটিতে অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দের ব্যবহার সাধারণ পাঠকের জন্য বিরক্তির কারণ হতে পারে। দৃষ্ঠি নন্দন, ঝকঝকে ছাপা বইটিতে মুদ্রণপ্রমাদ নেই বললেই চলে। সব মিলিয়ে এটি একটি চমৎকার গ্রন্থ। এই গ্রন্থ পাঠে পাঠক শুধু লেখকের জীবন অ্যালবামের ছড়িয়ে থাকা শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বিবাহ, মিলন-বিরহ নামক অসংখ্য ঘটনার অনবদ্য বর্ণনাই শুধু শুনবেন না, সেইসঙ্গে পাবেন বিশ শতকের পাঁচ দশক থেকে পুরো সাত দশক পর্যন্ত গ্রাম ও শহরের মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রা, তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থাসহ আরো অনেক বিষয়ের নিরাবরণ কিন্তু তথ্যাশ্রয়ী চিত্র। পাবেন বিলাতের বাঙালির চার দশকের অনেক অজানা কাহিনি। যা ইতিহাসের উপাদান হিসেবে, বিশেষ করে বিলাতের লেখক-গবেষক ও সাংবাদিকের সংগ্রহে থাকা জরুরি বলেই মনে করি। সেইসঙ্গে বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি। বইটির প্রকাশক: অন্যপ্রকাশ, ঢাকা। প্রচ্ছদ এঁকেছেন: মাসুম রহমান। মূল্য: বাংলাদেশে ২২৫ টাকা এবং ৯ ডলার। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ড. মাহবুবউদ্দীন আহমদকে।