আনোয়ার শাহজাহানের ‘বিলেতের দিনগুলি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ বইয়ের পাঠ প্রতিক্রিয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:০৪:৫৫,অপরাহ্ন ০৫ এপ্রিল ২০২১ | সংবাদটি ১২৫০ বার পঠিত
মিলন উদ্দিন লস্কর, আসাম, ভারত:
লেখক আনোয়ার শাহজাহান তাঁর প্রবাস জীবনের প্রারম্ভিক দিনগুলির নানা অভিজ্ঞতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, কঠিন জীবন সংগ্রাম, সফলতা নিয়ে ‘‘বিলেতের দিনগুলি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’’ বইটি ১৯৯৫ সালের নভেম্বর মাসে আশা প্রকাশনী থেকে বের করেন। বইটির প্রচ্ছদ একেঁছেন ধ্রুব এষ এবং ভূমিকা লিখেছেন প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ‘প্রবাসীর কথা’ গ্রন্থের লেখক নুরুল ইসলাম। বইটি লেখক তার বাবা আব্দুল মুতলিব এবং মা আঞ্জুমান আরা বেগম-কে উৎসর্গ করেছেন।
পরিবার-পরিজন ছেড়ে, উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ার গড়তে অনেকেই প্রবাস জীবনে পাড়ি জমায়। অজানা এক নতুন জায়গায়, নতুন পরিবেশে, অচেনা হাজারো মানুষের ভীড়ে, নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক কঠিন সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয় সকল প্রবাসীকেই। অথচ আমরা ক’জনই বা সেই খোঁজ রাখি।
বিদেশ বিভূইয়ে ভিনদেশী মানুষের মন-মানসিকতা, আচার আচরণ, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সেখানে অবস্থানরত প্রবাসীদের জীবন-যাপনের সুখ-দুঃখ, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ, নিজস্ব ঐতিহ্য রক্ষা করতে তাদের প্রচেষ্ঠা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে লেখক আনোয়ার শাহজাহান বইটি রচনা করেছেন। অনায়সে বলা যায়, লেখক আনোয়ার শাহজাহান এর গবেষণাধর্মী তথ্যবহুল সমাজবিশ্লেষণমূলক একটি বই ‘‘বিলেতের দিনগুলি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’’।
পাঠকদের সুবিধার্থে বইটি থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ আলোকপাত করা হলো। বিলেতের দিনগুলি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ বইটি পড়তে যেয়ে, একজন পাঠক হিসেবে আমি বলতে পারি, বইটিতে লেখক আনোয়ার শাহজাহান এক দক্ষ মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তা হলো, যেকোন পাঠক বইটি পড়তে যেয়ে, আবেগআপ্লুত হয়ে পড়বে। হয়তো চোখের কোণে, মনের অজান্তেই জমে উঠবে জ্বল। আবার কখনো গুরুত্বপূর্ণ নানা অজানা তথ্য জেনে বিস্মিত হয়ে পড়বে। বিলতে যেতে ইচ্ছুক কিংবা প্রবাসী যারা আছেন, তাদের কঠিন সংগ্রামের নানা তথ্য বইটি থেকে জানা যায়।
১৯৯৫ সালের ৯ মার্চ দিনটি লেখকের জীবনের একটা স্মৃতিবিজড়িত দিন। সেদিন দেশের সবুজে ছেয়ে থাকা বনানী, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, পাখির কলকাকলী, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব সকলের ভালোবাসা ও গভীর মায়া কাটিয়ে একে একে সব আনুষ্ঠানিকতা ছেড়ে সুষ্ঠ মতো নির্দিষ্ট দিনে পৌছে যান লন্ডনের বিমান বন্দরে। অতঃপর সেখানের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে স্বাক্ষাত। এ নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন লেখক বইটিতে।
প্রবাসীদের মন-মানসিকতা, ধ্যান ধারণা নিয়ে লেখক সাংবাদিক ইব্রাহিম চৌধুরী খোকনের একটি দারুন মন্তব্য তুলে ধরেছেন। তা হলো ‘‘যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিশাল বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীকে সাধারণত তিনভাগে ভাগ করা যায়।এই তিনভাগের প্রথম ভাগে যারা রয়েছেন, তারা চিন্তায়-চেতনায় সংস্কৃতিতে অগ্রসর। দ্বিতীয় দলটি আছেন উর্পাজন ও সঞ্চয়ে। আর তৃতীয় দলটি হচ্ছেন, আলসে, কর্মবিমুখ। ’’সাংবাদিক ইব্রাহিম চৌধুরীর এই মন্তব্যতেই আমরা প্রবাসীদের জীবনযাত্রার একটি সাধারণ চিত্র দেখতে পাই।
তথ্যবহুল একটি বিষয় বইটিতে পাওয়া যায়, তা হলো, ভারত বর্ষ থেকে প্রথম বিলেতে আসেন, মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিন। তিনি ১৯৯৭৫ সালে লন্ডনে আসেন দিল্লী সম্রাটের প্রতিনিধি হয়ে বৃটেনের রাজার কাছে কিছু দাবী দাওয়া নিয়ে।
আরো জানা যায়, ইংরেজরা ভারতবর্ষে আগমের পর পরই শত শত সাধারণ মানুষ নাবিক হিসেবে জাহাজে চাকুরী নিয়ে বিলেতে পাড়ি জমিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করেন। নানা রকম অত্যাচার, অসহ্য যন্ত্রনা সহ্য করে, তাদের টিকে থাকার করুণ এক দৃশ্য দেখা যায়, বইটিতে।
চতুর্থ অধ্যায়ে ব্রিকলেন সমন্ধে অজানা তথ্য পাঠকরা জানতে পারবেন। ব্রিকলেন অলিখিতভাবে বাংলা টাউন নামে খ্যাত। এই এলাকার আশে পাশে মাত্র চার বর্গমাইলের মতো জায়গা রয়েছে ৭০/৮০ হাজার বাংলাদেশীর বসবাস। এবং এই বাঙালিদের শতকরা ৯৫ ভাগই হলেন বৃহত্তর সিলেট থেকে আগত।
ব্রিকলেনের দুই বাঙালির একটা ঘটনা এখানে জানা যায়, ফারুক হোসেন ও জাহেদ হোসেন নামক দুই ভাই। ব্রিটিশ জাহাজে চাকুরীরত। ভাগ্য চক্রে দুজনিই লন্ডনে আসার সৌভাগ্য হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের দুই ভাইয়ের তখন দেখা হতো না। দীর্ঘ খোজাখুজির পর তারা ধারণা করেন, অন্যভাই মনে জাহাজ থেকে আসার সময় পথিমধ্যেই মারা যান।
ব্রিকলেনে এরকম অনেক বাঙালির জীবনের নানা ঘটনা জানাতে পারবেন বইটিতে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অজানা ইতিহাস বইটিতে পেলাম। তা হলো, ১৯৯৫ সালের ৩ রা মে, বৃটিশ টেলিভিশন চ্যানেল ফোর বাংলাদেশের যুদ্ধপরাধীদের উপর নির্মিত প্রামান্য চিত্র ‘ডেস পাচ’ প্রচারের পর বিলেতের সর্বত্র এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এটি একটি প্রামান্য দলিল।
প্রামান্য চিত্রটি যে তিন আলবদর, রাজাকার চৌধুরী মঈন উদ্দিন, আবু সাঈদ ও লুৎফুর রহমান এর উপর নির্মিত হয়েছে, তাদের তিনজনই বৃটিশ নাগরিকত্ব নিয়ে বিলেতে বাস করছে। এমনকি এখানে বিভিন্ন কমিউনিটির কাছে তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে ভূমিকা রেখে চলেছে। এই তিনজন মানুষের আরো গুরুত্বপূর্ণ অজানা কিছু তথ্য রয়েছে, বইটিতে।
বিলেতের ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের সুনামের পেছনের কারণগুলোর বিষদ ব্যাখা রয়েছে, বইটিতে। লেখক তার জীবনের সত্য ঘটনার মাধ্যমে বিলেতে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলোর বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছেন। জানা যায়, সেখানকার দীর্ঘদিনের প্রবাসী সাপ্তাহিক নতুন দিনের চেয়ারম্যান জনাব আলহাজ্ব তারা মিয়া খানের বাসায় দাওয়াত অতপর ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খাওয়ার ঘটনা।
পাঠকরা সবচেয়ে গুরুত্ব্পূর্ণ যে তথ্যটি বইটি থেকে জানতে পারবেন তা হলো, বিলেতে এই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলোর মালিক কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বেশিরভাগই সিলেটী। কেন তারা সিলেটী হয়েও ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে নামে ব্যবসা করছেন, তা জানতে হলে, বইটি পড়তে হবে।
লেখক আনোয়ার শাহজাহান আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরেছেন, বইটির সাত নম্বর অনুচ্ছেদে। পিটার শোর। সকল প্রবাসী বাঙালির প্রাণের মানুষ, আপনজন এই পিটার শোর। পিটার শোর ছিলেন বাঙালী অধ্যূষিত স্টেপনি ও বেথানাল গ্রীণ নির্বাচনী এলাকার সাবেক ও প্রবণী এমপি। এছাড়াও অনুচ্ছেদটিতে বিভিন্ন সময়ে জনপ্রিয় এমপিদের নানা তথ্য পাওয়া যায়।
বইটির আট নম্বর অনুচ্ছেদে জানা যায় বাংলাদেশী কমিউনিটিদের নানা কার্যক্রম সমন্ধে। দেশ ও দেশের ভাষাকে বুকে ধারণ করে, এই প্রবাসীরা কিভাবে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে পৃথিবীর মানচিত্রের বুকে, তার অদ্ভুদ বিশ্লেষণ পাওয়া যায়।
লেখক ১৯৯৫ সালের ১৬ জুলাই, মেরিলিবন বাংলাদেশ সোসাইটির উদ্যোগে নর্থ ওয়েস্টমিনিস্টার কমিউনিটি স্কুলে অনুষ্ঠিত ঈদ পূর্ণর্মিলনীর নানা তথ্য তুলে ধরেছেন। যা সত্যি মনোমুগ্ধকর।
যুগে যুগে সাদারা কালোদের কে কিভাবে ঘৃণিত চোখে দেখেছে, তার প্রমাণ মিলে, লেখকের জীবনের একটা বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে। যা লেখক তার নয় নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন। সে বছর ২২শে জুন শনিবার, কাউন্সিলার সায়ফুল আলম এর অনুরোধে লেখক সেখানেরর একটি সুইমিং পুলে যেয়ে মর্মাহত হোন। সেখানে ৭ থেকে ৮ বছরের একটি বাঙালি ছেলে, সুইমিং পুলের প্লাস্টিকের তৈরী একটি মাছের উপর উঠতে চাইলে, সাদারা তাকে পাকি বলে, গালি দেন, যা লেখককে গভীর ভাবনায় ফেলে দেন, ব্যথিত করেন। এই অনুচ্ছেদে সাদা আর কালো চমড়ার মানুষের ভিতর বেশ কিছু মর্মস্পশী ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়।
স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক গোলাম আযমের উপস্থিতি নিয়ে লন্ডনের বিক্ষোভ মিছিলে এগিয়ে আসা নানা বৃদ্ধ-তরুণদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, বইটির সর্বশেষ দশ অনুচ্ছেদে। প্রবাসে বসেও দেশের প্রতি ভালোবাসার টানে, স্বাধীনতা বিরোধীদের বিপক্ষে কিভাবে প্রবাসীরা ভূমিকা রেখেছেন, এবং রেখে চলেছেন, তা লেখক আনোয়ার শাহজাহান চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।
‘বিলেতের দিনগুলি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ বইয়ের ভুমিকায় প্রবাসী বিষয়ক লেখক ও গবেষক নুরুল ইসলাম আলোচ্য বইয়ের লেখক সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, তিনি বলেছেন ‘আনোয়ার শাহজাহান মাত্র ছয় মাস বিলেতে অবস্থানের পর সে দেশে তার অবস্থানের আলোকে যা লিখেছেন তাতে সত্যি তার অনুসন্ধিৎসু মন ও প্রখর সমাজবিজ্ঞান মূলক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। পাঠকরা হয়তো তার সাথে সকল বিষয়ে একমত হতে, নাও হতে পারেন। হয়ত কোন কোন বিষয়ে আমাদের বিলেতে প্রবাসী বাঙালিদের কেউ কেউ তার মতামতের উপর ক্ষুব্ধও হতে পারে। . . . . .। মানুষে মানুষে মত ও পথের চিন্তা ও চেতনার ভিন্নতার মাঝেই একতার সূর সন্নিবেশিত করাই লেখকের কৃতিত্ব। আনোয়ার শাহজাহান সে কাজটা করেছেন বলে আমি মনে করি’।
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে পাঠকরা অবশ্যই অনুধাবন করতে পারবে, বিলেতের দিনগুলি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ বইটির গুরুত্ব। লেখকের অসাধারণ এই বইটি সংগ্রহে রাখার মতো একটি বই। পূর্ব প্রজন্ম থেকে শুরু করে, নতুন প্রজন্মের কাছে, প্রবাসীদের জীবনযাত্রার ইতিহাস ও না বলা কথাগুলো তুলে ধরতে আনোয়ার শাহজাহানের দীর্ঘ পরিশ্রমের ফসল ‘‘বিলেতের দিনগুলি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’’ বইটি। তাই বিলম্ব না করে, আপনার বইয়ের সংগ্রহকে সমৃদ্ধি করতে আজই বইটি সংগ্রহ করুন।
।।
মিলন উদ্দিন লস্করঃ সাংবাদিক, লেখক ও সংগঠক।
শিলচর, আসাম, ভারত।