সহসা খুলছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কি হবে কওমি শিক্ষার ভবিষ্যৎ!
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:৪৩:০০,অপরাহ্ন ১৫ জুন ২০২০ | সংবাদটি ১৭৫৬ বার পঠিত
।। শেখ খালিদ সাইফুল্লাহ ।।
গত ১৭ মার্চ ২০২০ ইংরেজী থেকে প্রায় তিন মাস হচ্ছে, বাংলাদেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করোনা ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারী কারণে বন্ধ। এমন কি বন্ধ ছিল সকল অফিসিয়াল কার্যক্রমও। মহামারির প্রাদুর্ভাব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক সব নেজাম। তছনছ করেছে জীবন চলার প্রাত্যহিক রুটিন।’করোনা’য় সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। বিশেষ করে কওমীধারার শিক্ষা। স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার্থে শেষ পর্যন্ত স্থগিত করতে হয়েছে কওমী প্রতিষ্ঠান সমূহের ফাইনাল পরীক্ষা। যাহা ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা-পড়ায় উন্নতি ও অবনতির এক মানদণ্ড বটে ৷ জেনারেল বা সাধারণ লাইনের শিক্ষা ধারায় পাঠদান বন্ধ ছাড়া শ্রেণী পরীক্ষায় তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি বা হয়নি, তবুও যা হয়েছে তা যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর। এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার কিংবা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি সহ কর্তৃপক্ষ তৎপর। গ্রহণ করছে বহুবিধ পরিকল্পনা। কাজে লাগাচ্ছে প্রযুক্তি। সরকারের পক্ষ থেকেও টেলিভিশনে সংসদ টি,ভি চ্যানেল দ্বারা দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক মণ্ডলীর মাধ্যমে পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছে। উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব ব্যয়ে online এ লাইভের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণীর ক্লাশ করাচ্ছে। ক্বাওমী মাদরাসাগুলো এসবের কোনোটির সাথে সম্পর্ক যুক্ত নয়।
সরকারীভাবে না এর কোন ব্যবস্থা আছে,না প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ কিংবা বোর্ড কর্ণধারেরা এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আর কওমি মাদরাসার পরিচালকরা এর ব্যবস্থাই বা করবে কী করে যেথায় মাসের পর মাস শিক্ষকদের বেতন বাকী থাকে বা রয়েছে। পক্ষান্তরে আমাদের জেনারেল লাইনের পাঠদান প্রক্রিয়া কোনোনা কোনোভাবে চলছে, আর পরীক্ষার ব্যাপারে ক্ষতির শেষ ফলাফল হলো সেশনজট। সেটা হয়তো বড়জোর এক বছর লস;বা চাকরীর ক্ষেত্রে বয়স সিমা; যা সরকার চাইলে এক ডিক্রির মাধ্যমেই সমাধান করে দিতে পারবে। কওমীধারা এর ব্যতিক্রম। কারণ মাদরাসাগুলোতে পাঠদানের পাশাপাশি নৈতিকতারও শিক্ষা দেওয়া হয়।পাঠদান না হয় পরবর্তীতে হলো, কিন্তু নৈতিকতার শিক্ষা বা দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক প্রস্তুতির যে ক্ষতি হচ্ছে তা কস্মিনেও পুরণ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া কওমি শিক্ষাটা পুরোটাই দৈনন্দিন ক্লাস এবং তাকরার নির্ভর। এক্ষেত্রেও হোঁচট খেতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হেফজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা। যেখানে এক দুই দিনের গ্যপ থাকাটা তাঁদের জন্য কতই না ক্ষতিকর, সেখানে এই পরিস্থিতিতে তাদের কি দশা হবে? তাদের এ ক্ষতিপূরণ কী করে সম্ভব হবে! তেমনি ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে নুরানী, নাজেরার বিভাগের ছাত্রদেরও! বন্ধ কালীন অরা বড়ীতে বসে আর কি ইবা করবে। বাচ্চা ছেলেদের পিছনে অভিভাবকরা কতটুকু খাটুনি খাটতে পারবে তা সহজেই বোধগম্য। এরকম আরো অনেক ভয়ানক মেরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কওমি শিক্ষা।
উল্লেখ্য যে, মাদরাসার পাঠদান প্রক্রিয়া আরবি মাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ভর্তি সহ ক্লাস সেশন শুরু হয় আরবি শাওয়াল মাস থেকে এবং শেষ হয় রজব মাসে অতঃপর শাবান মাসে বার্ষিক পরীক্ষা ও বোর্ড পরীক্ষা ইত্যাদি। মাহে রমজান প্রশান্ত মনে ইবাদত বন্দেগীর জন্য, হাফেজ সাহেবান ও মাদরাসার আর্থিক উন্নতির দিক বিবেচনা করে বন্ধ রাখা হয়। এবার করোনার কারণে সবই ভেস্তে গেছে।বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোর কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়।কিন্তু সারা দেশ লকডাউনে থাকার কারণে বেশিরভাগ মানুষের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে, ফলে অনেকেই মাদরাসাগুলোর বেতন আদায় করতে পারছে না,পরিনামে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। এভাবে বন্ধ যদি আরো দীর্ঘমেয়াদি হয় তবে শহরের ছোট-ছোট মাদরাসাগুলো,যাদের নিজস্ব কোন ক্যাম্পাস নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন দিয়ে বাড়ি ভাড়ায় চালিত। তারা ভাড়া পরিশোধ করতে না পেরে এক সময় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হবে!
আর যে সকল মাদরাসাগুলো এলাকাবাসীর সাহায্য-সহযোগিতায় চলে তাদেরই বা কি অবস্থা? যখন মাদরাসা থাকবে বন্ধ,যেথায় থাকছে না ছাত্র-ছাত্রীদের কোন আনাগোনা, সারাটি বছর যেখানে কোরআনের সুমধুর তেলাওয়াত ও হাদীসে নববীর ‘ক্বালা ক্বালা , হা়দ্দাসানা’ ধ্বনি কওমী আঙ্গিনাকে মুখরিত করে তুলত এবং এলাকাবাসী তা শুনত আজ তা নিস্প্রাণ৷দেখার কেউ নেই৷ সুমধুর কন্ঠস্বর শুনবে ইবা কি করে? দ্বীন শিখার জন্য যেখানে পাঠাতে পারছে না নিজ সন্তানকে৷ সহযোগিতাইবা করবে কি ভাবে? আর ধনীরাই যখন বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত তখন আর মাদরাসায় সাহায্য করবেন কী করে?।
এমতাবস্থায় গত ১ জুন সরকারের কাছ থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কওমী মাদরাসাগুলো ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করার অনুমতি পেয়েছে।এতে ক্বাওমী অঙ্গনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসলেও স্বকীয়তার যথার্থ প্রতিফলন সম্ভব হচ্ছে না।মাদরাসাগুলোতে এলাকার ছাত্র-ছাত্রী যেমনি ভর্তি হয় তেমনি দূর-দূরান্তের অনেক ছাত্র-ছাত্রী সতস্ফুর্ত ভাবে মাদ্রাসায় আসে ভর্তি হওয়ার জন্য।কিন্তু ছাত্রাবাসে অবস্থান ও পাঠদান বন্ধ থাকার কারণে দূর-দূরান্তের ছাত্ররা আসছে না এবং প্রায় সকল মাদরাসাতে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার না থাকায় দূরে থেকে ভর্তিও হতে পারছে না।এহেন পরিস্থিতিতে দেশের প্রায় ২০ হাজার মাদ্রাসায় ২২-২৫ লাখের মতো শিক্ষার্থীর ভর্তি প্রক্রিয়া কতটুকু সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারবে, আল্লাহই ভালো জানেন।
যাইহোক,ভর্তি কার্যক্রম শুরু হলেও কবে মাদরাসা খুলবে এবং কবে পাঠদান শুরু হবে?এই নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা যাচ্ছে না। কবে মুখরিত হবে কওমি আঙিনাগুলো নবীন বরণে? কবে শুনা যাবে মাদরাসা প্রাঙ্গনে সুললিত কন্ঠে কোরআনের ধ্বনি? তার কোন হিসাব মিলানো যাচ্ছ না৷ তবে এতটুকু বলা যায়,সহসাই খুলছে না কওমি মাদরাসা সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সাধারণ লকডাউন খুলে দেয়ার পর থেকে যেভাবে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে,যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর বন্ধও আরো দীর্ঘমেয়াদী হয়।তবে কওমীর লক্ষ লক্ষ ছাত্রের কী হবে! কী হবে এদের ভবিষ্যৎ। সুশৃঙ্খল পরিবেশে আবদ্ধ রাখতে না পারলে,হয়তো অরা হারিয়ে যেতে পারে অন্য কোন বিপথগামী পরিবেশে।
তাই মাদরাসা কর্তৃপক্ষ সহ সংশ্লিষ্ট বোর্ড অধিপতিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি- প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অনলাইনে ভর্তি সহ যতটুকু সম্ভব পাঠদানের ব্যবস্থা করুন ৷ প্রয়োজনে সম্মিলিত ভাবে সকল বোর্ড মিলে যুগোপযোগী সিদ্ধান্তের ব্যবস্থা নেয়া যাইতে পারে। বোর্ড ও প্রতিষ্ঠান উভয়ের সমন্বয়ে এবং আর্থিক সহযোগিতায় যত শিঘ্রই সম্ভব নতুন কোনো ফর্মুলা তৈরি করতঃগত বছরের পরীক্ষাটাও কমপ্লিট করার ব্যবস্থা করুন।এজন্য মাদরাসা কখন খুলবে তার অপেক্ষা না করে এখনই এমন কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করুন যা ভবিষ্যতেও কাজে আসে,যুগ চাহিদার উন্নতির সাথে কর্মপদ্ধতিরও অগ্রগতি হওয়া চাই,না হয় নষ্ট হয়ে যাবে প্রচুর সময়! খোদা না করুক ছাত্রদের দশা হয়ে যাবে বেহাল৷ উস্তাদরা হতে পারেন ব্যক্তিগত ভাবে পরনির্ভরশীল৷ এতে সুনামও হারাতে পারে পুরো কওমী শিক্ষাধারার। সাথে সাথে বোর্ডগুলোরও সদয় দৃষ্টি থাকতে হবে নিবন্ধিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রতি,এদের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ানো,প্রয়োজনে সাহায্যের হাত প্রসারিত করা।এ ক্রান্তিকালে বিভিন্ন খাতে থাকা উদ্ধৃত টাকা;অন্ততপক্ষে পরীক্ষা না হওয়া শ্রেণী গুলির প্রদেয় ফিস রিটার্ন করে প্রতিষ্ঠান গুলিকে রক্ষা করা এবং ছাত্র-শিক্ষকের ব্যাপারে মানসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণে কর্তৃপক্ষকে যথাসাধ্য সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
সরকার বরাবরে আবেদন- মাদরাসাগুলো না খুলে দিলে আগামী এক বছরের জন্য কওমী মাদরাসার অনেক ক্ষতি যেতে পারে। তাই দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম ও বোর্ডগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে একটা বিহিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাতে করে প্রয়োজনীয় নিয়ম কানুন মেনে হলেও মাদরাসাগুলো তাদের ঐতিহ্যের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে৷যেখানে জনগণের কল্যাণে সারা দেশে লকডাউন তুলে দেয়া হয়েছে ৷ ব্যাংক, বীমা,অফিস আদালতে সর্বত্রই লোকে লোকারণ্য,স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রায় ৫০০ কারখানাও খোলা হয়েছে৷ সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে মাদরাসাগুলো খুলে দেওয়া যায় না? শান্তিপ্রিয় সুশৃঙ্খল এবং আনুগত্যশীল কাওমী শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে নতুন শিক্ষাবর্ষে কুরআন ও হাদীসের শিক্ষার আলো কওমী প্রাঙ্গণে জ্বালাতে পারে না!
ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি পরামর্শ- হেলায় সময় নষ্ট না করে,মাদরাসার নিজামুল আওকাতের মত করে বাসা-বাড়িতেও একটি নেজামুল আওকাত তথা দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করে নেয়া যায়। এবং সে অনুযায়ী নিয়মিত নতুন-পুরাতন দরসী কিতাব সমূহ মুতালায়া সহ দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করতে থাকি। রুটিনের বাহিরের সময় নফল ইবাদত-বন্দেগী,জিকির-আজকার, বিশেষ করে তাহাজ্জুদের নামাজের আমল করতে পারি। পিতা-মাতার খেদমত সহ পারিবারিক ও সামাজিক কার্যক্রমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই । এতেকরে একদিকে পাঠ গ্রহণের ভিত্তি আরো মজবুত হবে মাদরাসা খুলার পর নতুন সবক বুঝতেও অনেক সহজ হবে। এবং নেক আমলের বদৌলতে আল্লাহর রহম ও করমের দ্বারা হয়তো খুব শিঘ্রই এ মহামারী থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি।
পরিশেষে, সবাইকে অনুরোধ করেছি,জানি অপেক্ষা করা কতটা কঠিন কাজ, তবুও বলছি একটু ধৈর্য ধারণ করুন। সংকট তো আর সবসময় থাকে না।পরিস্থিতি অনুকুলে আসলে চলার পথ আবার আগের মতোই হবে। সবকিছু খুলে দেওয়ার পরও যেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর বন্ধ রাখার কোন যৌক্তিকতা থাকে না।সেহেতু আশাকরি স্বাস্থবিধি মেনে দ্রুততম সময়ে প্রতিষ্ঠান খোলারও সেই সিদ্ধান্ত আসবে, ইনশাআল্লাহ।
লেখক: শিক্ষক, ঢাকাদক্ষিণ দারুল উলুম হুসাইনিয়া মাদ্রাসা, গোলাপগঞ্জ, সিলেট।