ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্ত হবে দীর্ঘ মেয়াদী গোলযোগের সূচনা
প্রকাশিত হয়েছে : ১:৪৬:১৯,অপরাহ্ন ১৫ জুন ২০১৯ | সংবাদটি ৫৪৯ বার পঠিত
।। আফতাব চৌধুরী ।।
ব্রিটেনের দুই মহিলা প্রধানমন্ত্রীই ক্ষমতা ত্যাগ করতে গিয়ে অশ্রু ফেলে একাকার করলেন। দু’জনই আবার কনজারভেটিভ পার্টির। ব্রিটেনের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার পদত্যাগ করেছিলেন পার্টির অভ্যন্তরীণ সমস্যার জন্য, দলীয় এমপিরা তাকে চাচ্ছিল না। ‘লৌহমন্ত্রী’ বলে খেতাব পাওয়া থ্যাচারের কান্না দ্বিতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র থেকে পরিমাণে বেশিই ছিল। নানা কর্ম কান্ডের পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে-ও অশ্রুসিক্ত হয়ে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি ৭ জুন ২০১৯ পদত্যাগ করতে যাচ্চেন। অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে সরে দাঁড়ালেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরাসা মে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, শক্রুবার (৭ জুন) সকালে এক বিবৃতিতে দলীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করে সংবাদ সংস্থা জানায়, নতুন দলীয় প্রধান নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত থেরাসা মে‘ই অর্ন্তবর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। একই সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন অর্ন্তবতীকালীন দলীয় প্রধান হিসেবেও। ১৩ থেকে ২০ জুন কয়েকটি ধাপে ওই নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর আগামী ২২ জুলাই কনজারভেটিভ পার্টির নতুন নাম ঘোষণা করা হবে। এর আগে, গেল মাসে ব্রেক্সিট ইস্যুতে ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। ব্রেক্সিট অর্থাৎ ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগের ব্যাপারে তার নতুন পরিকল্পনা মন্ত্রিসভায় ও পার্লামেন্ট অনুমোদিত হবে না এটা স্পষ্ট হওয়ায় পরই তার পদত্যাগের ঘোষণা এসেছে।
লন্ডনে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের সামনে এক আবেগপূর্ণ বিবৃতিতে বিদায়ের কথা ঘোষণা করতে গিয়ে মে’র গলা ভেঙ্গে আসে, চোখ পানিতে ভরে ওঠে। তবে কনজারভেটিভ পার্টি একজন নতুন নেতা নির্বাচিত না করা পর্যন্ত তিনি অন্তর্বতীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ব্রিটেনের বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগকে ‘সঠিক সিদ্বান্ত’ বলে মন্তব্য করেছেন।
এখন রক্ষণশীল দলের ব্রেক্সিটের পক্ষের সিনিয়র মন্ত্রীরা অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর পদটি লাভের আশায় প্রতিযোগিতার মাঠে আছেন। তারা সবাই বর্তমান বা প্রাক্তন মন্ত্রী ছিলেন বা আছেন। অনেকে আশা করেছিলেন যে তারা চুক্তি ছাড়াই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করবেন। কিন্তু পার্লামেন্টের স্পিকার জন বার্কো গত ২৮ মে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটে দেওয়া এক বক্তৃতায় বলেছেন, চুক্তি ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের বিষয়টি কার্যকর করতে গেলেও পার্লামেন্টর অনুমোদন লাগবে। প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন, প্রাক্তন ব্রেক্সিট মন্ত্রী ডমিনিক রাবের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে স্পিকার এ কথা বলেছেন। এমন পরিস্থিতিতে সম্ভবত ব্রেক্সিট বিষয়টি আরও জটিল হলো।
২০১৬ সালে গণভোটে ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষ জিতে গেলে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগ করেছিলেন। কারণ,তিনি ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে ছিলেন না। ক্যামেরন পদত্যাগের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে থাকা তার মন্ত্রিসভার সদস্য থেরেসা মে তখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ২০১৬ সাল থেকে থেরেসা মে ইউনিয়ন ত্যাগের আগে পরের সব বিষয় নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটা চুক্তি করতে ইউনিয়নের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটি খসড়া তৈরি করেছিলেন, যাতে ইউনিয়নের সম্মতিও ছিল। পরবর্তী সময়ে থেরেসা মে খসড়ার চুক্তিটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পেশ করেছিলেন কিন্তু তার দুর্ভাগ্য যে তিনি পার্লামেন্ট সদস্যদের বিভিন্ন অভিযোগ মিটিয়ে বারবার পার্লামেন্টে পেশ করার পরও চুক্তির খসড়াটি পাস করাতে পারেননি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে স্পিকার জন বার্কোর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্পিকার বার্কো খুবই কঠিন প্রকৃতির লোক। পান থেকে চুন খসা সম্ভব নয়। তিনি কোনও আইনগত খুঁত অবহেলার চোখে দখেন না। এর আগে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র ব্রেক্সিট চুক্তি দুই দফা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর সেটি নিয়ে পুনরায় ভোটাভুটি করতে চাইলে তাতে নজিরবিহীনভাবে স্পিকার বার্কো রুলিং দিয়ে বলেছিলেন যে,একই বিল কোনও সংশোধনী ছাড়া তৃতীয় বার ভোটাভুটিতে দেওয়া যাবে না। ব্রেক্সিট প্রশ্নে বিভক্ত এবং সরকারের একক সংখ্যাগরিষ্টতা না থাকা পার্লামেন্টে স্পিকারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্পিকার ঠিক করে দেন পার্লামেন্ট সদস্যদের উথাপিত কোন কোন প্রস্তাবে বিতর্ক ও ভোটাভুটি হবে। ব্রিটেনের রানি কখনও কোনও রাজনৈতিক বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন না। এক অনুষ্ঠানে তিনিও আহ্বান জানিয়েছেন বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে উভয় পক্ষকে একটা সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য।
থেরেসা মে’র স্থলাভিত্তিক কে হচ্ছেন, তা এখনও সুস্পষ্ট নয়। তবে চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিট কার্যকর করার যে পরিকল্পনা সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীরা করেছেন,তা হবে রক্ষণশীল দলের জন্য আত্মহননের মতো কাজ। কারণ, চুক্তি ছাড়া ইউনিয়ন ত্যাগ করলে পরবর্তী সময়ে বহু সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে, যার কারণে ব্রিটিশের অর্থনৈতিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ব্রিটেন তাদের এক ঘরে স্বভাবের জন্য ইউরোপীয়দের কাছে কখনও সমাদর পায়নি। ব্রিটেন তার উপনিবেশগুলোর সঙ্গেই সুখ দুঃখে ছিল। কখনও ইউরোপে বিচরণ করার চেষ্টা করেননি। এমনকি জিব্রালটর ছাড়া তার কোনও জায়গাও নেই ইউরোপে। নেপোলিয়ন একবার ইউরোপের ভাগ্য বিধাতা হতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার হিটলার সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন কিন্তু ব্রিটেন কখনও এমন কোন আশঙ্কা প্রকাশ করেনি। তবে ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, ইউরোপের দেশগুলো বিবাদে লিপ্ত থেকেছে দীর্ঘ সময় ব্যাপী। একমাত্র ইউরোপ মহাদেশেই অসংখ্য রাষ্ট্রের উথান হয়েছে আবার বিলুপ্ত হয়েছে।
১৬ শতকে তারা পরস্পরের সঙ্গে ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধও করেছে। ব্রিটেন ছিল তার থেকে দূরে। যুদ্ধে যুদ্ধে ইউরোপের এক চর্তর্থাংশ লোক বিলীন হয়ে যাওয়ার পর ১৬৪৮ সালে ৩০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে পরস্পর আলোচনা করে এক সুদূরপ্রসারী ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেছিল। চুক্তিটির নাম ছিল ‘পিস অব ওয়েস্টফেলিয়া’। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন যদিওবা বাস্তব রুপ ত্যাগ করেছে বিশ শতকে কিন্তু তার বীজ নিহিত ছিল ওই চুক্তিটিতে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন আমেরিকা এবং সোভিয়েত রাশিয়া বিশ্বের দুই পরাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন ব্রিটেন,ফ্রান্স,চীন দ্বিতীয় পর্যায়ের শক্তিতে পরিণত হয়।
ইউরোপে আমেরিকার মিত্রদের নিরাপত্তার জন্য ন্যাটো গঠন করেছিল আমেরিকা। তারা আশঙ্কা করেছিল যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। ন্যাটোর পরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্ভব হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। সবার উন্নতি, সবার নিরাপত্তা। এটা অনেকটা ‘সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর ফেডারেশন’-এর মতো। সম্মিলিত কারেন্সি ‘ইউরো’ তারা ছেড়েছে। এখন ডলারের প্রতিদ্ব›দ্বী ইউরো হয়তো কিছুদিনের মাঝে সম্মিলিত সামরিক বাহিনীও সৃষ্টি হতো।
ব্রিটেন তার শৌর্যবীর্য হারানোর পর ইউরোপের এ সম্মিলিত প্রয়াসের সঙ্গে শরিক থাকা উচিত ছিল কিন্তু ব্রিটেনের লোক ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের সঙ্গে থাকছে না। ২০১৬ সালে গণভোটে তারা ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছে। প্রক্রিয়ায় কারণে হয়তোবা কিছু সময় বিলম্ব হবে। তবে চূড়ান্তভাবে তারা ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাবে। ব্রিটেন গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় দেওয়ার তিন বছর পরও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বলে গত ২৩ মে বাধ্য হয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে অংশ নিতে হয়েছে। এই নির্বাচনে ব্রিটেনে একক দল হিসাবে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে নাইজেল ফারাজের ব্রেক্সিট পার্টি। মোট প্রদত্ত ভোটের ৩১ শতাংশ পেয়েছে তার দল। আর শুনে আশ্চর্য হওয়ার কথা যে, এই পার্টির বয়স ছিল মাত্র ৬ সপ্তাহ।
নাইজেল ফারাজ ব্রিটিশ রাজনীতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিরোধী কট্টর নেতা হিসাবে পরিচিত। এর আগে তিনি ছিলেন ইউকে ইনডিপেন্ডেন্ট পার্টি বা ইউকিপের নেতা। এই দলটি বহু বছর ধরে ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনার জন্য আন্দোলন করেছে।
উল্লেখ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য ২৮ দেশের জন্য আইন তৈরি করে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। প্রত্যেকটি সদস্য দেশ জনসংখ্যার অনুপাতে এই পার্লামেন্টে ৭৫১ সদস্য পাঠায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ব্রিটেন ইউরোপে আমেরিকার উপগ্রহ হিসাবে বিরাজ করতো। হয়তো তারা এমন ভূমিকায় আবারও অবতীর্ণ হবে। তার লক্ষণ আমেরিকাও জানিয়ে দিচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তিন দিনের জন্য ৩ জুন থেকে ব্রিটেন সফরের আগে-পরে তার কর্তৃত্ববাদী আচরণ জানিয়ে দিচ্ছেন। এমনকি ব্রিটেনের আগামী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন,লন্ডনের মেয়র কী কাজে করছেন এসব অভ্যন্তরীণ বিষয়েও নাক গলানোর অভিযোগ উঠেছে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। অবশ্য আগেরবারের মতো তার এবারের সফর নিয়েও ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে।
যা হোক, ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলে তার অস্তিত্বেও আঘাত আসতে পারে। স্কটল্যান্ড আর উত্তর আয়ারল্যান্ড বলছে তারা ইউনিয়নের সঙ্গে থাকবে। সেটা যদি হয়,ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর ব্রিটেনের সঙ্গে না থাকার কর্মকান্ড শুরু করবে স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড। আর এমন কিছু হলে ব্রিটেন তার স্বরূপে ফিরে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট