আমের নামে আমরা ‘বিষ’ খাচ্ছি
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:০৩:১০,অপরাহ্ন ৩১ মে ২০১৯ | সংবাদটি ২৯৫৩ বার পঠিত
আমের মৌসুম পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগেই রাজধানীসহ সারাদেশের বাজারে উঠতে শুরু করে বিভিন্ন জাতের আম। আমগুলো দেখতেও বেশ ঝকঝকে এবং সুন্দর। এখন ইফতারেও এ আম যুক্ত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব আম কি সত্যিকার অর্থেই পাকা? এগুলো কি খাওয়ার উপযোগী? কারণ এসব আম কিনে বাড়িতে নিয়ে কেটে দেখা যায় ভেতরের আঁটিই শক্ত হয়নি, আঙ্গুলে চাপ দিলেই ভেঙ্গে যায়। আম কেটে কিছু সময় রাখার পর আপনা আপনি কালো হয়ে যায়। খেতেও আমের মতো লাগে না, মিষ্টি লাগা দূরের কথা বিশ্রী স্বাদে মুখ বিস্বাদ হয়ে যায়। এ আম খাওয়ার পর অনেকের পেটেও সমস্যা দেখা দেয়। গত কয়েক দিনে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় এই ঝকঝকে পাকা আমের আসল রহস্য। পরিপক্ব হওয়ার আগেই আমগুলো পেড়ে আনা হয়েছে বাগান থেকে। তারপর বিষাক্ত ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়েছে রোজার মধ্যে অতিলাভে বিক্রির উদ্দেশ্যে। সেই আমেই রাজধানীসহ সারাদেশের বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। বিষয়টি নজরে আসার পর র্যাব, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণ কেমিক্যালযুক্ত আম জব্দ করে ধ্বংস করেছেন।
রাসায়নিক দিয়ে পাকানো এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর আম বিক্রি প্রতিরোধ করতে না পারায় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ট এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন-বিএসটিআই এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছেন উচ্চ আদালত। কারণ, এর আগে গত ৯ এপ্রিল আদালত এক নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, বাগান থেকে অপরিপক্ব আম পেড়ে রাসায়নিক দিয়ে যাতে পাকানো না হয় এবং তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনে যেন আম বাগানগুলোতে পুলিশ নিয়োগ করা হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের সেই আদেশ বাস্তবায়নের কোনো আলামত ফলের বাজারে দেখা যাচ্ছে না, বরং রাজধানীসহ সারাদেশের ফলের বাজার ছেয়ে গেছে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কেমিক্যালযুক্ত আমে।
একটি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিএসটিআই-এর একজন অতিরিক্ত পরিচালক ১৫টি পাইকারী ফলের বাজার পরিদর্শন করে কোথাও ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে আম পাকানো হয়েছে মর্মে কোনো প্রমাণ পাননি। কিন্তু ফলের স্বাদ নিয়ে তাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এটা হয়েছে ফরমালিনের জন্য। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ থেকে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে আম পাকানোর বিষয়টি অস্বীকার করে বলা হয়েছে, আমাদের ফল শিল্পের ক্ষতি করার জন্যই কার্বাইড দিয়ে ফল পাকানো এবং ফরমালিন দিয়ে সংরক্ষণের বিষয়টি প্রচার করা হচ্ছে। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, যেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও বিশেষজ্ঞরা বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো আম জব্দ করে ধ্বংস করছে, সেখানে বিএসটিআই ও নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর একে ষড়যন্ত্র বলছে। তারা কি জানে না, আমের মৌসুম এখনো শুরু হয়নি? তার আগে এসব আম এলো কোথা থেকে? কেমিক্যালযুক্ত বিষাক্ত আমের পক্ষে তাদের এই সাফাই গাওয়া কি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি নয়? অথচ, ২০১৮ সালের বুয়েটের এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বিক্রেতারা কৃত্রিমভাবে ফল পাকানোর জন্য ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথোফেন, কেরোসিন, ইথিলিন গ্লাইকল ব্যবহার করে থাকেন। আর এসব কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো ফল খেলে বদহজম, স্থায়ী চর্মরোগ, ডায়রিয়া, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এমনকি ফুসফুস অকার্যকর হওয়ার মতো ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে।
বিভিন্ন জাতের আম কেনার ক্ষেত্রে সরকারি কর্তৃপক্ষের সময়সীমা বেঁধে দেয়া আছে। যেমন গত ১২ মে রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জাত ভেদে আম বাজারজাত করার তারিখ ঠিক করে দেওয়া হয়। প্রথম দফায় ১৫ মে থেকে গুটি আম নামানোর সিদ্ধান্ত হয় ওই বৈঠকে। এর পর পর্যায়ক্রমে ২০ মে থেকে গোপালভোগ, ২৫ মে থেকে রানিপাসান্দ ও লণভোগ, ক্ষীরশাপাত বা হিমসাগর ২৮ মে থেকে, ল্যাংড়া ৬ জুন, আম্রপালি, ফজলি ও সুরমা ফজলি ১৬ জুন থেকে ও আশ্বিনা আম ১ জুলাই থেকে বাজারজাত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের আগেই কোনো জাতের আম কেনা থেকে যেকোনো ভোক্তাকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেও আম কেনার ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকা দরকার। কেননা, তখনও বাজারে ক্যালসিয়াম কার্বাইডযুক্ত, এমনকি ফরমালিন মেশানো আম থাকতে পারে। এসব কেমিক্যাল মিশ্রিত ফল খেলে মানুষ দীর্ঘমেয়াদি নানা রকম জটিল রোগ যেমন- বদহজম, পেটেরপীড়া, পাতলা পায়খানা, জন্ডিস, গ্যাস্ট্রিক, শ্বাসকষ্ট, অ্যাঁজমা, লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়াসহ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া মহিলারা এর বিষক্রিয়ায় বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিতে পারে। তাই কেমিক্যালযুক্ত আম বা ফল কেনা থেকে আমাদের সাবধান হতে হবে। আম বা অন্যান্য মোসুমী ফল কেনার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও মেনে চলতে হবে।
আমাদের শরীরের সুষম পুষ্টির যোগানের জন্য আমসহ বিভিন্ন মৌসুমী ফল খাওয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু কতিপয় মানুষের লোভের কারণেই সেই ফল বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। একেকটি আম বিষের গোল্লায় পরিণত হচ্ছে। তাছাড়া মাঠপর্যায়ে চাষি বা কৃষকদের অসচেতনতার কারণেও ফলে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত বিষ। এই বিষযুক্ত ফল খেয়ে একদিকে আমরা নিজেরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছি, অন্যদিকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তথা শিশুরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম অসুস্থতা চলতেই থাকবে। বলা বাহুল্য, অসুস্থ প্রজন্ম নিয়ে দেশ ও জাতি কখনো এগুতে পারে না। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ট এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন-বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। জনগণকেও এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে।