জাপানী কোম্পানী ও আমাদের দুর্ণীতি
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:১৯:১০,অপরাহ্ন ২২ মে ২০১৯ | সংবাদটি ২৭৬৯ বার পঠিত
মহাসড়ক ও সেতু নির্মান খাতে বাংলাদেশে অতিরিক্ত ব্যয় সাম্প্রতিক সময়ে একটি আলোচ্য বিষয়। বিশ্বব্যাংকের একটি রিপোর্টেও বাংলাদেশে চারলেন বিশিষ্ট মহাসড়ক ও সেতু নির্মান ব্যয় প্রতিবেশী দেশ ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০গুন বেশী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ বা নকশা জটিলতার কারণ দেখিয়ে সময়মত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারায় কাচামালের মূল্যবৃদ্ধিসহ আনুসাঙ্গিক ব্যয়বৃদ্ধিসহ নানাবিধ কারণ দেখিয়ে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়। এ প্রক্রিয়ায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ণের সময় প্রলম্বিত হওয়ার কারণে একদিকে জনভোগান্তি দীর্ঘায়িত হয় অন্যদিকে প্রকল্পের ব্যয়বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সরকারী অর্থের মাত্রাহীন অপচয়-লুটপাট হয়ে থাকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প, পদ্মাসেতুসহ সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু মেগাপ্রকল্পের এমন ব্যয়বৃদ্ধি ও সময়বৃদ্ধির উদাহরণ রয়েছে। তবে এর বিপরীতচিত্রও যে ঘটতে পারে তা দেখিয়ে দিয়েছে জাপানীরা। ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৩ টি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ও সংযোগ সড়কের নির্মান ব্যয় এবং বাস্তবায়ন সময়ের আগেই কাজ শেষ করে এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে ৩টি জাপানী কোম্পানী।
প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ৪০০মিটার দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু এবং ৮ লেন বিশিষ্ট ৭০০মিটার এপ্রোচ সড়ক, ৯৩০ মিটার মেঘনা সেতু(২য়) এবং ৬ লেনের ৮৭০মিটার এপ্রোচ সড়ক এবং ৬ লেনের ১০১০মিটার এপ্রোচ সড়কসহ ১৪১০ মিটার দীর্ঘ গোমতি(২য়) সেতুর প্রাক্কলিত নির্মান ব্যয় ছিল ৮৪৮৬ কোটি টাকা। তিনটি প্রকল্পের কাজ পেয়েছিল যথাক্রমে ওবায়শি করপোরেশন, সিমিজু করপোরেশন এবং জেএফই ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন। যেখানে বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়নে অহেতুক সময়ক্ষেপণ এবং প্রকল্পের ব্যয়বৃদ্ধি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে পরিগণিত হয়েছে, সেখানে সবাইকে অবাক করে দিয়ে জাপানী কোম্পানী ৩টি প্রকল্পের কাজই নির্ধারিত সময়ের ৭ মাস আগে শেষ করে হস্তান্তর করতে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৮৪৮৬ কোটি টাকা হিসাবে চুক্তিবদ্ধ হলেও ৭৭৪৮কোটি টাকায় কাজ শেষ করে বাড়তি ৭৩৮কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারকে ফেরত দিয়ে আমাদের জন্য একই সঙ্গে কর্মদক্ষতা ও সততার বিরল নজির সৃষ্টি করল জাপানের ৩টি কোম্পানী। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে এই প্রকল্পগুলোর নির্মান কাজ শুরুর পর ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলায় বেশ কয়েকজন জাপানী নাগরিক নিহত হন। সে সময় জাপানী প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকার কারণে এই কোম্পানীগুলো কাজ বাস্তবায়নের সময়সীমা আরো ৬ মাস বাড়িয়ে দেয়ার আবেদন করেছিল। তবে পূর্ব নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করে দৃষ্টান্ত তৈরী করল জাপানী প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যয়বৃদ্ধি ও দুর্নীতির অভিসন্ধি না থাকার কারণেই হয়তো এটা সম্ভব হয়েছে। এ থেকে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষনীয় আছে।
নির্মানাধীন রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের জন্য গ্রিনসিটি আবাসিক ভবনের আসবাবপত্র ও গৃহসামগ্রী ক্রয়ে মাত্রাহীন দুর্নীতি-লুটপাটের তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ইতিমধ্যে একাধিক তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। ইতিপূর্বে ফ্লাইওভারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মানে দেশি-বিদেশি কোম্পানীর ভুল নকশা, নানা অজুহাতে বাস্তবায়নের সময় ও নির্মানব্যয় বৃদ্ধির খবর আমরা জানি। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতিমূলক অভিসন্ধির কারণেই এ ধরনের কালক্ষেপণ ও ব্যয়বৃদ্ধির ঘটনা ঘটে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। মুক্তবাজার অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় মুনাফাই যেখানে কর্পোরেট কোম্পানীগুলোর মূল লক্ষ্য সেখানে জাপানী কোম্পানীগুলো প্রাক্কলিত ব্যয় থেকে ৭ শতাধিক কোটি ফেরত দিয়ে এবং নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৭ মাস আগেই সফলভাবে কাজ শেষ করার যে নজির সৃষ্টি করেছে, তা দেশি-বিদেশী অন্যান্য কোম্পানীর জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। জাপান আমাদের অন্যতম উন্নয়ন অংশিদার। আমাদের সামগ্রিক অগ্রগতিতে জাপানের সরকার তথা জনগনের বিশেষ অবদান রয়েছে। উন্নত সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, অসাধারণ কর্মদক্ষতার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই দেশের প্রধান মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ ৩টি সেতুর নির্মানকাজের সফল সমাপ্তি আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। সেই সাথে প্রাক্কলিত ব্যয় থেকে ৭শ কোটি টাকার বেশি ফেরত দেয়ার মধ্য দিয়ে জাপানীরা তাদের দক্ষতা ও সততার ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যই প্রমাণ করেছে। এই কৃতিত্বের জন্য আমরা তাদেরকে অভিনন্দন জানাই।