ঝুঁকিপূর্ণ পথে বিদেশ গমন বন্ধ করতে হবে
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:১৮:০৭,অপরাহ্ন ১৫ মে ২০১৯ | সংবাদটি ১৯৭৮ বার পঠিত
আফ্রিকার দেশ লিবিয়া থেকে থেকে সমুদ্রপথে ইতালী যাওয়ার সময় নৌকাডুবিতে অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। এসব অবৈধ অভিবাসির বেশীরভাগই বাংলাদেশী বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে অন্তত ৩৭জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। আরো অন্তত ১৫জনকে জীবিত উদ্ধার করেছে সমুদ্রে মাছধরা জেলেরা। লিবিয়া থেকে ইতালী যাওয়ার পথে সমুদ্রে ডুবে যাওয়া মানুষদের বেশীরভাগ বাংলাদেশের নাগরিক, এমনটা ভাবা যায় না। একশ্রেণীর আদম বেপারী ও মানব পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে দেশের একশ্রেনীর তরুন এভাবেই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। ইতালী গিয়ে উন্নত কর্মসংস্থান প্রত্যাশি এসব ভাগ্যাহত তরুণদের প্রথমে নাকি ভারতে নেয়া হয়েছিল। সেখান থেকে শ্রীলঙ্কা অথবা দুবাই হয়ে লিবিয়া নেয়া হয়। লিবিয়া থেকে ভ’মধ্যসাগর পার হলেই ইতালী। সেখান ইউরো-ডলারে উচ্চ বেতনে কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখিয়ে জনপ্রতি ৯ লাখ টাকা করে নিয়ে তাদেরকে এই বিপদসঙ্কুল পথে নামিয়েছিল মানব পাচারকারী চক্রের দালালরা। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের বর্ননা থেকে এসব তথ্য জানা যায়। অপেক্ষাকৃত বড় বোট থেকে প্লাস্টিকের ছোট নৌকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশী মানুষকে তুলে দেয়ার ১০ মিনিটের মধ্যেই সামুদ্রিক ঢেউয়ে নৌকাটি ডুবে যায়। জেলেদের নজরে আসার আগেই অর্ধশতাধিক মানুষ সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যায়। জেলে নৌকার নজরে না পড়লে হয়তো এসব অভিবাসন প্রত্যাশিদের কেউই জীবিত ফিরতে পারত না। হয়তো তাদের নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে কারো কোনো ধারণাই থাকতো না। ইউএনএইচসিআর এবং গণমাধ্যমের নজরের বাইরে এভাবেই অসংখ্য মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন।
বৈধ-অবৈধ অভিবাসন এবং মানব পাচারের মত ঘটনা বিশ্বে কোনো নতুন সমস্যা নয়। নিরাপদে বেঁচে থাকার তাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার যুদ্ধপীড়িত দেশগুলো থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ ইউরোপের দেশগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে। এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। তবে এসব যুদ্ধপীড়িত দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি বাংলাদেশীরাও কেন অবৈধ পথে অভিবাসন প্রত্যাশি হিসেবে ব্যাপক হারে দেখা যাচ্ছে। এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। নানা ক্ষেত্রে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সরকার আন্তর্জাতিকভাবে দেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবী করছে। কিন্তু বিনিয়োগে দীর্ঘমেয়াদী মন্দা, মানুষের আয়বৈষম্য এবং ব্যাপক হারে মানুষের দেশত্যাগের প্রবণতা থেকে এটাই প্রমানীত হয় যে দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থান ও নিরাপত্তা না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়ছে মানুষ। আন্তজার্তিক অভিবাসন সংস্থার জরিপে অবৈধ অভিবাসনের বিশ্ব র্যাংকিংয়ে তালিকার ৮ নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের রোল মডেলের দাবীদার কোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি বড় ধরনের নেতিবাচক চিত্র। সরকার একদিকে মানব পাচারের রুটগুলো বন্ধ করতে পারছে না। অন্যদিকে দেশে উন্নত কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে তা অস্বীকার করা যাবে না। মূলত: বৈধ-অবৈধ অভিবাসি বা বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্সের উপর ভর করেই দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রয়েছে। তবে মানব পাচার ও অবৈধ অভিবাসনের কারণে আমাদের শ্রমশক্তি রফতানীর সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা এবং ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে নানা ক্যাটাগরিতে অভিবাসনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে রেমিটেন্স আয় বাড়ানো আর মানব পাচার অব্যাহত রাখা এক কথা নয়। সউদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ার মত বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোতে আমাদের শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সঙ্কোচিত হওয়ার জন্য অবৈধ ইমিগ্রেশন এবং মানব পাচারকারীচক্রের বেপরোয়া তৎপরতাই মূলত দায়ী। বিদেশে কর্মরত শ্রমিকরা দেশের অ্যাম্বাসেডরের ভ’মিকা পালন করতে পারেন। সরকারের পক্ষ থেকে এটাই প্রত্যাশিত। তবে অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে, বিপদসঙ্কুল পথে বিদেশ গমনের কারণে বাংলাদেশের মান মর্যাদা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্বের দেশে শত শত অবৈধ বাংলাদেশী শ্রমিকদের অবস্থান, যুদ্ধকবলিত দেশগুলো থেকে সমুদ্রপথে ইউরোপে পাড়ি জমানো অভিবাসিদের মধ্যে ব্যাপক হারে বাংলাদেশীদের অবস্থান দেশের ইমেজ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। তিউনিসিয়ার উপকুলে নৌকাডুবে ৩৭জন বাংলাদেশী নিহত হওয়ার পর আবারো কথিত আদম বেপারী ও দালালচক্রের নানা কাহিনী উঠে আসছে। তবে এসব আদম বেপারী ও দালালচক্রের হাতে লাখ লাখ টাকা তুলে দিয়ে এমন বিপদ জেনেও কেন শত শত যুবক বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে তার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রাখতে হবে। শুধুমাত্র মানবপাচারকারী ও আদম বেপারীরাই এর জন্য দায়ী নয়। ঝুঁকিপূর্ণ পথে বিদেশ গমনের সামাজিক-রাজনৈতিক কারণ সমুহ দূর করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়া এ থেকে উত্তরণের কোনো বিকল্প পথ নেই।