গ্রন্থালোচনা : শায়খ মুহাম্মদ আবুল হোসাইন খান রচিত কুরআনে বাংলা শব্দের সমাহার
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:৩৫:১৯,অপরাহ্ন ২১ জুন ২০২১ | সংবাদটি ৭২১ বার পঠিত
বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল:
একটি মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আল্লাহ তায়া’লা মানবজাতিকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। মানুষের জন্য এটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ নেয়ামত এবং করুণা। আল্লাহ তায়া’লার উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন তথা মানবজাতির যাপিত জীবনের মূল লক্ষ্যই হলো আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করা। আল্লাহর খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করার মধ্যেই মানুষের মুক্তির তাৎপর্য নিহিত। মানবজাতি যাতে সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে পারে, এক আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে উভয় জাহানে শান্তি ও মুক্তির আশ্রয় খোঁজে নিতে পারে সেজন্যই তাঁর প্রেরিত আল-কুরআন বিশ্বমানবতার জন্য নির্দিষ্ট জীবনবিধান। এই কুরআনকে আল্লাহ তায়া’লা বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করিয়ে একটি অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। এই কুরআন একটি পথনির্দেশিকা মানবজাতির সামনে উপস্থাপন করে। ব্যক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাই এই কুরআনকে যারা সঠিকভাবে অনুসরণ করে, তারাই আল্লাহর কাছে সত্যিকার মুসলিম বলে গৃহীত। আল কুরআনুল কারিমকে অনুসরণ ছাড়া মুসলিমের মৌলিক পরিচয় অবশিষ্ট থাকে না। মৌলিক পরিচয়ে ভাটা পড়লেই জাতি তাঁর স্বকীয়তা হারায়। অস্তিত্ব বিলীন করে দিয়ে জাতির ভাগ্যে নেমে আসে অমানিশার কালো থাবা। এই অমানিশার কালো থাবা থেকে বাঁচতে হলে এই কুরআনকেই একমাত্র জীবনবিধান হিসেবেই গ্রহণ করতে হবে। এর বিকল্প কোনো রাস্তা মানবজাতির জন্য কল্যাণকর নয়। আল কুরআনুল কারিমকে প্রতিটি ক্ষেত্রে জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করতে হলে এটাকে বুঝা এবং উপলব্ধির কোনো বিকল্প নেই। এটাই মূলত কুরআনকে গ্রহণ করার পূর্বশর্ত। যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ও দাঈ শায়খ মুহাম্মদ আবুল হোসাইন খান কর্তৃক প্রণিত ‘কুরআনে বাংলা শব্দের সমাহার : কয়েক মাসেই শিখে ফেলুন’ গ্রন্থটি এই কুরআনকে বুঝার এবং বুঝাবার জন্য এক অনবদ্য ও সার্থক প্রয়াস।
যুক্তরাজ্যে যেসব ব্যক্তি একনিষ্ঠ ও নিরলসভাবে দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে কাজ করছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন-ইস্ট লন্ডন মসজিদের ইমাম ও খতিব শায়খ মুহাম্মদ আবুল হোসাইন খান। এছাড়াও আরো কয়েকজন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ও দাঈ দ্বীনের কাজ করছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন-শায়খ হাফিজ মাওলানা আবু সাঈদ, শায়খ এইচ এম শফিকুর রহমান আল মাদানী, শায়খ আব্দুল কাইয়ুম, শায়খ মওদুদ আহমদ, কলামিস্ট ও সাংবাদিক ফরিদ আহমেদ রেজা, শায়খ মাওলানা আব্দুল কাদির সালেহ ও শায়খ আবুল হাসনাত চৌধুরী প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে শায়খ এইচ এম শফিকুর রহমান আল মাদানী অনূদিত ‘আল কুরআনুল কারিমের সহজ তরজমা’ গ্রন্থ পাণ্ডুলিপি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। যা ইতোমধ্যে দেশ ও বিদেশে অভ‚তপূর্ব সাড়া জাগিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইস্ট লন্ডন মসজিদের ইমাম ও খতিব শায়খ মুহাম্মদ আবুল হোসাইন খান-এর ‘কুরআনে বাংলা শব্দের সমাহার : কয়েক মাসেই শিখে ফেলুন’ গ্রন্থটি কুরআন প্রেমিকদের জন্য সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে গৃহীত হবে বলে আমার বিশ্বাস। গ্রন্থে উল্লেখিত শব্দগুলো আয়ত্ত করলে সহজেই কুরআনকে উপলব্ধি করা সহজ হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
শায়খ হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হোসাইন খান একাধারে ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক, গবেষক ও সংগঠক। ইস্ট লন্ডন মসজিদের ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন ছাড়াও তিনি লন্ডন মুসলিম সেন্টারে একই দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও যুক্তরাজ্য তথা লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে ইসলামী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি অভিভাবক ও উপদেষ্টা হিসেবে ভ‚মিকা রাখছেন। একজন প্রাজ্ঞ আলেমে দ্বীন হিসেবে তিনি বিভিন্ন টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সামাজিক কর্মকাণ্ড, সাম্প্রতিক ইস্যু এবং ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা করে থাকেন। অত্যন্ত সহজ ও বোধগম্য ভাষায় উপস্থাপিত কথাগুলো যেকোনো শ্রোতা এবং দর্শককে মুগ্ধ করে। সংক্ষিপ্ত অথচ, প্রাণবন্ত আলোচনায় তিনি মানবজাতিকে সত্য ও সুন্দরের পথে আহবান করেন। ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও লন্ডন মুসলিম সেন্টারে ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালনকালে তিনি হাজার হাজার মানুষের সামনে বক্তব্য রাখেন। এসব বক্তব্যে পথ খোঁজে পায় পথহারা মানুষ। ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত খোদাভীরু হাফেজ মাওলানা আবুল হোসাইন খান আল্লাহর দ্বীনকেই জীবনোদ্দশ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন সেই ছাত্রজীবন থেকেই। তাঁর সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, দৃঢ়তা, সাহসিকতা এবং ন্যায়পরায়ণতা যেন তাঁর আধ্যাত্মিকতারই বহিঃপ্রকাশ। দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রসার ছাড়াও তিনি সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। লেখক হিসেবেও তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং নিষ্ঠাবান। ইতোমধ্যে তাঁর কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকের মাঝে এর মাধ্যমে অর্জন করেছেন ভালোবাসা ও সম্মান। সর্বশেষ প্রকাশিত ‘কুরআনে বাংলা শব্দের সমাহার’ তাঁর দরদি ও সার্থক প্রয়াস।
বাংলাভাষাকে বলা হয় মিশ্র ভাষা। কারণ পৃথিবীর অনেক ভাষার শব্দ এই ভাষায় এসে সম্পৃক্ত হয়েছে। এই ভাষায় যেমন সংস্কৃত, তৎসম, তদ্ভব শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে তেমনি আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, চীনা, নাগরি, ওলন্দাজসহ বিভিন্ন ভাষার শব্দ বিদ্যমান। এই শব্দগুলো বাংলা ভাষায় প্রবেশ করলেও এগুলো এখন এ ভাষার নিজস¦ সম্পদ। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে-বাংলা ভাষায় আল-কুরআনুল কারিমের অন্তত ৯’শ-এর বেশি শব্দ এই ভাষায় বিদ্যমান। এই তথ্যটি শায়খ মুহাম্মদ আবুল হোসাইন খান তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এটা বাংলা ভাষার জন্যে যেমনই সম্মানজনক, তেমনই এই শব্দগুলো বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি ভাষাকে সম্মানিতও করেছে। শায়খ মুহাম্মদ আবুল হোসাইন খান ‘কুরআনে বাংলা শব্দের সমাহার’ গ্রন্থে এই শব্দগুলো কুরআন থেকে খোঁজে খোঁজে মলাটবদ্ধ করেছেন যা নিঃসন্দেহে দুঃসাধ্য ও কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটিই তিনি সম্পাদন করেছেন দরদি মন নিয়ে। এই শব্দগুলোর মাধ্যমে মাতৃভাষায় কুরআনকে বুঝতে দিক-নির্দেশক হিসেবে ভ‚মিকা রাখবে।
‘কুরআনে বাংলা শব্দের সমাহার’ গ্রন্থটির বিষয়বস্তুকে শায়খ মুহাম্মদ আবুল হোসাইন খান ১৪টি লেসনে সুবিন্যস্ত করেছেন। লেসনগুলো ভাগ করার পূর্বে গ্রন্থ সম্পর্কে একটি চমৎকার ভ‚মিকা সংযোজন করেছেন। যা কুরআনকে বাংলাভাষায় বুঝতে কুরআনপ্রেমিকদেরকে উৎসাহিত করবে নিঃসন্দেহে। এছাড়াও গ্রন্থটিতে সহজভাষায় সংক্ষিপ্ত একটি নিবন্ধ রয়েছে যা কুরআনুল কারিমকে অনুধাবন সম্পর্কিত দিক-নির্দেশনা।
‘কুরআনে বাংলা শব্দের সমাহার’ গ্রন্থের লেসনগুলো নিম্নরূপ : আমাদের সমাজে ও সংস্কৃতিতে বাংলায় ব্যবহৃত কুরআনের শব্দসমূহ, ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় অঙ্গনে ব্যবহৃত শব্দসমূহ, ইবাদাত ও দ্বীন ইসলামে পরিচিত কুরআনের শব্দাবলী, দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত বিয়েশাদি ও আচার-ব্যবহার সংক্রান্ত কুরআনের শব্দসমূহ, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত কুরআনে বর্ণিত বাংলা শব্দসমূহ, এমন কিছু অতি ব্যবহৃত শব্দ যা বারবার তিলাওয়াতকারীর সামনে এসে যায়- এরূপ শব্দ, আল-কুরআনে বর্ণিত ভালো ও সুন্দর-সুন্দর নামের সম্ভার, কুরআনে বর্ণিত আল্লাহ তায়া’লার গুণবাচক নামসমূহ, বাংলায় ব্যবহৃত কুরআনে বর্ণিত নবী-রাসুলদের নাম, কুরআনে বর্ণিত খারাপ নামসমূহ, অধিক ব্যবহৃত অর্থবোধক অক্ষর বা শব্দের সমাহার, সংক্ষিপ্ত উলূমুল কুরআন, জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কিত কুরআনের আয়াত নির্দেশক এবং সর্বশেষ কুরআন এড়িয়ে চলা কবিরা গোনাহ।
উপরোক্ত লেসনগুলোই পাঠযোগে অনুধাবন করা যায়- কুরআনুল কারিমের এই শব্দগুলো আমাদের ব্যবহারিক জীবনে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। এই শব্দগুলোর অনন্য এবং বিশেষত্ব হচ্ছে- শব্দগুলোর বাংলা অর্থের পাশাপাশি ইংরেজি অর্থ এবং কোন সূরার কোন আয়াতে উল্লেখিত আছে তাও বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে পাঠক সহজেই কাক্সিক্ষত শব্দটি কুরআন থেকে খোঁজে নিতে পারবেন। আর প্রতিটি লেসনের স্বতন্ত্র বিশেষত্ব আছে গুরুত্বের দিক দিয়ে। এছাড়া শায়খ মুহাম্মদ আবুল হোসাইন খান এই গ্রন্থে কুরআনুল কারিম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত জ্ঞান এবং বিজ্ঞান বিষয়ক আয়াত-সূরার উল্লেখ করেছেন। এতেও বিজ্ঞাননিবিষ্ট পাঠক কুরআনকে অনুধাবনে আরো বেশি আগ্রহী ও পরিশ্রমী হয়ে উঠবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। গ্রন্থের সার্বিক দিক বিবেচনায় বলা যায়- গ্রন্থটি আল- কুরআনকে বুঝার জন্য একটি কার্যকর যুগোপযোগী উদ্যোগ। এই গ্রন্থটি মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে কাজে আসবে। এছাড়াও কুরআনের সাথে সেতুবন্ধনে সহায়ক হিসেবে অবদান রাখবে। গ্রন্থটি মুদ্রিত হয়েছে সিলেটের সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা ‘পাণ্ডুলিপি প্রকাশন’ থেকে। এই গ্রন্থটি লেখক শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই উৎসর্গ করেছেন। গ্রন্থটি বিনামূল্যেই বিতরণ করা হবে। এ থেকে তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সত্যিকার অর্থে দ্বীনের প্রতি আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা থাকলেই শুধুমাত্র দ্বীনের জন্য সবকিছু উৎসর্গ করা যায়। এই কাজটিই করেছেন শায়খ মুহাম্মদ আবুল হোসাইন খান। আল্লাহ তায়া’লা এজন্য তাঁকে উত্তম জাযা প্রদান করবেন ইনশাআল্লাহ। আমি তাঁর ব্যক্তিজীবনের কল্যাণ এবং গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, প্রকাশক ও সংগঠক