একুশের চরিত্রবদলের কষ্টকল্পিত ইতিহাস
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:১৯:৪৯,অপরাহ্ন ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ | সংবাদটি ২১৪০ বার পঠিত
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ।।
আজ ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারি। এই দিবসে স্মরণ করি সেই ভাষাসংগ্রামীদের, যাঁরা ৬৫ বছর আগে এই দিনে ভাষার লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছেন এবং পরবর্তীকালেও যাঁরা জেল-জুলুম-নির্যাতন অকাতরে সহ্য করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে গেলে এ কথা লিখতেই হবে। ভাষা একটি জাতিকে জন্ম দিয়েছে। সেই জাতি আবার সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়েছে। সেই স্বাধীন রাষ্ট্রের মানুষ আজ সেই দিবসটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করছে। স্মরণ করছে মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দেওয়া শহীদদেরও।
ভাষা দিবস নিয়ে এ বছরও নানা আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সংবাদপত্রে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে। জাতীয় জীবনে ভাষার গুরুত্ব, ভাষার চর্চা ও বিকাশ, একটি অত্যাধুনিক উন্নত ভাষা হিসেবে বাংলাকে গড়ে তোলার পন্থা ও পদ্ধতি সম্পর্কে নানা গুণীজন নানা প্রবন্ধ লিখেছেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে আমার চোখে পড়েছে প্রবীণ বাম বুদ্ধিজীবী ও লেখক বদরুদ্দীন উমরের একটি লেখা। ঢাকার একটি কাগজেই প্রকাশিত হয়েছে, শিরোনাম ‘প্রভাতফেরি কোথায় গেল?’
বদরুদ্দীন উমর আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রথম লিখেছেন এবং জাতিকে একটি সুবৃহৎ গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন। এই গ্রন্থে কিছু ইচ্ছাকৃত, কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুলভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও এটিই আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রথম ইতিহাস। এ জন্য তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বর্তমানেও কিছু লেখা ও কিছু বলার অধিকার অবশ্যই তাঁর আছে। এ জন্যই উমর ভাষা আন্দোলনের অতীত ও বর্তমান নিয়ে কী ভাবেন তা জানার আগ্রহ আমার প্রচণ্ড এবং সে জন্য ঢাকার একটি কাগজে প্রকাশিত তাঁর ‘প্রভাতফেরি কোথায় গেল?’ শীর্ষক লেখাটি সর্বাগ্রে পড়েছি।
বদরুদ্দীন উমরের লেখাটি পড়ে খুশি হতাম, যদি তিনি একুশের আন্দোলনের বর্তমানে একটি বার্ষিক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হওয়া এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাবে এখনো আশানুরূপ একটি আধুনিক উন্নত ভাষারূপে বাংলার গড়ে না ওঠা সম্পর্কে একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর মতামত জানাতেন এবং প্রতিকারপন্থারও উল্লেখ করতেন। তিনি তা করেননি। তিনি পাকিস্তানের প্রয়াত সুলেরি ও ভারতের কুলদীপ নায়াবের মতো একদেশদর্শী রাজনৈতিক কলামিস্টের অবস্থান নিয়েছেন এবং একুশের আন্দোলনের চরিত্র ও প্রভাতফেরিকে হত্যা করার অভিযোগ স্বাধীনতা-উত্তর মুজিব সরকারের ওপর চাপিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। তাঁর ও তাঁর সরকারের রাজনীতিতে ভুলত্রুটি থাকতেই পারে। ভুলত্রুটি কি জর্জ ওয়াশিংটন, লেনিন, গান্ধীর রাজনীতিতেও ছিল না? তা নিয়ে রাজনৈতিক সমালোচনা অবশ্যই চলতে পারে। কিন্তু ক্রমাগত ও সব বিষয়ে, কারণে-অকারণে একজন নেতার চরিত্র হনন করে চলা একজন বুদ্ধিজীবীর সুস্থ বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় বহন করে না। বরং তা তাঁকে পাঠকের চোখে ছোট করে। তাঁর লেখা পাঠকের চোখে ক্রেডিবিলিটি হারায়।
বদরুদ্দীন উমরের ‘প্রভাতফেরি কোথায় গেল?’ শীর্ষক লেখাটিতে তিনটি অভিযোগ রয়েছে। এক. দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে, অর্থাৎ মুজিব সরকার, তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে একুশের ভোরের প্রভাতফেরি কৌশলে বন্ধ করেছে। দুই. একই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একুশে ফেব্রুয়ারির যে চরিত্র ছিল প্রতিরোধ দিবসের, তাকে শোক দিবস ঘোষণা করে তার চরিত্র বদলে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য, জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ চেতনা বিলুপ্ত করে দেওয়া। তিন. একুশের গানটি (আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি) প্রথম দিকে আবদুল লতিফের সুরে গাওয়া হলেও জনপ্রিয় ছিল না। পরে আলতাফ মাহমুদ নতুন করে সুরারোপ করায় গানটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। গানটির মধ্যে প্রতিরোধের কোনো উপাদান নেই, তবে তার দ্বারা একুশের স্মৃতি জাগ্রত হয়। এর আগে অন্য গান গাওয়া হতো।
এই হলো একজন প্রবীণ সমাজবিজ্ঞানীর ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত আলোচনার মোদ্দাকথা। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি কেন স্বাধীনতার পর বন্ধ হয়ে গেল (সরকার বন্ধ করেনি, সে কথা উমরও স্বীকার করেছেন), সে সম্পর্কে উমরের প্রবন্ধে যে তথ্যবিকৃতি ঘটানো হয়েছে, ঢাকার অন্য একটি দৈনিকে তার বিশদ আলোচনা করেছি। প্রকৃত তথ্য তুলে ধরেছি। এখানে তাঁর বাকি দুটি বক্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করব। যে রাষ্ট্রভাষা দিবস নিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে কোনো বিতর্ক ও বিসংবাদ নেই, তাকেও ব্যক্তিগত অসূয়ার কারণে বিতর্কিত করা হোক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হোক—এটা কারো কাম্য হতে পারে না।
প্রথমে আসি একুশের চরিত্রবদলের কথায়। উমর লিখেছেন, ‘আগে ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল প্রতিরোধের প্রতীক। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন শাসনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা করা হলো শোক দিবস। বলা হলো, এর পর থেকে এই তারিখটিকে পালন করা হবে শোক দিবস হিসেবে। কাজেই এ দিবস থেকে হারিয়ে গেল প্রতিরোধ। শোকের মধ্যে যে প্রতিরোধের কোনো উপাদান থাকে না এটা বলাই বাহুল্য। শোক দিবসের ঘোষণা যেভাবে দেওয়া হলো তা থেকেই বোঝা গেল ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা, কোনো প্রতিরোধ যাতে না হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখেই করা হলো এই কাজ। এদিক থেকে বাংলাদেশের নতুন শাসকদের দূরদৃষ্টি বা ভবিষ্যদ্দৃষ্টির তারিফ না করে পারা যায় না। স্বাধীনতার পর সত্তরের দশক ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির সব থেকে অন্ধকার দশক। ’
অর্থাৎ স্বাধীনতার সোনালি ঊষালগ্নের কাল তথা মুজিব শাসনামলই ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে অন্ধকার দশক। জিয়ার রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থান, কর্নেল তাহেরসহ শয়ে শয়ে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন, সংবিধান হত্যা, খালেদা-নিজামীর শাসনামলে কৃষক হত্যা, হিংস্র মৌলবাদের প্রশ্রয়দান, রেকর্ড ভঙ্গকারী সন্ত্রাস ও দুর্নীতির জন্মদান—এগুলো কোনোটাই রাজনীতিতে অন্ধকার দশা সৃষ্টি করেনি; করেছে যে দশকে দেশ স্বাধীন হয়েছে, বাঙালি তার হৃত জাতিসত্তা ফিরে পেয়েছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি আবার পুনর্গঠন করা হচ্ছে, সেই দশকটি। একজন লেখক কতটা বিদ্বেষান্ধ হলে এ ধরনের ইতিহাসবিকৃতি ঘটাতে পারেন, তা-ও আবার সাম্প্রতিক ইতিহাস, তা কল্পনা করা কঠিন।
একুশে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নিশ্চয়ই প্রতিরোধ চেতনা ছিল, কিন্তু সেই প্রতিরোধ চেতনা গড়ে উঠেছিল একুশে ফেব্রুয়ারির নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শোকের মধ্য থেকে। শোকের মধ্যে প্রতিরোধের কোনো উপাদান থাকে না। এই অভিনব তত্ত্বটি উমর কোথা থেকে লিখেছেন? স্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্যে ক্রোধ থাকে না। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসকের দ্বারা যে নির্মম মানুষ হত্যা, তার থেকে ক্রোধ তৈরি হয়, সেই ক্রোধই জনমনে প্রতিরোধ চেতনার জন্ম দেয়। জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যায় ভারতবর্ষে যে শোক ছড়িয়ে পড়েছিল, তা থেকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ক্রোধ জেগে উঠেছিল। সেই ক্রোধ প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। সেই প্রতিরোধে একাত্মতা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ‘স্যার’ উপাধি ত্যাগ করেছিলেন।
যত দিন ভারত স্বাধীন হয়নি, জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস পালিত হয়েছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ দিবস হিসেবে। স্বাধীনতার পর ভারতে জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস আর প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ দিবস নয়; এখন তা স্মরণ দিবস। এই দিবসে কোনো শোভাযাত্রা হয় না। কার বিরুদ্ধে শোভাযাত্রা হবে? ভারতে সেই ব্রিটিশ রাজ্যের অস্তিত্ব নেই, সেই হত্যাকারী ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারে বহুকাল হয় মৃত। এখন জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবসের নেই আগের প্রতিরোধের চেতনা। এখন এই দিবস সরকারি-বেসরকারিভাবেও পালিত হয়। এটি এখন remembrance day বা স্মরণ দিবস। মানুষ শান্ত-সমাহিত চিত্তে শহীদদের স্মরণ করে এবং তাঁদের আত্মদানের কথা স্মরণ করে অনুপ্রেরণা পায়।
দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভিল গণহত্যা নিয়েও একই ব্যাপার ঘটেছে। তখনকার বর্বর শ্বেতাঙ্গ শাসকরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। ক্রোধে-প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল সারা বিশ্ব। প্রতিবছর দক্ষিণ আফ্রিকায় পালিত হতো শার্পভিল কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা দিবস। দাঙ্গা, সংঘর্ষ, রক্তপাত ছিল দিনটি পালনের বৈশিষ্ট্য। দক্ষিণ আফ্রিকা শ্বেতাঙ্গ শাসনমুক্ত হওয়ার পর এখনো শার্পভিল দিবস পালিত হয়। তবে প্রতিরোধ দিবস হিসেবে নয়, স্মরণ দিবস হিসেবে। প্রেসিডেন্ট পদে বসে নেলসন ম্যান্ডেলা এই স্মরণসভায় যোগ দিয়েছেন। তাঁকে পাহারা দিয়েছে দেহরক্ষী বাহিনী। তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়নি। কেউ বলেনি নেলসন ম্যান্ডেলার সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শার্পভিল দিবসের প্রতিরোধ চেতনা লুপ্ত করে তার চরিত্র বদলে দিয়েছে।
বাংলাদেশেও পাকিস্তানি শাসনের অবসান এবং বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর একুশে ফেব্রুয়ারির প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ভূমিকার অনেকটাই অবসান হয়েছে। এখন একুশের ভূমিকা হবে গঠনমূলক। এটি স্মরণ দিবস। ভাষাশহীদদের স্মরণ, সেই স্মরণের মধ্য দিয়ে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণে সরকারি ও বেসরকারি প্রচেষ্টা এক করাই হবে দিবসটি পালনের বৈশিষ্ট্য।
বায়ান্নর রক্তাক্ত ঘটনার পরের বছরও তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে ২১ ফেব্রুয়ারি শুধু প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হয়নি। ১৯৫৩ সালেও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তরফ থেকে যে প্রচারপত্র প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে লেখা হয়েছিল, ‘ভাষাশহীদদের স্মরণে শোক দিবস’। একুশে সংকলনের সম্পাদক কবি হাসান হাফিজুর রহমান একুশকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘শোকের তরবারি’ (এই নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থও আছে)। এই শোক থেকেই জনক্রোধের উদ্ভব এবং এই জনক্রোধই পরে গণপ্রতিরোধে রূপান্তরিত হয়েছিল। স্বাধীনতা-উত্তর সরকার কবে কোন দূর ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে জনক্রোধ দেখা দেবে এ জন্য একুশের প্রতিরোধ চেতনা আগেভাগেই মুছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে দিবসটির নাম শোক দিবস ঘোষণা করেছে, এটা হাস্যকর কষ্টকল্পনা।
মানুষ নির্যাতিত হলে শোক দিবস থেকেই নতুন ক্রোধ, নতুন প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে। তা না হলে স্বাধীনতার পরেও বারবার গণ-আন্দোলন ঘটে কিভাবে? স্বৈরাচারের পতন হয় কিভাবে? আর এই স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে জনতা বারবার ভাষাশহীদ মিনারে গিয়ে জমায়েত হতো কী জন্য?
একুশের গান সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমর তাঁর লেখায় যে তথ্য দিয়েছেন, তা-ও সঠিক নয়। এটা ইচ্ছাকৃত ভুল আমার মনে হয় না; হয়তো অনিচ্ছাকৃত ভুল। তবু সঠিক ইতিহাসের স্বার্থেই এই তথ্যবিকৃতি দূর হওয়া প্রয়োজন। এই নিবন্ধটি দীর্ঘ হয়ে যাবে, এ জন্য একুশের গান নিয়ে এখানে আলোচনা মুলতবি রাখলাম। অন্য একটি নিবন্ধে সে আলোচনা করার ইচ্ছা রইল।
লন্ডন, রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭