‘স্বপ্নের বাড়ি’ জুয়াড়িদের নিরাপদ আস্তানা!
প্রকাশিত হয়েছে : ২:০৩:০৩,অপরাহ্ন ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | সংবাদটি ৭০৫ বার পঠিত
মোঃ ওমর ফারুক, শরীয়তপুর থেকে:: শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর থানার দুর্গম চর মনাই হাওলাদারকান্দি গ্রামে তৈরি হওয়া স্বপ্নের বাড়ি নামে পরিচিত ঘর এখন জুয়াড়িদের নিরাপদ আস্তানা। ঢাকার ডেঙ্গুর চেয়েও যেন মহামারি আকার ধারণ করেছে এই স্বপ্নের বাড়ি। দিনমজুর থেকে শুরু করে কলেজে পড়ুয়া ছেলে, প্রবাস থেকে ছুটিতে দেশে আসা প্রবাসী, জেলে, গাড়ী চালক, দোকানদার, স্থানীয় রাজনীতির সাথে জড়িত কিছু ব্যাক্তি, ছোট-বড় ব্যবসায়ীরাও এসব জুয়ার আড্ডায় মেতে থাকছেন স্বপ্নের বাড়ীতে। দীর্ঘদিন ধরে এই জুয়ার আসর পরিচালিত হলেও কেউ কিছুই বলে না। অভিযোগ রয়েছে, সেখানে দুপুর থেকে রাতেও জুয়া ও মাদকের আসর চলে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ (সিথ্রিআর) একটি প্রকল্পের অংশ হিসেবে পদ্মার পাড়ে তিনটি বাড়ি নির্মাণ করেন গেল দু’বছর আগে। দুর্গম চরে ভাসমান তিনটি বাড়ি জেলাসহ সারা দেশে বেশ সাড়া ফেলেছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন বিকালে পদ্মাপাড়ে ওই তিনটি বাড়ির সামনে মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হতো। সেখানে চটপটি, ফুসকা, ঝালমুড়ি, আচার, কয়েকটি মুদি দোকানও বসেছিল। কর্মসংস্থান হয়েছিল অনেক বেকার যুবকদের। বাড়ি তিনটি ওই এলাকার বুলবুলি বেগম, আমিরুন বেগম, জাহাঙ্গীর হোসেন, হাকিম মিয়া, সেকেন্দার ও নাজিম হাওলাদার নামে ছয়টি হতদরিদ্র পরিবারকে দেয়া হয়েছিল। প্রতিটি বাড়িতে দুটি পরিবার বসবাস করতেন। এখন আর বাড়িতে কোনো লোকজন বসবাস করে না। পরিত্যক্ত বাড়িতে নানা রকম অসামাজিক কার্যক্রম চলে। দুপুর, বিকাল, রাতে তিন বেলা শ্রেণি বেঁধে বসে জুয়ার আসর, গাজা, মদসহ নানা অবৈধ কার্যক্রম হয় সেখানে। বাড়িটি দেখার যেন কেউ নেই। বাড়ির অনেক উপকরণই এখন বাড়িতে নেই। রাতের আঁধারে কে বা কারা বাড়ি থেকে এসব উপপকরণ নিয়ে গেছে। এ বাড়ি নিয়ে ওই এলাকার মানুষের কাছে বিড়ম্বনা। এলাকার পরিবেশ নষ্ট করছে।
১৮৬৭ সালে প্রণীত বঙ্গীয় প্রকাশ্যে বাংলাদেশে জুয়া আইন নিষিদ্ধ। আইন অনুযায়ী, কোনো ঘর-বাড়ি, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এধরনের কোনো ঘরে তাস-পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনো ব্যক্তিকে ক্রীড়ারত (জুয়ারত) বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে, তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এই আইন থাকা সত্বেও প্রকাশ্যে দিবালোকে জুয়া খেলে যাচ্ছে জুয়াড়িরা।
এক জুয়াড়ি বলেন, আসলেই জুয়া খেলা ভালো না। গতকাল সহ আজ সকাল থেকে দুপুর পযর্ন্ত যে টাকা ইনকাম করেছিলাম ১ (এক) ঘন্টায় সব শেষ হয়ে গেলো। চেষ্টা করছি ছাড়ার জন্য কিন্তু সবাইকে যখন খেলতে দেখি তাদের সাথে আবার খেলতে বসে পরি।
কথা হয় স্থানীয় ১ (এক) জুয়াড়ির বাবার সাথে, তিনি অভিযোগ করে বলেন, তার ছেলে ভাড়ায় চালিত মোটর বাইক চালায়। কিছু দিন আগে কিস্তির মাধ্যমে নতুন বাইক কিনে দেন। প্রথম ২/৩ মাস ঠিক মত মাসিক কিস্তি দিতে পারলেও এখন দিতে পারে না। একই অভিযোগ করেন নাম প্রকাশে অনিশ্চিক এক জেলে, তিনি বলেন, যারা জুয়া খেলা বন্ধ করবে যদি তারাই খেলে তাহলে বন্ধ করবে কারা? সবই কপাল। সব দোষ কপালের। কেন এমন পরিবেশে বসবাস করতে হচ্ছে।
স্বপ্নের বাড়ি নিয়ে বেশ বেকায়দায় আছেন বলে জানান ৭০ বছর উর্ধে একজন বৃদ্ধ মা, তিনি বলেন, কি বলব বাবা? এখানে মানসম্মান নিয়ে বাস করাটা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারও বাড়িতে অতিথি এলে, নদীর পাড়ে ঘুরতে গেলে জুয়াড়িরা ঘিরে ধরে জিজ্ঞেস করে, খেলবেন নাকি? এভাবে কী ভদ্র সমাজ নিয়ে বাস করা যায়। মেহমান এলে আমাদের লজ্জার মধ্যে পড়তে হয়। আরেকজনের কথা, ‘বাড়িতে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে মেহমান এসেছিল। তাদের মধ্যে দু’জন স্বপ্নের বাড়ি ঘুরতে গিয়ে সর্বস্ব খুঁইয়ে লজ্জায় আর আমার বাসায় আসেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক স্থানীয় যুবক বলেন, ‘শুধু দিনে নয়’ রাত গভীর হলেই এখানে চলে জুয়ার আসর। সেই সঙ্গে চলে মাদক সেবনের আড্ডা। প্রশাসনও জানেন কে বা কারা এর সাথে জড়িত। তারা দেখেও দেখে না। যারা এখানে নেশা ও জুয়া খেলে সবাই এলাকার পরিচিত মূখ। ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস রাখে না।
এ ব্যাপারে সখিপুর থানা যুব লীগের আহবায়ক আব্দুর খালেক খালাসী বলেন, যেহেতু মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় একেএম এনামুল হক শামীমের বাড়ি চরভাগাতে। এই পবিত্র চরভাগা তথা সখিপুরে জুয়া-মাদক তো দূরে থাক কোন প্রকাশ অপকর্ম মেনে নেয়া হবে না। মন্ত্রী মহোদয়ের নিদের্শ আছে যে বা যারা খারাপ কাজের সাথে জড়িত থাকবে তারা যে দলেই হউক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সখিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এনামুল হক বলেন, প্রকাশ্য দিবালোকে জুয়া খেলার এমন তথ্য কেউ দেইনি। যদি এমনটা হয়ে থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।