সর্বত্র পাপের ছড়াছড়ি: উলামায়ে কেরামের সতর্ক পদক্ষেপ জরুরি
প্রকাশিত হয়েছে : ১:৫২:১৭,অপরাহ্ন ০৮ জুলাই ২০১৯ | সংবাদটি ৫৩৬ বার পঠিত
লিসানুল হক শাহরুমী
একটু ফিকির করুন৷ সমগ্র উম্মাহর মধ্যে সাহাবায়ে কেরাম রিদুয়ানুল্লাহি আলাইহিম আজমাঈন শ্রেষ্ঠ৷ তাঁরা নিষ্পাপ নন৷ কিন্তু তাঁদের অপরাধ উম্মাহর জন্যে চর্চা করা উম্মাহর জন্যে অপরাধ হিসেবে পরিগণিত৷ এর কারণ অনেক৷ এটা ভিন্ন একটি বিষয়৷ তবে এখানে আলোচ্য হলো কুরআনে কারীমে নাযিল হওয়া বিধিবিধানসমূহ৷ প্রায় সব আয়াত এবং সূরা এবং সূরায় উল্লিখিত বিধিবিধান কোনো না কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই অবতীর্ণ হয়েছে৷
মুসলমান বলতেই যেসব কাজ অনুচিত এরকম কোনো বিষয়কেই আল্লাহ তাআলা বাদ রাখেন নি৷ আপনি অপরাধ সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো দেখুন৷ চুরি, অপবাদ, ব্যভিচার ইত্যাদী মারাত্মক গর্হিত কাজগুলো সম্পর্কে যে আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে সবগুলো ভিন্ন ভিন্ন সংঘটিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাযিল হয়েছে৷
প্রশ্ন হলো অপরাধগুলো কে করেছিল বা কার দ্বারা সংঘটিত হয়েছিলো? শানে নুযুলে দেখা যায় বহু দুর্ঘটনা সাহাবায়ে কেরামের মধ্য থেকেই বিভিন্ন নারীপুরুষের দ্বারা সংঘটিত হয়৷ উলামায়ে কেরাম আশা করি জানেন সেই মহিলার কথা যিনি ব্যভিচারের অপরাধে লিপ্ত হয়ে সাথেসাথে অনুতপ্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর দরবারে এসে নিজের অপরাধ নিজে স্বীকার করে ব্যভিচারের হদ্দ বাস্তবায়ন করতে অনুরোধ করেন৷ এরপর রাসূল ﷺ ওই মহিলার সন্তানকে দুধ ছাড়ানো পর্যন্ত সময় দিয়ে তারপর হদ্দ জারি করেন৷ সে বহু দীর্ঘ কাহিনী৷ এই মহিলা তো সাহাবিয়া ছিলেন এবং তাঁর তাওবাহ কবুল হয়েছিলো৷ একমাত্র সাহাবিয়া হবার কারণে ঘৃণা তো দূরের কথা বরং শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে৷ ব্যভিচারের অপবাদ দেয়ার ঘটনাও সাহাবীর দ্বারা সংঘটিত হয়েছিলো৷
মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে ঘিরে ইফকের যে স্পর্শকাতর কাহিনী তৈরি হয়েছিলো তা যদিও মুনাফিকদের মাধ্যমে বেশি প্রচার লাভ করে, তথাপি এ ঘটনায় হযরত হাসসান রাদিয়াল্লাহু আনহু, হযরত মিসতাহ সহ বেশ কয়েকজন সাহাবীও জড়িয়ে পড়েন৷ এরকম ঘটনা সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে প্রচুর পাওয়া যায়৷ কিন্তু আমরা কি কখনও এসব ঘটনাকে উপজীব্য করে সাহাবায়ে কেরামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে পারি? এতে কি তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা একটুও কমেছে? বা এগুলোর দ্বারা তাঁদের মধ্যে কি পারস্পরিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিলো?
সাময়িকভাবে হলেও স্থায়ীভাবে কোনো দূরত্ব সৃষ্টি হয় নি৷ মিসতাহ রা. হযরত আবু বকরের কৃপায় চলতেন বিধায় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন মানসিকভাবে৷ এজন্যে তিনি আর সাহায্য করবেন না বলে যখন শপথ করলেন সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাআলা তাঁকে সতর্ক করে আলাদা আয়াত নাযিল করলেন৷ কারণ আয়াত নাযিলের পর জড়িতরা সবাই সংশোধন হয়ে গিয়েছিলেন৷ এখানে বিবেচ্য বিষয় হলো, অনেক অপরাধ সংঘটিত হওয়া সত্তেও না তাঁদের নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় ছিলো, না পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতায় ভাটা পড়েছিলো৷ আর না আজ অবধি তাঁদের প্রতি মুসলিম উম্মাহর ঘৃণা জন্মেছে৷ অনেক লোক না বোঝে প্রশ্ন করে থাকে যে, দীনী প্রতিষ্ঠানে এরকম অপরাধ কীভাবে সম্ভব? বা অমুক ব্যক্তি অমুকের মতো এতো বড় বুজুর্গের সাহচর্য পেয়ে এমন মারাত্মক অপরাধ কীভাবে করতে পারে? ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এই প্রশ্নের জবাবে আমরা সাহাবায়ে কেরামের জীবনী থেকেই পেতে পারি৷ একজন মানুষ যতো ভালোই হোক এবং যতো ভালো লোকের সাহচর্যেই থাকুক অপরাধের বেলায় এটা ধর্তব্য নয়৷ কারণ অপরাধের পেছনে অনেক কারণ নিহিত থাকে৷ কখনও শয়তানের প্ররোচনায়, কখনও নফসের প্রণোদনায়, কখনও পরিবেশের কারণে, কখনও অসৎ সঙ্গ ও সঙ্গীর কারণে৷ যেখানে অনেক ভালো লোকের বসবাস সেখানে অপরাধ হবে না এটা শতভাগ বলা যায় না৷ তবে অন্য জায়গার তুলনায় অনেক কম বা হঠাত দুয়েকটি৷ এমতাবস্থায় আমরা কি ব্যক্তিকে দোষারোপ করবো, না প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা ধর্মকে? নিশ্চয় ব্যক্তিকেই দোষী করবো? কিন্তু তখনও কি আমরা প্রথমে প্রচার করবো, না সমাধানের চিন্তা করবো এবং যথাসম্ভব ব্যক্তিকে পুরো সমাজের সামনে লাঞ্চিত করা থেকে বিরত থাকবো? এ ব্যাপারে ইসলাম কী বলে তা জানার চেষ্টা করা জরুরি বলে মনে করি৷ আর এর বিপরীতে যদি অপরাধ পুরো প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও পুরো রাষ্ট্রে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ে? তখন কি নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীকে দোষারোপ করাটা যৌক্তিক হবে? কারণ মহামারী যখন ছড়িয়ে পড়বে তখন তার কিছু ভাইরাস সৎ লোকদের মধ্যেও স্বাভাবিকভাবেই ছড়িয়ে পড়বে৷ পর্দাহীনতা, নির্লজ্জতা, বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনার যাত্রা তো মাদরাসা থেকে সূচিত হয় নি৷ শুরুটা যেখান থেকে হয়েছিলো সেটাও আমাদের দেখতে হবে৷ তবে এহেন পরিস্থিতিতে দীনী মাদরাসাগুলোর উচিত হবে অন্যদের বাঁচাতে না পারলেও নিজেদেরকে নিষ্কলঙ্ক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া৷ যা হোক আমি বলতে চেয়েছিলাম যে, শুধু ছিঃ ছিঃ বলে, ঘৃণার থুথু ফেলে আমরা কেউই নিরাপদ থাকতে পারবো না৷ যে রোগের কারণে আমি রোগীকে থুথু দিচ্ছি আগামীকাল একই রোগে আমিও আক্রান্ত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়৷ (আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন আমীন৷) আমি সাহাবায়ে কেরামের ঘটনাবলী উল্লেখ করে একথা বোঝাতে চেয়েছি যে, অপরাধের বেলায় রাসূল ﷺ যেমন সাহাবীদেরকে ছাড় দেন নি, আমরাও সমগোত্রীয় লোকদেরকে ছাড় দেবো না৷ বরং ফোঁড়া যখন অপারেশনের উপযুক্ত হবে তখন পুরো অঙ্গ কেটে ফেলতে দ্বিধা করা উচিত নয়৷ শত্রুদের হাসির খোরাক হবার আগেই এসব ঘরের শত্রুকে বহিষ্কার করা জরুরি এবং প্রয়োজনে সাধারণ ঘোষণা সহ যে, আমাদের সাথে এসব অপরাধ ও অপরাধীর কোনো সম্পর্ক নেই৷ আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মিডিয়া৷ সংক্ষেপে শুধু বলি—মিডিয়ার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সম্পর্কে আমাদের আরও ধারণা নেওয়া উচিত৷ সেইসাথে মিডিয়ার ইসলামবিরোধী কারসাজি সম্পর্কে আরও সতর্ক হওয়া অতীব জরুরি৷
লেখক: গবেষক, কবি ও ইসলামী চিন্তক।