কুরআনের আলোকে কুদৃষ্টির চিকিৎসা
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:৩০:১২,অপরাহ্ন ২৫ জুন ২০১৯ | সংবাদটি ৬০৫ বার পঠিত
।।মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী।।
বর্তমানে ইন্টারনেট টিভি ও ভিসিআরের কারণে ঘরে-ঘরে ফ্লিম নাটকের ছড়াছড়ি। নগ্নতা ও অশ্লীলতার তুফান চলছে। যুবতীরা পর্দাহীন হয়ে দেহপ্রদর্শনী করে মার্কেটে-মার্কেটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এ্যাডভেটাইসের নামে পথের কিনারায় নারীদের আকর্ষণীয় ছবি দেখা যাচ্ছে।
সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে নারীদের উত্তেজক ছবি তো এখন সাধারণ বিষয়। এহেন পরিবেশে যুবক তো পরের কথা, বুড়োদের দৃষ্টি সংযত রাখাও মহা আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শতচেষ্টা সত্ত্বেও এ থেকে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। যাদের অন্তরের হেদায়েতের আলো আছে, তারা গুনাহটির ব্যাপকতা দেখে ভেতরে-ভেতরে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।
তরিকতের সালিক-মুরিদ ও শিষ্যরা নিজেদের পীরের কাছে এ থেকে পরিত্রাণের ওষুধ প্রার্থনা করেন। তাই প্রয়োজন মনে হল, এ থেকে পরিত্রাণের কিছু পরীক্ষিত ওষুধ কুরআন-হাদীসের আলোকে পেশ করব। যাতে দৃষ্টি হারামপাত্র থেকে ফিরে এসে হালালপথে ধাবিত হয়। যৌনউম্মাদনার জ্বলে ওঠা আগুন নিভে যায়। পবিত্র ও শালীন জীবনযাপন সহজ হয়ে যায়।
পবিত্র কুরআনের আলোকে
কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার উদ্দেশে পবিত্র কুরআনের আলোকে সাতটি ব্যবস্থাপত্র নিম্নে উপস্থাপন করা হল-
এক. মহান আল্লাহ বলেন- ‘মুমিনদেরকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখে।’
কুদৃষ্টির সর্বোত্তম চিকিৎসা হল, নিজের দৃষ্টি অবনত রাখা। সুতরাং সালেক তথা আত্মশুদ্ধি প্রত্যাশীব্যক্তির জন্য আবশ্যক হল, পথে চলতে গিয়ে দৃষ্টিকে অবনত রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা। পায়ে হেঁটে চললে দৃষ্টি নিচের দিকে রাখুন।
গাড়িতে থাকলে দৃষ্টি এতটুকু উঠিয়ে রাখুন, যেন অন্যান্য গাড়ির চলাচল বুঝতে সক্ষম হন। কারো চেহারার প্রতি দৃষ্টি নয়; কারণ ফেতনার শুরুটা এটা দ্বারাই হয়।
দৃষ্টি ভুল করে ফেললে ইসতেগফার করুন এবং দৃষ্টি নামিয়ে নিন। এ অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রাখুন, এমনকি এটাকে জীবনের অংশ বানিয়ে নিন।
অফিসিয়াল কাজে কিংবা কেনাকাটার সময় কোনো নারীর সাথে কথা বলার প্রয়োজন হলে তার চেহারার দিকে তাকাবেন না। যেমনিভাবে কেউ কারো ওপর অসন্তুষ্ট থাকলে কথা বলার সময় পরস্পরের প্রতি তাকায় না। দৃষ্টি বিনিময় করেনা।
অনুরূপভাবে কোনো প্রয়োজনে পরনারীর সাথে কথা বলতে হলে এটা মনে রাখবেন যে, আল্লাহর নির্দেশের কারণে আমি তার প্রতি অসন্তুষ্ট, সুতরাং তার চেহারার প্রতি তাকাব না।
দুই. আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘নারীদের থেকে তোমাদের পছন্দমত বিয়ে কর।’ -সূরা নিসা : ৩
যত দ্রুত সম্ভব দীনদার অনুগত ও সুন্দরীনারী দেখে বিয়ে করে নিন, যাতে করে জৈবিকচাহিদা পূরণ করা যায়। ক্ষুধার্তব্যক্তি যদি অধিক নফল নামায পড়াকে নিজের ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থাপত্র মনে করে তাহলে তার চিকিৎসা করা উচিত। ক্ষুধার ওষুধ হল, খানা খাওয়া এবং আল্লাহর কাছে ক্ষুধা নিবারণের প্রার্থনা করা।
অনুরূপভাবে দৃষ্টি পবিত্র রাখার ব্যবস্থাপত্র হল, বিয়ে করা এবং আল্লাহর কাছে পবিত্র জীবনযাপনের জন্য দুআ করা। সুযোগ পেলে স্ত্রীর চেহারার দিকে ভালবাসাপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকাবেন।
আল্লাহর শোকর আদায় করবেন যে, নেয়ামতটি না পেলে কত গস্নানি যে পোহাতে হত! যে কামদৃষ্টি মার্কেটে বিচরণশীল নারীর প্রতি দেন তা স্ত্রীর প্রতি দিন। স্ত্রীকে পরিষ্কার-পচ্ছিন্ন থাকার ব্যাপারে উৎসাহিত করবেন। ভাল কাপড় কিনে দিন। অন্য নারীর কাছে যা কিছু আছে তার সবই আপনার স্ত্রীর কাছেও আছে।
ভাবুন, আমি যদি পরনারীর প্রতি তাকাই তাহলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন। পক্ষান্তরে নিজের স্ত্রীকে দেখলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। হাদীসে আছে- ‘যেব্যক্তি স্ত্রীর প্রতি মুচকিহেসে তাকায় এবং যেস্ত্রী স্বামীর প্রতি মুচকি হেসে তাকায় তখনআল্লাহতাআলা উভয়ের প্রতি মুচকি হেসে তাকান।’
হালালকে দেখুন প্রাণভরে, যেন হারামের প্রতি লোভ না জাগে। যখনই মন পরনারীর প্রতি আকর্ষণবোধ করবে তখনই স্ত্রীর কথা কল্পনায় আনুন। দেখবেন, গুনাহর চিন্তা অন্তর থেকে দূর হয়ে যাবে।
তিন. আল্লাহ তা‘আলা বলেন-‘নিশ্চয় যারা আল্লাহতাআলাকে ভয় করে যখন তাদেরকে শয়তানের কোনো দল ঘিরে ধরে তখন তারা আল্লাহর যিকির করে। সুতরাং তাদের অনুভূতি ফিরে আসে।’
আয়াতটিতে এ রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে যে, যখনই শয়তান আক্রমন করবে, অন্তরে কুমন্ত্রণা ঢেলে দিবে তখনই যিকিরের অস্ত্র ব্যবহার করে তা প্রতিহত করবে।
এজন্য রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় যিকিরের প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সম্ভব হলে তাসবীহ রাখবেন। অন্যথায় মনে-মনে যিকির করবেন। অলসতা গুনাহর অন্যতম ভূমিকা। সুতরাং যিকির দ্বারা অলসতা দূর করুন। যিকিরের আলো অন্তরে অপার্থিব প্রশান্তির জন্ম দেয়।
চার. আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘সে কি জানে না যে আল্লাহ দেখতে পাচ্ছেন।’ (সূরা আলাক : ১৪)
আত্মার সংশোধনপ্রয়াসী সালেক যখনই পরনারীর প্রতি তাকানোর ইচ্ছা করবে তখনই এ কল্পনা করবে যে, আল্লাহ আমাকে দেখতে পাচ্ছেন। এতে দৃষ্টির হেফাজত করা সহজ হবে। এর দৃষ্টান্ত হল,ওই নারীর বাবা কিংবা স্বামী যদি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে তবে কি আমি ওই নারীর প্রতি তাকিয়ে থাকতে পারব? তখন কি আমার মনে হবে না যে, ওই নারীর বাবা বা স্বামী আমার ওপর রাগ করবেন?
অনুরূপভাবে ভাবুন, আমি যদি পরনারীর প্রতি থাকাই, অথচ আল্লাহ আমাকে দেখছেন, তখন অবশ্যই তিনি রাগ করবেন। যদি তিনি পাকড়াও করেন তাহলে আমার কী অবস্থা হবে?
পাঁচ. আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘যারা আমার পথে সাধনা করে আমি অবশ্যই তাদেরকে পথ দেখাব।’ (সূরা আনকাবুত : ৬৯)
তাফসীরবিশারদগণ লিখেছেন, শরীয়তের ওপর চলার উদ্দেশ্যে মনের বিপরীত আমল করাকেই মুজাহাদা তথা সাধনা বলে। এটা বাস্তব যে, মুজাহাদা দ্বারা ‘মুশাহাদা’ লাভ হয়।
সুতরাং পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দিতে যখনই মন চাইবে তখনই নিজের ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে তার বিরোধিতা করবেন। মনে একথা বদ্ধমূল রাখবেন, এই সাধনার দ্বারা আমার প্রকৃত মাহবুব তথা আল্লাহতাআলার মুশাহাদা বা দর্শন নসিব হবে।
এমনিতে এ ধরনের সাধনা হয় কয়েক মুহূর্তের। অথচ মুশাহাদার স্বাদ হবে চিরদিনের জন্য। মনে রাখবেন, যবতে-নফস তথা নফসকে দমানোর নূর দ্বারা অন্তর খুব দ্রুত পরিষ্কার হয়। তাসবিহর দানাও এর সামনে কিছু নয়। সাহসহারা হওয়া সমস্যার সমাধান নয়। হিম্মত ধরে রাখলে সমস্যার সমাধান হয়। সুতরাং মনের ওপর জোর খাটান। তাকে শরীয়তের লাগাম পরিয়ে দিন, যেন কেয়ামতের দিন সৌভাগ্যের মালা পরার ভাগ্য জুটে।
ছয়. আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে দিয়ে দিতে।’ (সূরা নিসা : ৫৮)
সংশোধনপ্রত্যাশী সালেক এই কল্পনা ধরে রাখবে যে, আমার চোখ আল্লাহপ্রদত্ত আমানত। এই আমানত ব্যবহার করতে হবে তাঁরই নির্দেশ অনুপাতে। বিপরীত করলে আমানতের খেয়ানতকারী হয়ে যাব। সাধারণত নিয়ম হল, আমানতে একবার খেয়ানত করলেও তার কছে দ্বিতীয়বার আমানত রাখা হয় না।
এমন যেন না হয় যে, দুনিয়াতে আল্লাহর দেয়া দৃষ্টিশক্তি পরনারীর পেছনে ব্যয় করলাম, পরিণামে তিনি আমার দৃষ্টিশক্তি আখেরাতে ফেরত দিবেন না। ওইদিন যদি অন্ধ হয়ে ওঠতে হয় তাহলে কী অবস্থা হবে? পবিত্র কুরআনে এটার প্রমাণ আছে যে, আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন কিছুলোককে অন্ধ করে ওঠাবেন। তখন তারা জিজ্ঞেস করবে- ‘প্রভু! আমাকে অন্ধ বানিয়ে ওঠালেন কেন? আমার তো দৃষ্টিশক্তি ছিল!’
এটা ভাবনার বিষয় যে, আমরা এমন যুগে দুনিয়াতে সৃষ্টি হয়েছি যখন আল্লাহর প্রিয়বন্ধুর দর্শনলাভ করতে পারি নি। কেয়ামতের দিনও যদি অন্ধ করে ওঠানো হয় তাহলে আল্লাহর প্রিয়বন্ধুর দর্শনলাভ থেকে বঞ্চিত হব। আল্লাহর প্রিয়বন্ধুর নাম হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে দ্বিতীয়বার বঞ্চিত হওয়া থেকে বাঁচান। সুতরাং দৃষ্টিসংরক্ষণ জরুরি, যেন কেয়ামতের দিন আমানতটি দ্বিতীয়বার ফেরত পাই।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘নিশ্চয় আল্লাহ সুন্দর।’ (আলজামিউসসাগীর, খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ২৬৩)
এ কথাটা মাথায় রাখবেন যে, যদি আমি দুনিয়ার সুন্দরীদের প্রতি কুদৃষ্টি দেই তাহলে আল্লাহতাআলা কেয়ামতের দিন তার সৌন্দর্যের দর্শনলাভ থেকে আমাদের বঞ্চিত করে দেন কিনা!
সাত. আল্লাহ তাআলা বলেছেন- ‘যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয় কি আল্লাহর স্মরণে ও যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিগলিত হওয়ার সময় কি আসে নি?’
সালেক তথা আত্মার সংশোধনপ্রত্যাশীর মন যখনই কুদৃষ্টির গুনাহতে লিপ্ত হওয়ার জন্য ইতিউতি করবে, তখনই সঙ্গে সঙ্গে আয়াতটির বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে চিন্তা করবে। তখনই নিজেকে সম্বোধন করে বলবে ‘ঈমানদারের কি এখনও আল্লাহকে ভয় করার সময় হয় নি?’
প্রতিটি কৃদৃষ্টির সময় আয়াতটির বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে ভাবতে থাকুন এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করতে থাকুন। এতে আল্লাহতাআলা নিজের ভয় আপনার অন্তরে তৈরি করে দিবেন এবং কুদৃষ্টি থেকে সত্যিকারের তাওবা আপনার নসিব হবে।
অনুবাদ: মাওলানা উমায়ের কোববাদী নকশবন্দী।