কবিতা পিঠার মিলন – আবু মকসুদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১:৪৩:৩৫,অপরাহ্ন ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ | সংবাদটি ১৭৫৮ বার পঠিত
আবু মকসুদ:
অনেকদিন আগের কথা; আমি তখন ছোট, শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখছি। শীতের সকাল বিছানায় লেপমুড়ি দিয়ে বড় ভাই কবিতা আবৃত্তি করছেন। পাশের রুমে আমি পড়ার টেবিলে ‘উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে’ মুখস্ত করছি।
উত্তম অধম কিংবা মধ্যম কোন মাধ্যমের সাথেই আমার সংযোগ নেই ; সংযোগ হওয়ার বয়সও নয়, তবু গৃহশিক্ষক আমাকে এই তথাকথিত উপদেশাবলি জোর করে মুখস্ত করার জন্য করাচ্ছেন। আমার মনোযোগ উত্তম অধমের মধ্যে নয়, মনোযোগ বড় ভাইয়ের কবিতায়।
তখনকার সময়ে বড় ভাই দুটি কবিতা আবৃত্তি করতেন প্রথমটি পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘প্রতিদান’, দ্বিতীয়টি আল মাহমুদের ‘কবিতা এমন’। বড় ভাই খুব আবেগ নিয়ে ‘আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা/ আমি বাঁধি তার ঘর/ আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই/ যে মোরে করেছে পর আবৃত্তি করছেন এমন সময় আমাদের কাজের ছেলে বাটি ভরে রসের পিঠা এনে টেবিলে রাখল। আমি উত্তম অধম কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত রেখে রসের পিঠা গলাধঃকরণ করতে লাগলাম। সমুদ্র মন্থন করে যে অমৃত দেবতারা ভক্ষণ করেছেন সেই দেবতারা যদি শীতের ভোরে রসের পিঠা ভক্ষণ করতেন নিশ্চিত রসের পিঠার জন্য অসুরদের পুনরায় বধ করতেন। শীতের ভোরে রসের পিঠার চেয়ে মজাদার অমৃত অন্য কিছু হতে পারে না।
আমি রসের পিঠা খাচ্ছি আর কান পেতে বড় ভাইয়ের কবিতা আবৃত্তি শুনছি, হঠাৎ আমার কান্না পেয়ে গেল। বিবাগী লোকটার জন্য মনটা হাহাকার করে উঠলো। আমি শীতের ভোরে মজাদার রসের পিঠা খাচ্ছি আর অভাগা লোকটা পথে পথে কে একজনের জন্য ঘুরে মরছে। আমার ইচ্ছে করছিল এই অভাগা লোককে এক বাটি রসের পিঠা খাইয়ে তারেক কষ্টের কিছুটা উপশম করে দেই। রসের অমৃত কিছুক্ষণের জন্য তাকে দুঃখ ভুলিয়ে দিক।
অন্য আরেকদিন গৃহশিক্ষক আমাকে ‘আলস্য দোষের আকর’ ব্যাখ্যা করে বুঝাচ্ছেন। আমি মোটেও অলস নই, যদিও ঘুম থেকে উঠতে কোন কোন দিন দেরী হয়ে যায়। আমার কানে স্যারের কিছু ঢুকছে না; যথারীতি কান পেতে রেখেছি পাশের রুমে বড় ভাইয়ের কবিতায়, তিনি আল মাহমুদের কবিতা এমন আবৃত্তি করে নিজেকে কবিতায় দীক্ষা দিচ্ছেন। তাঁর জীবনে মক্তবের আয়েশা আক্তার নিলুফার লতিফা পাপড়ি হয়ে দেখা দিচ্ছেন। তাঁর বিরহ প্রণয়ে বদলে যাচ্ছে। তিনি যখন পড়ছেন কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী/কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন/ পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ; কাকতালীয়ভাবে তখনই আমাদের কাজের ছেলে প্লেট ভর্তি করে তিলের পুলি পিঠা এনে টেবিলে রাখল। আমি দেখলাম পিঠার গর্ভবতী পেট থেকে তিল প্রায় ভূমিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে, তিলের সৌরভে সারা ঘর মৌ মৌ করছে।
কবিতার সাথে পিঠার সংযোগের কথা সেভাবে কখনো চিন্তা করা হয়নি। পিঠার সাথে কবিতা কিংবা কবিতার সাথে পিঠা যায় কিনা সেভাবে ভাবা হয়নি কিন্তু অতীতে ডুব মেরে দেখলাম খুব যায়। পিঠা কবিতার মত মোলায়েম হতে; কবিতাও হতে পারে পিঠার মত রসালো।
আগামী মাসের ষোল তারিখ রবিবার পিঠা কবিতার মিলন হচ্ছে। নন্দনের ছাত্র কবিতার সাথে রসের রাজকন্যা পিঠার মিলন হলে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। যারা এমন মিলন দেখতে উৎসুক; তারা অবশ্যই আসতে পারেন।
আবু মকসুদ: কবি, প্রাবন্ধিক।