করোনা আতঙ্ক দেশে দেশে : বিভীষিকাময় সময়ের উপাখ্যান – প্রফেসর অহিদুর রব
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৩৫:৪২,অপরাহ্ন ১৪ আগস্ট ২০২১ | সংবাদটি ২৮৪৬ বার পঠিত
প্রফেসর অহিদুর রব::
‘করোনা’ একটি ভাইরাসের নাম। করোনা শব্দটির মধ্যেই নিহিত স্বতন্ত্র তাৎপর্য। ‘করোনা’ শব্দটিকে যদি আলাদা করে লেখা হয়, তবে লিখতে হয় ‘করো না’। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব, বিশ্বব্যাপী এর ধ্বংসলীলার দৃশ্যে তাকালে বলতে হয় ‘আমাকে আক্রান্ত করো না’। কিন্তু না, করোনা অল্প সংখ্যক মানুষকে ছাড় দিলেও বেশির ভাগ মানুষকে ছাড় দেয়নি, ছেড়ে দেয়নি। অনন্তের দিকে টেনে নিয়েই তৃপ্ত হয়েছে করোনামন। একেবারে যে তৃপ্ত হয়েছে, এমনটা নয়, বরং এর বিশ্বব্যাপী তাণ্ডবলীলা এখনও চলমান। এ পর্যন্ত করোনা বিশ্বে কয়েক লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। এখনো কয়েক কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। প্রতিনিয়তই পত্র-পত্রিকায় এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের সুবাদে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুসংবাদ চোখের সামনে ভাসছে। তা দেখে রীতিমতো চোখ ভড়কে যায়, জীবনের স্বাভাবিক গতিপথ সম্পর্কে সন্দিহান হতে হয়। করোনা কি হুট করে জীবন কেড়ে নেয়, এই চিন্তায় মানুষ অস্থির সময় পার করছে। এই করোনা শুধুমাত্র মানুষকে পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্ন করেছে এমনটা নয়, বরং পৃথিবীতে বেঁচে থাকা মানুষগুলোকেও আলাদা করে দিয়েছে। করোনা-ই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে কে আপন কে পর। করোনাকালীন সময়ে মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি ঘটে গেছে নানা বৈচিত্র্যময় ঘটনা। ভয়াবহ ও দুর্দিনে মানুষ যখন মানুষের নির্মমতা, তেমনই দেখেছে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, মমত্ববোধ এবং মানবিকতা। এ জন্য করোনা শুধুমাত্র হারানোর নয়, বরং এর মধ্যেও রয়েছে আত্মোপলব্ধির সারনির্যাস। এই আত্মোপলব্ধিকে অবলম্বন করে কেউ জীবনকে বুঝে নিয়েছেন, প্রকৃত উদ্দেশ্যের পথে নিজেকে পরিচালিত করছেন। অপরদিকে, কেউ বা ভোগবাদী চেতনায় দখলদারিত্ব ভেবে দুই দিনের দুনিয়াকে উপভোগের নেশায় মত্ত হয়েছেন। এ জন্য করোনা শুধু দুঃসময়ের ভয়াল চিত্র, বরং এর অপরপৃষ্ঠে রয়েছে মানবতার স্বরূপ। সাংবাদিক ও গবেষক আনোয়ার শাহজাহান রচিত ‘করোনা আতঙ্ক দেশে দেশে’ গ্রন্থটিতে দুটি প্রান্তিক চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক ও সাংবাদিক আনোয়ার শাহজাহান রচিত ‘করোনা আতঙ্ক দেশে দেশে’ গ্রন্থটি চলমান ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। গ্রন্থটিতে করোনার প্রাথমিক পর্যায়ে ঘটিত বিভিন্ন ঘটনাবলিসহ অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ তথ্য স্থান পেয়েছে। কিন্তু বস্তুনিষ্টতার বিবেচনায়, এই গ্রন্থটির বিষয়বস্তু একই মূলের দিকে ধাবিত করেছে যা গ্রন্থের সার্থকতাকে অনিবার্য করে তুলেছে। এই গ্রন্থের আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছেÑকরোনাকালীন সময়ে লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিরুচি। গবেষক আনোয়ার শাহজাহান ওই দৃষ্টিকোণ থেকেই করোনার সূচনাকাল এবং তৎপরর্তী দুই মাসের দিনলিপি সততার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় :
‘বিপদে মোরে রক্ষা করো / এ নহে মোর প্রার্থনা / বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’
অথবা
‘দুঃখ যদি দাও হে প্রভু/ শক্তি দিও সহিবারে।’
এই কবিতাংশের আবেদনের মতোই বিশ্ববাসীর প্রার্থনা সেই করোনাকেই ঘিরে। মূলত চীন থেকে সর্বপ্রথম ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসটি পুরো বিশ্বব্যবস্থাকেই এমনভাবে নাড়িয়ে তুলেছে যে, মানুষ এর আগে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। করোনার মহা বিপদ থেকে মুক্তির আবেদনকে উপেক্ষা করে বিশ্বসমাজে শুরু হয়েছে মানবপ্রস্থানের একটি মহা আয়োজন। গবেষক আনোয়ার শাহজাহান নিজের মননশীল ও অনুসন্ধিৎসু মনোভাব দিয়ে পুরো করোনা বিশ্বকে গ্রন্থের পরতে পরতে এঁকেছেন। সামগ্রিক দিক বিচারে তিনি করোনার যুদ্ধের এক আপোসহীন সৈনিক। যিনি নিজেও এই করোনার সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন।
আনোয়ার শাহজাহানের এই গ্রন্থে মানবপ্রাচীরের দিকটি বেশ প্রচ্ছন্ন ছায়ায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে। কারণ, করোনাকালীন সময়ে একপাশে যেমন মানুষের কাছ থেকে মানবতাবোধের বিচ্ছেদ ঘটেছে, অপরদিকে মানুষের সঙ্গে মানবিকতাবোধের এক গভীর প্রান্তিক মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়েছে বৈশ্বিক বাস্তবতায়। এর সঙ্গেও যোগ হয়েছে হার্দিক উপলব্ধি। সাংবাদিক আনোয়ার শাহজাহানের কলম এই গভীরের বিষয়টিকেও প্রচ্ছন্ন আলোর নিচে পড়ে থাকতে দেয়নি। এখানেই ‘করোনা আতঙ্ক দেশে দেশে’ গ্রন্থের মৌলিকত্ব। শুধু তাই নয়, এই গ্রন্থটির মাধ্যমে গবেষক আনোয়ার শাহজাহান যেন করোনাকালীন ইতিহাসের এক নির্মোহ কলমসৈনিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন।
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার প্রথম লিখিত ইতিহাস গ্রন্থ ‘গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা’, ‘সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ’, সহ মুক্তিযুদ্ধ ও আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা ৮। আলোচ্য ‘করোনা আতঙ্ক দেশে দেশে’ গ্রন্থটি তার নবম গ্রন্থ। এই গ্রন্থটির মাধ্যমে তিনি সমসাময়িক আলোচনার একটি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন। এটা কখনো অত্যুক্তি নয়, বরং তাঁর কর্মের যথোযুক্ত মূল্যায়ন। কারণ, তাঁর এই গ্রন্থের পরতে পরতে বিশ্বের সমকালীন সমাজের নৈমিত্তিক সংগ্রামচিত্র নীয়ন আলোয় স্পষ্ট হয়েছে। সামগ্রিক ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, এর বিপরীতেও মানুষ যে সংগ্রামের সঙ্গে টিকে আছে, এটাকে অনিবার্য করে তুলেছে লেখকের দরদি দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ, করোনার আক্রমণে অসংখ্য অগণিত মানুষের যাতনার মৃত্যুতে জীবিত মানুষের অন্তরে যে রেখাপাত করে, আনোয়ার শাহজাহানের এই গ্রন্থের অনেকগুলো নিবন্ধে এটা প্রতিভাত হয়েছে। এখানেই ‘করোনা আতঙ্ক দেশে দেশে’ গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে আলোর দীপশিখা।
সাংবাদিক আনোয়ার শাহজাহান এই গ্রন্থে ফিচার ও প্রতিবেদন আকারে করোনাকালীন বিশ্বের বিভিন্ন অবস্থাকে অত্যন্ত তথ্য ও তত্ত¡সহকারে সন্নিবেশিত করেছেন। এই তথ্য ও তত্ত¡গুলো ইতিহাসে অনন্য দলিল হয়ে থাকবে। তার প্রতিটি লেখার মধ্যে অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। অনেক আকর্ষণীয় বিষয়ও স্থান দিয়েছেন গ্রন্থটিতে। বিশেষ করে এই গ্রন্থের কয়েকটি ফিচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, ব্যক্তির উপলব্ধির জন্য এর পর্যালোচনা অত্যাবশ্যক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলোÑএকাকিত্বই বড় আতঙ্ক, প্রবাসীরাও স্বপ্ন দেখেন, মানবতার বিরুদ্ধে মানুষের অবস্থান, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সুর, থেমে নেই প্রবাসীদের মানবতা, যুক্তরাজ্যে মানবতার নজির সৃষ্টি করলেন আনোয়ার মুরাদ, গরিবের চাল আত্মসাৎকারী, গরিবের ডাক্তার মঈনের মৃত্যু, মানুষ হয়ে যেন মরতে পারি, ইতিহাসের মহানায়ক ক্যাপ্টেন টম মুর, একটি জানাজা এবং অনেক প্রশ্ন, বাংলাদেশি এক অভিবাসীর, ইসলামোফোবিয়া, নিশ্চয় আল্লাহ শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী, শতবর্ষী দবির চৌধুরী আমাদের অনুপ্রেরণা ইত্যাদি ফিচারগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচনার দাবি রাখে। এছাড়া এই গ্রন্থের প্রতিটি নিবন্ধই সে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে যা নির্ভুল ও বস্তুনিষ্ঠ। কারণ, সাংবাদিক আনোয়ার শাহজাহানের কলমে নিরীক্ষার প্রভাব ফেলেছে তাঁর মননচিন্তা। এর ফলে তিনি সেই সত্যকেই তুলে ধরেছেন যা পুরো বিশ্বব্যবস্থাকে হতবাক করেছে। পাশাপাশি বেদনায় ও মূহ্যমান করে তুলেছে সময়।
এই গ্রন্থের অনন্য বিশেষত্ব হচ্ছেÑলেখক নিজেও তার পরিবারসহ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যুর অত্যন্ত কাছাকাছি গিয়েছিল তাদের সময়। প্রতিনিয়ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় সময় কাটিয়েছেন। এমন সংকটময় মুহূর্তেও লেখক দেশ-বিদেশের আত্মীয়স্বজনদের খবর নিয়েছেন। এখানে তার মানবিকার পরিচয় লক্ষ করা যায়। বিশ্ব মিডিয়ার খবরও তিনি রেখেছেন। আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থেকেছেন। তাঁরই সাহায্য কামনা করেছেন। একই সাথে করোনা ভাইরাস নিয়ে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা এবং সারা বিশে^র প্রতিদিনকার আপডেট গ্রন্থ আকারে লিপিবদ্ধ করেছেন। এই কারণে গ্রন্থটি অত্যন্ত গুরুত্বের দাবিদার। সারা বিশে^ কোথায় কতজন আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন, তা তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর এ গ্রন্থে। একজন নিষ্ঠাবান ও পরিশ্রমী গবেষকের দৃষ্টিতে তিনি করোনা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ছবির মতো তুলে এনেছেন বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনযাত্রার চিত্র। এছাড়া গবেষক আনোয়ার শাহজাহান তাঁর গ্রন্থে যেমনই চলমান ঘটনাকে বিশ্লেষণ করেছেন, অন্যদিকে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেছেন পাঠকের জন্য। তার অত্যন্ত প্রখর পর্যবেক্ষণী দৃষ্টি দিয়ে সমাজবাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। সমস্যা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় উপদেশও দিয়েছেন।
একবিংশ শতাব্দীতে সমগ্র বিশ্বের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে যে করোনার আবির্ভাব, সেই মহামারীকে নিয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিক হবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। এর সঙ্গে আনোয়ার শাহজাহানের এই গ্রন্থটিও প্রাসঙ্গিক আলোচনায় ঋদ্ধ হবে বলে আমার বিশ্বাস। যে বিশ্বাস, মমত্ববোধ এবং দায়বোধ নিয়ে ‘করোনা আতঙ্ক দেশে দেশে’ গ্রন্থটি রচিত হয়েছে এটার মূল্যায়ন ইতিহাস করবেই নিঃসন্দেহে। নির্ভুল তথ্য ও তত্তে¡র জন্য এই গ্রন্থটি ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে হবে রহস্যময় এবং গ্রহণযোগ্য। আমি গ্রন্থকারের সার্বিক সুস্থতা এবং গ্রন্থের বহুল প্রচার কামনা করছি।
।।
লেখক : রাষ্ট্রচিন্তক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক, প্রফেসর, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, এম.সি কলেজ, সিলেট।