রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে আমার স্মৃতি কথা মো.বদর উদ্দিন আহমদ (টুনু মিয়া)
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৫৮:৩৯,অপরাহ্ন ১৫ অক্টোবর ২০২০ | সংবাদটি ১০৫৬ বার পঠিত
বদর উদ্দিন আহমদ(টুনু মিয়া): আমি বি.কম পরীক্ষা দিয়ে বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে আমাদের পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরার চেষ্টা করছি।তারিখ ঠিক মনে নেই তবে ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি সময়।যতটুকু মনে পড়ে তখন সকাল প্রায় এগারোটা হবে।আমি গোলাপগঞ্জ বাজারস্থ আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্টান `আয়শা ষ্টোরে’বসে আছি।এমন সময় চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব রিয়াজ উদ্দীন ও জনাব আব্দুল ওদুদ(টেইলার)এসে আমার কাছে এক ধরণের দাবি খাটিয়ে বললেন” আপনাকে নতুন স্কুলে শিক্ষকতা করতে হবে”।
তাদের এ ধরনের প্রস্তাবে কিছুটা দ্বন্দ্বে পড়লাম।কেন না ইত:পূর্বে শিক্ষকতা করি নাই।দ্বিতীয়ত তখনও একজন নবিশ ব্যবসায়ী।অধিকন্তু হাতে এতো সময়ইবা কোথায়?পক্ষান্তরে,এলাকায় নতুন স্কুল স্থাপিত হয়েছে।বেতন দিয়ে শিক্ষক চালাতে গেলে অনেক টাকার প্রয়োজন অথচ এই শিশু স্কুলের পক্ষে এ মুহূর্তে তা সম্ভব নয়।তাই কোন চিন্তা ভাবনা না করে উত্তর দিলাম,”ইনশাল্লাহ,আগামীকাল থেকে আমি স্কুলে ক্লাস নেবো”।উনারা খুশি হয়ে চলে গেলেন,কিন্তু আমার জন্য সৃষ্টি করলেন নতুন এক চিন্তার জগত।অর্থাৎ কীভাবে পাঠদান করতে হবে?কীভাবে সময় ম্যানেজ করতে হবে ইত্যাদি।রাতে বাড়িতে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে মাতাপিতা ও বড় ভাইয়ের সাথে আলাপ করলাম,উনাদের পরামর্শ চাইলাম।তারা বিনা বাক্য ব্যয়ে আমাকে উৎসাহিত করলেন।
পরদিন সকাল দশটার দিকে স্কুলে গিয়ে হাজির হলাম।স্কুল বলতে তখন আজকের এই দৃষ্টি নন্দিত বিরাট টিনসেট আর দুতল বিশিষ্ট পাকা ভবনগুলো নয়।তখন নতুন স্কুলের প্রথম ৬ষ্ট শ্রেণী চালু হয়েছিলো,৭/৮ জনছাত্রছাত্রীকে নিয়ে সুরমা নদীর তীরবর্তী চৌঘরীরমুড়ে প্রাইমারী স্কুলের সম্মুখস্থ মসজিদের উত্তর পাশের দেয়াল ঘেঁষে খোলা আকাশের নীচে।ওখানে গিয়ে দেখি শিক্ষক বলতে জনাব ফারুক আহমদ(গোয়াসপুর),আছমান উদ্দীন(গোয়াসপুর),ও জনাব ছাদিক আহমদ(মোকামবাড়ি) বসে আছেন।আমি স্কুলে যাওয়ার পর উনারা আমাকে ক্লাস নেয়ার জন্য অনুরোধ জানালে আমি সানন্দে প্রস্তাবটি গ্রহণ করি।
তবে খোলা আকাশের নীচে আমাদেরকে খুব বেশী দিন থাকতে হয়নি।এভাবে কিছু দিন ক্লাস নেয়ার পর চৌঘরী গোয়াসপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব রিয়াজ উদ্দীন তাঁর স্কুলের একটি কক্ষে ৬ষ্ট শ্রেণীর ক্লাস করার এবং স্কুলের পুরনো ভবন ও আইডিএ কক্ষের মাঝখানে শিক্ষকদের বসার বা অফিসের জন্য স্থান করে দেন।আমরা আন্তরিকতার সাথে তা গ্রহণ করি।এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে কয়েক মাস ৬ষ্ট শ্রেণীর ক্লাস নেই।
ওদিকে কয়েকদিন ক্লাস চালিয়ে যাওয়ার পর একদিন আমি ফারুক ভাইকে বললাম,”এখনতো আমরা শুধু ৬ষ্ট শ্রেণী দিয়ে স্কুল চালাচ্ছি,সেই সাথে আরেকটি ক্লাস অর্থাৎ ৭ম শ্রেণী চালু করা যায় না?কারণ এতে আমরা স্কুলটিকে আরেকটি বছর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো”।ফারুক ভাই আমার কথায় খুবই উৎসাহ দেখালেন।কিন্তু পাশাপাশি প্রশ্ন করলেন ছাত্রছাত্রী পাবো কোথায়?একটি প্রতিষ্ঠিত স্কুলে এলাকার শিক্ষার্থীগন লেখাপড়া করছে।এ শিশু স্কুলে এদেরকে আনতে গেলে অভিভাবকরা কি সম্মত হবেন?আমি বললাম ছাত্রছাত্রীর ব্যবস্থা হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।যাই হোক আমরা ৭ম শ্রেণী খোলার জন্য পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম।আমি প্রথমেই সপ্তম শ্রেণীর পাঁচ জন ছাত্রছাত্রী খুঁজে বের করলাম।এরা হলেন সম্পর্কে আমার মামাতো ভাইবোন।অর্থাৎ দাড়িপাতন চাতলা নিবাসি আবুল হোসেন,নজমুল হোসেন,শেফা বেগম,আয়শা বেগম ও বাবলী বেগম(তখন বিলাত থেকে ছুটি কাটাতে দেশে এসেছে)।তাই মামার বাড়িতে গিয়ে মামী মিসেস মনির উদ্দীনকে অনুরোধ জানালাম তাঁর মেয়ে শেফা বেগমকে নতুন স্কুলে নিয়ে আসার জন্য।তিনি অবাক হয়ে বল্লেন,”সে তো এমসি অ্যাকাডেমিতে পড়ছে”।আমি তাকে বিষয়টি ভালভাবে বুঝিয়ে বল্লাম এবং জানালাম আমি নিজে গিয়ে তার ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে আসবো।শুধু তাঁর অনুমতিটা চাই।তিনি অনুমতি দিয়ে বল্লেন,তুমি ভালো মনে করলে নিয়ে যাও।মামীর কথায় মনটা ভরে গেলো।এভাবে সেদিন অন্যান্য মামীগন অর্থাৎ আয়শা বেগমের মা ও আবুল হোসেনের মায়ের সাথে আলাপ করে একইভাবে আশ্বাস পেলাম।এভাবে শেফা বেগম,আয়েশা বেগম,বাবলী বেগম,আবুল হোসেন ও নজমুল হোসেন এ পাঁচ জনকে সংগ্রহ করা গেলো।পরের দিন স্কুলে গিয়ে ৭ম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী সংগ্রহের খবরটি সবাইকে জানাতে সকলে খুব খুশী হোন।তখন ৭ম শ্রেণী চালু করতে আর কোনও অসুবিধা থাকলোনা।ফারুক আহমদ বল্লেন,চলো এমসি অ্যাকাডেমিতে গিয়ে প্রধান শিক্ষক জনাব মছরুছুল করিম চৌধুরী স্যারের সাথে আলাপ করি।আমি ও ফারুক আহমদ স্যারের সাথে আলাপ করতেই তিনি ভর্তি রেজিস্টার বের করে দিয়ে বল্লেন,”তোমরা তোমাদের এলাকার যত ছাত্রছাত্রী আছে দেখে নিয়ে যাও”।
আমি ও ফারুক আহমদ খাতা দেখে দেখে ছাত্রছাত্রীদের নাম লিখে,ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে আসলাম।আর এভাবেই চালু হয় ৭ম শ্রেণী।স্কুলটি আরম্ভ হওয়ায় এলাকার স্থানীয় এবং প্রবাসীদের মধ্যে দারুন উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা দেয়।যার ফলশ্রুতিতে স্কুলের জন্য প্রথম জমি দান করেন জনাব মাওলানা আব্দুল হক ও লন্ডন প্রবাসী জনাব আব্দুল খালিক(মরহুম)।এছাড়া স্কুলের জন্য রড়,সিমেন্ট,বালু,পাথর ইত্যাদি বিভিন্ন জনে দান করেন।তাদের নাম এই স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়।তবে অনেকের আর্থিক দান,শ্রম ও সাহায্য সহযোগীতার মাধ্যমেই স্কুলটি তিলে তিলে বর্তমান দৃষ্টি নন্দন রুপ লাভ করে।
যাই হোক,দু বছর পর আমাকে স্কুলে শিক্ষকতা ছেড়ে দিতে হয়।কারণ তখন আমার একমাত্র বড়ো ভাই জনাব খয়ের উদ্দীন(চুনু মিয়া)স্কুল পরিচালনা কমিটির সহ সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় (১৯৮৭ইং থেকে ২১ফেব্রুয়ারী ২০০৬ইং এই স্মৃতি কথা লেখা পর্যন্ত)এবং স্কুলগৃহ নির্মান ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকায় আমাদের ব্যবসা পরিচালনায় শূণ্যতা দেখা দিলে আমি আবার ব্যবসাতে ফিরে যাই।সেই সাথে শেষ হয়ে যায় নেশার টানে এসে শিক্ষকতার সেই স্বর্ণালী দিনগুলি।
পরিশেষে বলতে চাই যে,যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্টানের শুরুতে বিভিন্ন জনের মানসিক,শারীরিক ও আর্থিক পরিশ্রমের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সফলতার উচ্চ শিখরে পৌঁছে।এ সফলতার বর্ণনা করতে গেলে একেক জনের স্মৃতি এক এক রকম হতে পারে এবং এটাই স্বাভাবিক।আমি রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে ছেড়ে চলে আসা সময় কাল পর্যন্ত আমার স্মৃতি কথা তোলে ধরতে চেষ্টা করলাম।
মো বদর উদ্দিন আহমদ(টুনু মিয়া),প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক।রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়।