মাহে রমযান: রোযার আবশ্যকতা ও মানবদেহে তার প্রভাব
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:৫০:১৯,অপরাহ্ন ২৯ এপ্রিল ২০২০ | সংবাদটি ৫২৮ বার পঠিত
|| শেখ খালিদ সাইফুল্লাহ ||
সকল প্রশংসা মহান রাব্বে কারীমের যিনি আখেরি নবীর উম্মতদেরকে সুযোগ করে দিয়েছেন অধিকহারে পুণ্য কামাইয়ের ৷ রেখেছেন বারো মাসে এমন একটি মাস (شهر رمضان) অর্থাৎ মাহে রমযান, যাতে বান্দা পুরো বছরের জানা অজানা ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে কম আমলে কামাই করতে পারে অনেক পুণ্য, করতে পারে দেহের পরিচর্যা ও পেতে পারে মনের প্রশান্তি৷ দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর, যার উসিলায় আমরা পেয়েছি বিশেষ পদ্ধতির এ ইবাদত, যা পালনে প্রবৃত্তির দমন ও কল্যাণের সাধন হয় ৷ অতঃপর সালাম বর্ষিত হোক সত্যের দিশারী সাহাবায়ে কেরামদের উপর, যাদের চেষ্টার বদৌলতে এ পর্যন্ত পৌঁছেছে নবীর শিখানো রোযার সঠিক পালন-পদ্ধতি ৷
প্রিয় পাঠক!
প্রথমে “রোযা” সম্পর্কে সম্যক ধারণা-
রোযা একটি ফার্সী শব্দ, তার আরবী প্রতিশব্দ হলো সাওম (صوم)৷ যার অাভিধানিক অর্থ হচ্ছে (সাধারণত) বিরত থাকা,পরিহার করা, উপবাস থাকা ইত্যাদি ৷
শরিয়তের পরিভাষায় নিয়ত সহকারে দিনের বেলা (সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত) পানাহার পরিহার করে স্ত্রী সহবাস করা থেকে বিরত থাকার নাম হলো সাওম বা রোযা ৷
কেউ কেউ বলেন রোযা বা সাওমের মূল হলো –
الإمساك عن شهوتي البطن و الفرج.
অর্থাৎ রোযার মূল হলো পেট ও লজ্জাস্থানের লালসা বা কামনা থেকে বিরত থাকা ৷
রোজা পালন আল্লাহ প্রদত্ত একটি হুকুম যা আমলে আনা প্রত্যেক সুস্থ জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমানের উপর আবশ্যক (ফরয) ৷ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ.
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর (রমযানের) রোযা ফরয করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের উপর ফরয করা হয়েছিল। যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৩
আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাহদের উপর নিছক কষ্ট দেয়ার জন্যে রোযা ফরয করেননি। তিনি এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন,
ﺃَﻥْ ﺗَﺼُﻮﻣُﻮﺍ ﺧَﻴْﺮٌ ﻟَﻜُﻢْ إن كنتم تعلمون
অর্থাৎ তোমরা যদি রোযা রাখো তবে তাতে রয়েছে তোমাদের জন্য কল্যাণ, তোমরা যদি সেটা উপলব্ধি করতে পারো। (সূরা বাকারাহ-১৮৪)।
বস্তুত এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রোযা পালনের নানাবিধ কল্যাণের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। ইহা এমন একটি ইবাদত যার প্রচলন ছিলো সর্বযুগে ৷ এবং তা রাখার ধরনও ছিল ভিন্ন প্রকৃতির ৷ আমাদের রাখা রোযার নিয়মটি হলো শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের এক বিশেষ বৈশিষ্ট ৷
রোযা মানবাত্মার পবিত্রতা ও চিন্তাশক্তির বৃদ্ধি করে, তাই তো জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যুগযুগ থেকে সকল ধর্মযাজক মনি-ঋষিগণ উপবাস থাকতেন এবং সুফী-সাধকগণ রোজা রাখতেন৷ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ﺍﻟﺼَّﻮْﻡُ ﺟُﻨَّﺔٌ— অর্থাৎ: -রোযা ঢালস্বরূপ। ঢাল যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধাকে সার্বিক আঘাত থেকে রক্ষা করে, রোযাও তেমনি রোযাদারকে শারীরিক ও মানসিক ব্যাধি থেকে রক্ষা করে।
স্বাস্থ্য বিজ্ঞানেও এর বিশেষ উপকারিতা স্বীকৃত ৷ ডা. সালোমন তার স্বাস্থ্যবিধিতে মানবদেহকে ইঞ্জিনের সাথে তুলনা করে বলেন,যেমনটা একটি ইঞ্জিন রক্ষাকল্পে মাঝে মাঝে ডকে অথবা ওয়ার্কশপে নিয়ে সার্ভিসিং করতে হয় যাতে করে ইঞ্জিনে লেগে থাকা ছাই, গাদ, জ্বলিত আঙ্গারা নতুনরূপে নিষ্কাশিত করা আবশ্যক তেমনি উপবাস বা রোজা দ্বারা মানব পাকস্থলীতে থাকা অজীর্ণ খাদ্যটি সময়সাপেক্ষ নিষ্কাশিত বা পরিষ্কার করা দরকার ৷
সর্বোপরি একটি বিষয় জানা থাকা দরকার। তা হলো এই যে, আল্লাহ তাআলা হলেন মহান স্রষ্টা ও মহা মুনিব আর মানুষ হল তাঁর ক্ষুদ্র সৃষ্টি ও দাস। এক্ষেত্রে উভয়ের মাঝে সম্পর্কের দাবি হল, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রতিপালক মুনিব যে নির্দেশ দিবেন, মানুষ সর্বদা প্রস্তুত থাকবে তা পালনের জন্য। ঐ নির্দেশের তাৎপর্য বুঝে আসুক বা না আসুক৷ যেমনটি হয়ে থাকে দুনিয়ার জগতে- মুনিব বা মাওলার নির্দেশ একজন গোলামের জন্য আমলে পরিণত করা অত্যাবশ্যক, চাই কাজটি তার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ হোক অথবা না-ই হোক৷ সুতরাং মহান আল্লাহ তাআলা যেসব ইবাদতের নির্দেশ দিবেন, সেগুলোর কোনো কারণ বা তাৎপর্য জানা না থাকলেও তৎক্ষণাৎ নতশিরে তা মেনে নেওয়াই হচ্ছে বান্দার দায়িত্ব। বলাবাহুল্য, শরীয়ত নির্দেশিত কোনো ইবাদতই তাৎপর্যহীন বা যুক্তিবিরোধী নয়। তবে সব কিছুর যুক্তি বা হেকমতই যে বান্দার জানা থাকবে বা বান্দার জ্ঞান-বুদ্ধি তাকে স্পর্শ করতে পারবে এমনটি ভাবা ঠিক নয়। কারণ আল্লাহ তাআলা বান্দাকে অতি সামান্য জ্ঞানই দান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَ مَاۤ اُوْتِیْتُمْ مِّنَ الْعِلْمِ اِلَّا قَلِیْلًا.
তোমাদেরকে অতি সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৮৫
আবশ্যকতার বিবেচনায় নিঃসন্দেহে রোজা মানবদেহে প্রভাব বিস্তার করে ৷
আল্লাহ তাআলা মানুষকে পানাহার করার ও যৌনক্ষুধা মিটানোর যে সমস্ত সামগ্রী দান করেছেন তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করার জন্য তাঁর নির্দেশে এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঐ সমস্ত কাজ-কর্ম থেকে বিরত থাকাও যুক্তিসংগত বিষয় ৷ কারণ বিষপানে যেমন একটি বাহ্যিক জীবনের অবসান হয় তেমনি প্রবৃত্তির তাড়নায় পাপানুষ্ঠানেও মানবতার মৃত্যু ঘটে, আর প্রবৃত্তির তাড়না সৃষ্টি হয় তখনই, যখন একটি প্রাণ খেয়ে-দেয়ে পরিতৃপ্তি হাসিল করে৷ এবং অবশেষে মনোবাসনা পূর্ণে সামর্থবান হয়ে নীড় বাধার জন্য উৎসুক হয়ে পড়ে ৷ এতে বাধাপ্রাপ্ত হলে পাপকাজে লিপ্ত হওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকে না ৷ অন্যথায় প্রবৃত্তির সঞ্চালকগুলো থেকে বিরত থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ ৷ সেক্ষেত্রে নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিকিৎসাস্বরূপ বলে দিয়েছেন –
فإن له وجاء اي فإن الصوم له وجاء.
অর্থাৎ রোজা হলো (তার) প্রবৃত্তির দমনকারী ৷
কিছু অজ্ঞ শ্রেণীর লোক ধারণা করে যে, রোযা রেখে সারাদিন উপবাস থাকলে শরীর অতিকায় ক্ষীণ ও জীবনীশক্তি দুর্বল হয়ে যায় এবং বিভিন্ন রোগ মানুষকে আক্রমণ করে। ঘনঘন খাদ্য গ্রহণ করলে স্বাস্থ্য অটুট ও সবল থাকার ধারণাও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে নিতান্ত ভুল ও অবান্তর বলে প্রমাণিত। চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. হেপোক্রেটিস বহু শতাব্দী পূর্বে বলেছেন,-
‘The more you nourish a diseased body the worse you make it.’
অর্থাৎ, ‘অসুস্থ দেহে যতই খাবার দিবে, ততই রোগ বাড়তে থাকবে।’ এ কথায় বলা যায় মাঝে মাঝে দেহকে খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে হবে। কেননা, সমস্ত দেহে সারা বছর যে জৈব বিষ (Toxin) জমা হয়, দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার ফলে সে জৈব বিষ দূরীভূত হয়।এটি স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ উপকারী। কায়রো থেকে প্রকাশিত Science calls For fasting গ্রন্থে পাওয়া যায়,পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন,- The power and endurance of the body under fasting Conditions are remarkable; After a fast properly taken the body is literally born afresh. অর্থাৎ “রোযা রাখা অবস্থায় শরীরের ক্ষমতা ও সহ্যশক্তি উল্লেখযোগ্য: সঠিকভাবে রোযা পালনের পর শরীর প্রকৃতপক্ষে নতুন সজীবতা লাভ করে।” একমাস রোযা রাখার ফলে আমাদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গে বা রক্ত ও রাসায়নিক পদার্থের যে সম্ভাব্য প্রভাব পড়তে পারে যা রোযা না রাখলেও পড়ে থাকে।চিকিৎসাবিজ্ঞানী ম্যাক ফ্যাডেন বলেছেন- সিয়াম সাধনা করলে বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ সাধিত হয়। “The longer one fasts the greater becomes his intellectual power and the clearer his intellectual vision.”
গত ১৯৫৮ ও ১৯৬০ সালে আমাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জনাব গোলাম মোআজ্জেম কর্তৃক “মানব শরীরে রোযার প্রভাব” সম্পর্কে গবেষণা চালানো হয় ৷এতে প্রমাণিত হয় যে,রোযা দ্বারা মানব শরীরের তেমন কোন ক্ষতি হয় না৷ কেবল সামান্য ওজন কমে ৷ তাও উল্লেখযোগ্য কিছুই নয় ৷ বরং শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমাতে মাঝে মধ্যে এরূপ রোযা রাখাটা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ (diet control) অপেক্ষা অধিক শ্রেয় ৷
এছাড়া যারা মনে করেন রোযা দ্বারা পেটের শুল-বেদনা বৃদ্ধি হয় তাদের এ ধারণাও নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক ৷ কারণ উপবাসে পাকস্থলীর এসিড কমে এবং খেলেই তা বাড়ে এ কথাটা অনেক চিকিৎসকই চিন্তা না করে শুল-বেদনার রোগীকে রোযা রাখতে নিষেধ করেন ৷ তখনকার প্রায় ১৭ জন রোযাদারের পেটের রস পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে,যাদের পাকস্থলীতে খুব বেশি এসিড করন হতো অথবা যাদের একেবারে কম হতো রোযা রাখার ফলে তাদের এই উভয় দোষই সেরে গেছে ৷ অপর এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়, যারা মনে করেন যে,রোযার দ্বারা রক্তের ‘পটাসিয়াম’ কমে যায় এবং শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয় তাদের এ ধারণাও অমূলক ৷ কারণ পটাসিয়াম কমার প্রক্রিয়া প্রথমে পরিলক্ষিত হয় হৃৎপিণ্ডের ওপর, অথচ ১১ জন রোযাদারের হৃৎপিণ্ডে অত্যাধুনিক Electrocardiogram বা ECG যন্ত্রের সাহায্যে (রোযা রাখার পূর্ব ও পর) পরীক্ষা করে দেখা যায় যে,এর কারণে হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়ার কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি ৷ এতে যে সামান্য পরিমাণে কমে তা স্বাভাবিক সীমারেখার মধ্যেই গণ্য হয় ৷ আবার কখনো দেখা যায় রোযার দিন বিকেলে মেজাজটা একটু খিটখিটে, কাজে অনীহা ইত্যাদি যা সাধারণত সামান্য রক্ত-শর্করা কমার দরুনই, কখনো রক্তের পটাসিয়াম, গ্লোকোজ ও কোলেস্টেরল কমে গিয়ে এমনটি প্রকাশ পেয়ে থাকে। যা স্বাস্থের জন্য মোটেই ক্ষতিকর নয় ৷ তাতে সাস্থ্যহানিও হয় না ৷ রোযা ছাড়া যে কোন সময় ক্ষুদা পেলে এরূপ হয় ৷
ভারতের নেহেরু গান্ধী উপবাসে অভ্যস্থ ছিলেন। তিনি তার অনুসারীদেরকে বলতেন, “উপবাস বা রোযার মাধ্যমে আত্মসংযম বাড়ে এবং মানবাত্মা পবিত্রতা অর্জন করে।”
এক কথায় রোযা মানবদেহের উল্লেখযোগ্য কোন ক্ষতি সাধন করে না বরং দেহের নানাবিধ উপকারই করে যা অনেক সময় চিকিৎসা দ্বারা সম্ভব হয় না ৷ এ ছাড়াও রোযা সফরে থাকা মুসাফিরকে এবং যুদ্ধের ময়দানে থাকা সৈনিককে উপবাসের কষ্ট সহ্য করতে অভ্যস্ত করে তোলে, যা তাদের জন্য যেমনটা প্রয়োজন তেমনি দেশ ও জাতির মঙ্গলের কারণও বটে ৷ বিশেষ করে ভুগ-বিলাসিতায় ডুবে থাকা বিত্তশালীদেরকে অনাহারক্লিষ্ট হতদরিদ্রদের ক্ষুধা ও পিপাসার যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে সহায়তা করে৷
উপরন্তু রোযার মাধ্যমে মানুষ উদার ও প্রবৃত্তিরথ জৈবিক তাড়না হতে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে ঊর্ধ্বজগৎ তথা আপন স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগসূত্র স্থাপনে সক্ষম হয়।
সুতরাং রোযা পালন করা যেরূপ তাৎপর্যমণ্ডিত তেমনি মানবদেহে তার প্রভাবও সাস্থ্যসম্মত৷ আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝার তাওফীক দান করুন ৷ আমীন!!
লেখক: শিক্ষক, ঢাকাদক্ষিণ দারুল উলুম হুসাইনিয়া মাদরাসা, গোলাপগঞ্জ, সিলেট ৷