একটি জানাজা এবং অনেক প্রশ্নঃ রেখেছো বাঙ্গালী করে, মানুষ করোনি!
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:০০:৪৬,অপরাহ্ন ১৯ এপ্রিল ২০২০ | সংবাদটি ১০৪২ বার পঠিত
আনোয়ার শাহজাহানঃ
একঃ অবাক হইনি! কদিন আগেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জ্যান্ত একটা মানুষের পা কেটে উৎসব হয়েছিলো! গতকালও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লকডাউনে একজন মাওলানার জানাজায় লক্ষাধিক লোকের গণজমায়েত দেখে মনে হয়েছিল সত্যিই তো আমারা বাঙালী, মরেও আমাদের প্রমাণ করতে হবে আমরা বাঙালি।
শনিবার (১৮ এপ্রিল) ঘুম থেকে জেগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি সংবাদ এবং কিছু স্থিরচিত্র দেখে শুধু অবাক হইনি ঘাবড়েও গিয়েছিলাম। লকডাউন, শাটডাউনে এত লোক জড়ো হল কিভাবে?
১৭ এপ্রিল শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় জুবায়ের আহমদ আনসারী প্রতিষ্ঠিত জামিয়া রহমানিয়া বেড়তলা মাদরাসা প্রাঙ্গণে মাওলানা আনসারীর জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় কি সকলের উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল, প্রসাশন কি এটি প্রতিরোধের ক্ষমতা রাখেনি, এখানে কি কোন রাজনৈতিক মতলব আছে? অসংখ্য প্রশ্ন? কে জবাব দেবে।
জানাজার নামাজ পড়া ফরজ নয়। অংশগ্রহণ করতেই হবে কিনা এই বিষয়েও আমার জ্ঞান নেই। তবে যেখানে সারা বিশ্বে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া হচ্ছে না, মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র দুটো স্থান, মক্কা এবং মদিনায় অবস্থিত দুটো মসজিদের বাইরের চত্বরে নামাজ পড়া স্থগিত করেছে সৌদি সরকার। সেখানে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে জানাজার নামাজ পড়া কি খুবই জরুরি ছিল? করোনাকালে এই দুঃসময়ে কীভাবে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হল? কেন এরা ইচ্ছেকৃত ভাবে আগুনে ঝাঁপ দিতে চাইছে? এরকম অসংখ্য প্রশ্ন আজ সারাদেশে মানুষের মত আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
আল্লামা জুবায়ের আহমদ আনসারী আল্লাহর একজন ওলি ছিলেন। ইসলামি এই বক্তা সরাইলে জামিয়া রাহমানিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রচুর মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অসংখ্য ধার্মিক লোকেদের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু করোনার ভয়ে পুত্র পিতার লাশ নিচ্ছে না, করোনায় মৃতদের কবর দিতে বাঁধা দিচ্ছে গ্রামবাসী। সন্তানরা মাকে গভীর রাতে জঙ্গলে ফেলে আসছে সেখানে আনসারীর জানাজায় লক্ষ লোকের সমাগম কেন? করোনার আক্রমণ প্রতিরোধে যেখানে পিতা পুত্রের কিংবা পুত্র পিতার জানাজায় উপস্থিত হতে পারছে না সেখানে লক্ষাধিক লোকের সমাগম অবশ্যই বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এটা মোটেও উচিত হয়নি। এটি ছিল একটি হঠকারী এবং দেশদ্রোহী সিদান্ত।
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন তারাও সঠিক দায়িত্ব পালন করেননি। সামাজিক দূরত্বের নিয়ম লঙ্ঘন করে জানাজা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়লেও পুলিশ বলছে, বিষয়টি নিয়ে তাদের কিছুই করার ছিল না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু সাঈদ বলেন, ‘আমরা আলেমদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। বলেছিলাম লোক সমাগম যেন না হয়। তারপরও লোক সমাগম হয়েছে।’ বিষয়টি সেনসেটিভ, তাই আমরা শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারিনি।’
সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ.এস.এম মোসা বলেন, ‘আমরা জানাজার বিষয়টি অবগত ছিলাম। তবে এত মানুষ যে হবে আসলে ভাবিনি।’ আসলে কি তাই? যতসব আজগুবি কথা। তাও শুনতে হচ্ছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। এসব দেখার কি কেউ নেই।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বারবার নিষেধ করা হচ্ছে, অনুরোধ করা হচ্ছে। কিন্তু এই অনুরোধ, নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করছে না অনেকেই। ১১ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হলেও শনিবার এই বৃহৎ আকারের এই জানাজার কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সহ পুরো বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। জানাজায় অংশ নিয়ে আমরা বিবেককে কবর দিয়ে আবেগে কাজ করেছি। এখন আবেগ দেখানোর কোনো অবকাশ নেই, সারাবিশ্ব এখন থমকে গেছে। আমাদের বাঁচার জন্য নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বাড়ি থেকে দোয়া করলে কি দোয়া হবে না? প্রশাসনেরও এটি দেখা উচিত ছিল, দায়িত্ব ছিল।
দুইঃ
কিছুদিন আগেও আমরা গার্মেন্টস কর্মীদের
কাজে যোগ দিতে ঠাসাঠাসি করে কর্মস্থল ঢাকা অভিমুখে ছুটতে দেখেছি। সরকারী নিষেধাজ্ঞা না মেনে গার্মেন্টস মালিকরা পোশাককর্মীদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেছিলেন। ফলে সারা দেশ থেকে হাজার হাজার পোশাককর্মীরা রাজধানী ঢাকায় জড়ো হতে থাকেন। পণ্যবাহী খালি ট্রাক, পিকআপ, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাসহ নানা যানবাহনে ঢাকায় ফিরতে দেখা গেছে তাদের। সাভার, গাজীপুর, মাওয়াসহ ঢাকার প্রবেশদ্বারগুলোতে অনেককে কর্মস্থলের উদ্দেশে হাঁটতেও দেখা গেছে।ফেরিঘাট ও বিভিন্ন যানবাহনে গাদাগাদি করে ঢাকায় ফেরা এসব মানুষের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার মারাত্মক শঙ্কা ছিল। কর্মস্থল ও আবাসস্থলেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে না তাদের অনেকের পক্ষে। ফলে ব্যাপকসংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই গার্মেন্টস খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মালিকপক্ষ। মালিকদের এমন হঠকারী সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ছিল সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিকদের অনেকেই। গার্মেন্টস কারখানা খোলায় ক্ষুব্ধ শ্রমিকরাও। করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে লকডাউনের মধ্যে কিছু পোশাক কারখানা খোলার সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছিল দেশবাসী। কিন্তু গার্মেন্টস মালিকদের সেই সিদ্ধান্ত ছিল খুবই ভয়ঙ্কর, অন্যদিকে অমানবিকও বটে। কারণ, দেশজুড়ে কার্যত লকডাউন সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে ট্রাকের বা পিকআপের খোলা ছাদে করে, এমনকি হেঁটেও গ্রাম থেকে কর্মস্থলে ফিরতে হয়েছিল লাখ লাখ শ্রমিককে। শুধু তাই নয়, তারা কর্মস্থলে যোগ দিলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সম্ভব হবে না বিধায় যে কোনো সময় করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। এক্ষেত্রে তাদের ওপর যে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল তা খুবই অমানবিক।
অবশেষে ঢাকায় পোশাককর্মীদের নিয়ে গার্মেন্টস মালিকরা সিদ্ধান্ত নিলেন, আপাতত গার্মেন্টস বন্ধ রাখবেন। কি আজব তাদের সিদ্ধান্ত, আজব কারবার।
তিনঃ
করোনাভাইরাসের বিস্তার ব্যাপক, এটি এখন মহামারীতে পরিণত হচ্ছে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে বিস্তার লাভ করছে। স্থান, কাল, শত্রু মিত্র, ধর্ম ও বর্ণ কিছুই মানছে না। এ ভাইরাসের ছোবল থেকে গোটা বিশ্ব যে দ্রুত বাঁচবে তার কোনো নিশ্চয়তাও নেই। প্রতিদিন মৃত্যুর হিসাব গুনছে এই পৃথিবীর মানুষগুলো। কতজন সর্বশেষ নিষ্প্রাণ হলেন মৃত্যুর তালিকায় ‘সংখ্যা’রূপে। মানুষ এখন একটি ক্রমিক নম্বর মাত্র। যেন আমরা সবাই মৃত্যুর মিছিলে শামিল। করোনাভাইরাস ক্রমান্বয়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। লাখ লাখ মানুষ যেমন আক্রান্ত হচ্ছে তেমনি হাজার হাজার মানুষ মারাও যাচ্ছে। করোনা গোটা পৃথিবীতে মহামারি আকার ধারণ করলেও বাংলাদেশে এখনো সে পর্যায়ে যায়নি। তবুও আমাদের কোনো স্বস্তি নেই। আমরা বিপদমুক্ত নই। কেননা, বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু বাড়ছে। আমাদের অসচেতনতার কারণেই করোনা নিয়ে আমরা বিপদমুক্ত নই।
আনোয়ার শাহজাহান
১৮ এপ্রিল, লন্ডন।