ইসলামে লকডাউন ও হোম কোয়ারেন্টিনের ধারণা
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:৩৪:২০,অপরাহ্ন ১২ এপ্রিল ২০২০ | সংবাদটি ১৩৭২ বার পঠিত
।। এডভোকেট মাওলানা রশীদ আহমদ ।।
ইসলাম শাশ্বত, চিরন্তন ও চিরনবীন ধর্ম। ইসলামের প্রতিটি বিধান সব যুগের, সব দেশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। বর্তমান সময়ে লকডাউন, আইসোলেশন ও হোম কোয়ারেন্টিন বহুল আলোচিত শব্দ। অথচ অতীব বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সভ্য দুনিয়া সাম্প্রতিক সময়ে এসব শব্দের সঙ্গে পরিচিত হলেও শাশ্বত ধর্ম ইসলাম ১৫০০ বছর আগে এসব বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। পাশাপাশি মহামারির সময় করণীয় সম্পর্কেও ইসলামের সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। নিম্নে এসব বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা তুলে ধরা হলো—
সতর্কতামূলক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা : মানুষের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় ইসলাম গুরুত্ব প্রদান করে। এ কারণে আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা সতর্কতা অবলম্বন করো।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত : ৭১)
হাদিসে শারীরিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমার ওপর তোমার শরীরেরও অধিকার রয়েছে।’ (বুখারি, হাদিস : ১৯৬৮)
আতঙ্কিত না হয়ে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হওয়া : আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোনো বিপদই আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ যা আমাদের জন্য লিপিবদ্ধ করেছেন তা ছাড়া কোনো কিছুই আমাদের স্পর্শ করবে না; তিনিই আমাদের অভিভাবক। আল্লাহর ওপরই মুমিনদের নির্ভরশীল হওয়া উচিত।’ (সুরা আত-তাওবা, আয়াত : ৫১)
লকডাউন : যে এলাকা মহামারি আক্রান্ত হয় সে এলাকার প্রবেশ ও বাহির বন্ধ করে দেওয়ার নাম লকডাউন। পৃথিবীর কাছে লকডাউন সম্পর্কে সর্বপ্রথম থিউরি পেশ করেছেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যদি তোমরা শুনতে পাও কোনো জনপদে প্লেগ বা অনুরূপ মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তবে তোমরা তথায় গমন করবে না। আর তোমরা যে জনপদে অবস্থান করছ তথায় যদি তার প্রাদুর্ভাব ঘটে তবে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না। (বুখারি, হাদিস : ৫৩৯৬)
আইসোলেশন (Isolation) : মহামারি রোধে আক্রান্ত ব্যক্তিকে পৃথক রাখাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় আইসোলেশন বলা হয়। মহানবী (সা.) এ সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন, অসুস্থকে সুস্থের কাছে নেওয়া ঠিক হবে না। (বুখারি, হাদিস : ৫৭৭১ ও মুসলিম, হাদিস : ২২২১)
হোম কোয়ারেন্টিন (Quarantine) : সুস্থ ব্যক্তি মহামারিতে আক্রান্তের আশঙ্কায় জনবিচ্ছিন্ন থাকাকে কোয়ারেন্টিন বলা হয়। বিভিন্ন হাদিসে এভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন মহানবী (সা.) বলেন, কোনো বান্দা যদি মহামারি আক্রান্ত এলাকায় থাকে এবং নিজ বাড়িতে ধৈর্য সহকারে, সওয়াবের নিয়তে এ বিশ্বাস বুকে নিয়ে অবস্থান করে যে আল্লাহ তাকদিরে যা চূড়ান্ত রেখেছেন তার বাইরে কোনো কিছু তাকে আক্রান্ত করবে না, তাহলে তার জন্য রয়েছে শহীদের সমান সওয়াব। (বুখারি, হাদিস : ৩৪৭৪ ও মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৬১৩৯)
মুসাফাহা ও কোলাকুলি এড়িয়ে চলা : কেননা এর মাধ্যমে সংক্রমণের ভয় থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাকিফের প্রতিনিধিদলের মধ্যকার কুষ্ঠ রোগীকে হাতে হাতে বাইয়াত না দিয়ে লোক মারফত বলে পাঠান, ‘তুমি ফিরে যাও। আমি তোমার বাইআত নিয়ে নিয়েছি।’ (মুসলিম, হাদিস : ২২৩১)
সার্বিক পরিচ্ছন্ন থাকা : কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে মুমিনদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এক আয়াতে এসেছে, ‘আল্লাহ তাওবাকারী ও পবিত্রতা অবলম্বনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত : ২২২)
হাদিসে পবিত্রতাকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। শরিয়তের বিভিন্ন বিধানকে পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম নির্ধারণ করা হয়েছে : ওজুর মাধ্যমে মানুষের শরীরের অনাবৃত্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধৌত করা হয়; মেসওয়াকের মাধ্যমে মুখের সব ধরনের জীবাণু ধ্বংস হয়; সামগ্রিকভাবে সারাক্ষণ ও বিশেষত সালাতে পরিধেয় কাপড় পরিচ্ছন্ন থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমার কাপড় পরিষ্কার রাখো।’ (আল-মুদ্দাচ্ছির, আয়াত : ৪)
গুজবে কান না দেওয়া ও গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকা : ইসলামে যাচাই ছাড়া কোনো তথ্য গ্রহণ করা নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেন, ‘কোনো অসমর্থিত ব্যক্তি কোনো খবর দিলে তোমরা তা যাচাই করো।’ (সুরা আল-হুজুরাত, আয়াত : ৬)
এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যাচাই না করে শোনা খবর বিশ্বাস করা মিথ্যাবাদী হওয়ার নামান্তর।’ (মুসলিম, হাদিস : ৫)
ঘরে নামাজ আদায় করা : আপত্কালীন অবস্থায় মহানবী সা. সাহাবিদেরকে বাড়িতে নামাজ আদায়ের নির্দেশ দেন। তিনি মুয়াজ্জিনকে আজানের মধ্যে বলতে বলেন, ‘আলা সাল্লু ফি রিহালিকুম’ (তোমরা নিজ নিজ অবস্থানে নামাজ আদায় করো)। (বুখারি, হাদিস : ৬৬৬, মুসলিম, হাদিস : ৬৯৭)
তাঁর ইন্তিকালের পরে সাহাবিরাও একইভাবে আমল করতেন। সহিহ বুখারিতে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে এর প্রমাণ বর্ণিত হয়েছে যে তিনি মুয়াজ্জিনকে নির্দেশ দেন আজানে ‘সাল্লু ফি বুয়ুতিকুম’ (তোমরা বাড়িতে সালাত আদায় করো) অংশটি যোগ করার জন্য। (বুখারি, হাদিস : ৬৬৮, মুসলিম, হাদিস : ৬৯৯)। ইসলামী শরিয়ার উদ্দেশ্য ও মহামারির গতি-প্রকৃতি বিবেচনায় মিসর, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ফিকহ কমিটি ও ইসলামী ফাউন্ডেশন মসজিদে মুসল্লিদের উপস্থিতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসার পক্ষে মত দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সবাইকে ঘরে ইবাদত করার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এবং সর্বশেষ সাধারণ মুসল্লিদের ঘরে নামাজ আদায়ের সর্বাত্মক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গরিব-অসহায় ও নিম্ন আয়ের লোকদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসা : করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ঘোষিত লকডাউনের এ দিনগুলোতে গরিব-অসহায় ও নিম্ন আয়ের মানুষের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা বৃত্তবানদের ওপর আবশ্যক। এ মহৎ গুণের প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন, ‘খাদ্য দান কর দুর্ভিক্ষের দিনে এতিম আত্মীয়-স্বজনকে। অথবা নিঃস্ব মিসকিনকে।’ (সুরা আল-বালাদ, ১৪-১৬)
ভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা : ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলিম সরকার জনকল্যাণ বিবেচনায় কোনো নির্দেশনা দিলে এবং তা শরিয়াহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে তা মান্য করা অপরিহার্য। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রাসুলের ও তোমাদের নেতৃস্থানীয়দের।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত : ৫৯)
এ কঠিন সময়ে আমাদের উচিত বেশি বেশি (১) তাওবা, (২) ইস্তেগফার, (৩) নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, (৪) কোরআন তিলাওয়াত, (৫) শাবান মাসে বেশি বেশি করে তাসবীহ পাঠ করা , (৬) তাহাজ্জুদ নামাজ ও (৭) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর দরুদ পাঠ করা।
লেখক : গবেষক, ইসলামি স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট এমফিল পিএইচডিও – বহু গ্রন্থ প্রণেতা ও সাংবাদিক।