গোলাপগঞ্জ লিটল স্টার স্কুল প্রত্যাশা অনেক, চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:০৪:০৪,অপরাহ্ন ২৯ জানুয়ারি ২০১৭ | সংবাদটি ২২৪৫ বার পঠিত
গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর গ্রামের বাসিন্দা মাস্টার আব্দুল গণির একমাত্র পুত্র তাওহীদ আহমদ। ১৬ বছরের সন্তানটি জন্ম থেকেই বুদ্ধি ও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তার উপর গ্রামে এ ধরনের শিশুদের কোন প্রতিষ্ঠান না থাকায় বিপাকে পড়েন মাস্টার আব্দুল গণি। এক পর্যায়ে উপজেলা সদরে প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে সিলেট যুব একাডেমীর (এসজেএ) নামের একটি এনজিও স্কুল খুললে অনেক ভরসা পান তিনি। ৪-৫ বছর পর এসজেএর প্রকল্প মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন অভিভাবকদের অনুরোধে ২০১৫ সালে গোলাপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আশরাফুল আলম খান সেটি পুণরায় নাম পাল্টিয়ে উপজেলা পরিষদ আঙ্গিনায় ‘লিটল স্টার স্কুল’ নামে প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে শুধু আব্দুল গণি নন, ভরসা খুঁজে পান বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন অনেক শিশুর পিতা-মাতা ও অভিভাবকরা। আর এখন এটি গোলাপগঞ্জের নয় আশপাশ উপজেলার বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুরাও লেখা পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যালয়ে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ৪৫ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। তাদের মধ্যে ২৩ জন ছাত্র ও ২২ জন ছাত্রী রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কারিকুলামে এখানে রয়েছে শিশু, ১ম ও ২য় শ্রেণী। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত একজন শিক্ষক ও একজন শিক্ষিকা সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত পাঠদান করছেন। তবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। প্রতিষ্ঠার দুই বছর পার হলেও সমস্যা পিছু ছাড়ছে না এই স্কুলের। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। এমনি পরিস্থিতিতে স্কুলটির উন্নয়নে সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতার আহবান জানানো হয়।
সরেজমিন বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখাযায়, উপজেলা পরিষদ আঙ্গিনায় পাবলিক লাইব্রেরীর একাংশে টিনশেডের ঘরে প্রতিবন্ধী শিশুদের হাতে ধরে ধরে শিক্ষা দিচ্ছেন শিক্ষক মো. শামীম ও শিক্ষিকা সুবর্ণা দেব। একটি মাত্র শ্রেণী কক্ষে সকল শিক্ষার্থী ছোট ছোট চেয়ার ও টেবিল নিয়ে বসে আছে। আর সামনে শিক্ষক পাঠদান দিচ্ছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতো তারাও শিক্ষকের সামনে শান্ত সুষ্টুভাবে বসে অক্ষর বলছে। কয়েকজন শিশু খাতায় ছবি আঁকছে। এসময় কয়েকজন শিক্ষার্থী ব্ল্যাক বোর্ডে বাংলা, ইংরেজী বর্ণগুলো লিখে সবাইকে দেখাচ্ছে। দেখলে মনে হয়না যে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে পিছিয়ে নেই। কিছুক্ষণ পর স্কুল ছুটি হয়ে গেলে সবাই সারিবদ্ধবাবে অভিভাবকদের হাত ধরে বেরিয়ে যায়। এখান থেকে শুধু প্রাথমিক শিক্ষাই নয়, সমাজে চলতে ফিরতে যা যা করণীয় সব আদর্শ শিক্ষাই দেয়া হচ্ছে এসব শিশুদের।
বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মারওয়া বেগম লিমা (১৫)। তার পিতা নানু মিয়া গোলাপগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী। দুই কন্যা সন্তানের মধ্যে মারওয়া বেগম লিমা ছোট। দীর্ঘদিন সে দাড়িপাতন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখা পড়া করে আর বিদ্যালয়ে যেতে চায়নি। পরবর্তীতে লিটল স্টার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এখানে ভর্তি করা হয়। এই এক বছরে তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে বলে তার অভিভাবক জানান। পৌরসভার সরস্বতী গ্রামের সাইফুল ইসলামের ১৬ বছরের পুত্র মো. ছামি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। গোলাপগঞ্জ আহমদ খান রোডে ঐ স্কুল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পড়াশুনা করছে। তার মধ্যেও পরিবর্তন এসছে বলে তার পিতা জানান। মো. ছামির ছোট ভাই সাদিও প্রতিবন্ধী। তাদের পিতা সাইফুল ইসলাম জানান, আমরা চাই এ বিদ্যালয়টি যেন বন্ধ না হয়। আশপাশ উপজেলা থেকেও অনেক শিক্ষার্থী এখানে এসে পড়ছে। বিদ্যালয়টি ঠিকিয়ে রাখতে তিনি সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহবান জানান।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো: শামীম জানান, প্রথমদিকে অনেক শিক্ষার্থী গেইটে এসে ভয়ে চলে যেত। তাদেরকে বিভিন্ন সময় খেলনা, চকলেট ইত্যাদি দিয়ে বিদ্যালয়মূখী করা হয়। এখন প্রায় সকলেরই আগ্রহ বেড়েছে। অভিভাবকরা সাথে করে বাচ্চাদের নিয়ে আসেন, সারাদিন সাথে থেকে ছুটির পর তারা বাড়ী নিয়ে যান। বিদ্যালয়ের সমস্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপজেলা প্রশাসন বিদ্যালয়টি পরিচালনা করছে, এরপরও কিছু সমস্যা রয়েছে- ডেস্ক, বেঞ্চসহ বিভিন্ন শিশুদের থেরাপী প্রদানের যন্ত্রের। তিনি বলেন, এরকম শিশু বেশিরভাগ দারিদ্র পরিবারের। প্রতিটি শিশুর জন্য টিফিনের ব্যবস্থা করতে পারলে স্কুলের প্রতি তাদের আরো আগ্রহ বাড়বে বলেও তিনি জানান।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আলতাফ হোসাইন জানান, বিদ্যালয়ের জন্য জেলা পরিষদে আবেদন করেছি, এখনও বরাদ্দ দেয়া হয়নি। স্কুলটি বড় করার কোন পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপাতত এখানেই পাঠদান চলবে। ভবিষ্যতে শিক্ষার্থী বাড়লে ভাল কোন জায়গা দেখে সেখানে স্থানান্তর করা হবে। তিনি বলেন শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ইতোমধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সাথে আলোচনা হয়েছে। সপ্তাহ বা ১৫ দিনে একবার তাদের সু-চিকিৎসা দেয়া হবে বলেও তিনি জানান।